বিএনপিকে ‘মাইনাস’ করা সম্ভব?

59

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষ নির্মূলের প্রবণতা একটি পুরোনো অসুখ। বিশেষ করে যখনই যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা মাঠ ও ভোটের রাজনীতিতে তাদের প্রধান প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার বদলে নির্মূলের পথে হাঁটতে চায়—যা স্পষ্টতই গণতন্ত্রের বিরোধী।

 

ঢাকাঃ দেশের বর্তমান ক্ষমতাসীনরা প্রধানত দুটি কারণে প্রতিপক্ষ নির্মূল করতে চায়; ১. প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা; বিশেষ করে যদি সে তার প্রতিপক্ষের দ্বারা কখনো নির্মূলপ্রক্রিয়ার শিকার হয় এবং ২. ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ করে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় টিকে থাকার লোভ। অর্থাৎ যেকোনো মূল্যে বিরোধী দল বা ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দল নিজের ক্ষমতা ও অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চায়। ক্ষমতাকে আনচ্যালেঞ্জড রাখতে চায়।

ক্ষমতাসীনদের এই কাজটি সহজ করে দেয় নির্বাচনি ব্যবস্থার দুর্বলতা, বিচার ব্যবস্থার রাজনীতিকরণ, গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ, নাগরিকের বাকস্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ তথা তাদেরকে ভয়ের মধ্যে রাখতে নানাবিধ আইনি কাঠামো, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনীকে দিয়ে দিয়ে ভয় দেখানো ইত্যাদি।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, যে দলের জনভিত্তি আছে, বিপুল ভোট ও জনসমর্থন আছে—তাদেরকে নির্মূল করা যায় না। রাষ্ট্রের সব অস্ত্র প্রয়োগ করে সাময়িকভাবে ওই দলকে দাবিয়ে রাখা গেলেও তার শেকড় উপড়ে ফেলা যায় না।

স্মরণ করা যেতে পারে, গত বছরের ২৬ আগস্ট, অর্থাৎ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাস চারেক আগে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন: ‘বিএনপি আমাদের নিঃস্ব করে দিয়েছে, ক্ষমতায় এলে এক রাতের মধ্যে শেষ করে দেবে।’ এর ঠিক পরদিনই রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও মোটামুটি একই কথা বলেন। তার ভাষ্য, ‘বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় গেলে কেউ শান্তিতে থাকতে পারবে না।’ এর দুদিন আগে আরেকটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের শেষ চিহ্ন ধ্বংস করে তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়।’

 

 

 

সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের এই তিন নেতার বক্তব্যের সারাংশ মোটামুটি এক। তা হলো, ক্ষমতা হারালে তারা বড় ধরনের বিপদে পড়বে। গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার এই পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সেই বিপদেই পড়েছে।

কেন এই ঘটনাটি ঘটলো এবং আওয়ামী লীগের মতো একটি বিরাট দল কেন এতটা বিপদে পড়ে গেলো—তার অনেকগুলো কারণ আছে। এ নিয়ে অনেকে বিচার-বিশ্লেষণ হচ্ছে, হবে। তবে এই লেখার উদ্দেশ্য সেটি নয়। এই লেখার মূল উদ্দেশ্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে মাইনাস বা নির্মূল করা এবং আলোচনাটি নতুন করে সামনে আসছে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি মন্তব্যের কারণে।

সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘কেউ যেন মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে আবার চিন্তা না করে অথবা ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো ষড়যন্ত্রে যেন লিপ্ত না হন।’ মির্জা ফখরুল স্মরণ করিয়ে দেন, ‘২০০৭ সালে এক-এগারোর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সময় বিরাজনীতিকরণ এবং মাইনাস-টু ফর্মুলা বাস্তবায়নের ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। সেই পথ অনুসরণ করার কথা চিন্তাও করা উচিত নয়। আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিএনপিকে কোনো ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। বাংলাদেশের জনগণ কখনোই তা মেনে নেবে না।’

কারো নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একজন উপদেষ্টা অপ্রত্যাশিত ও অযাচিত মন্তব্য করে বলেছেন, রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যেতে অস্থির। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। তার মতো কোনো ব্যক্তি এ ধরনের মন্তব্য করবেন তা আমরা আশা করি না।’

প্রসঙ্গত, গত ২ নভেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সড়ক পরিবহন ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘আমাদের হাতে সময় খুবই কম। কম সময়ে কতটুকু কাজ করতে পারব জানি না। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় যেতে উসখুস করছেন। আমিও আমার শিক্ষকতা পেশায় ফিরে যেতে চাই।’

প্রশ্ন হলো, বিএনপি কেন মাইনাস হওয়ার কথা বলছে বা মাইনাস হওয়ার ভয় করছে? যে গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতন হলো, সেই অভ্যুত্থানের নেপথ্যে বিএনপিরও অবদান আছে। এটি কোনো একটি পক্ষের আন্দোলন ছিল না। বরং এই অভ্যুত্থানে বিএনপি, জামায়াত, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ আরও অনেক রাজনৈতিক দল এমনকি বিভিন্ন অরাজনৈতিক সংগঠনেরও সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। সুতরাং যে অভ্যুত্থানে বিএনপি অংশ নিয়েছে এবং যে অভ্যুত্থানের পরে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রক্রিয়ায়ও বিএনপি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, সেই দলটি কেন এখন মনে করছে যে তাদেরকে মাইনাস করে দেওয়া হতে পারে বা তাদেরকে বাদ দিয়ে নির্বাচন হতে পারে? বিএনপি কি তার সুস্পষ্ট কোনো লক্ষ্মণ দেখছে?

অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বিএনপিকে মাইনাস করে দেওয়ার অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, ‘এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ ধরনের বক্তব্য অহেতুক বিতর্কের জন্ম দেয়। মাইনাস টুর পরিকল্পনা সরকারের নেই। সরকার নির্বাচন সংস্কার নিয়ে কাজ করছে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক এখনো ভালোই বলা চলে। কিন্তু এও ঠিক যে, অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে চাইলে তাদের সঙ্গে প্রথম কনফ্লিক্ট বিএনপিরই হবে। কেননা দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপি যতটা সরব, অন্য দলগুলো ততটা নয়। তার কারণ বিএনপি দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে এবং বিএনপি মনে করে অন্তর্বর্তী সরকার দেশ সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারছে না। উপরন্তু তারা যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তার সব কাজ করার এখতিয়ারও তাদের নেই। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতিকে সরিয়ে দেওয়ার ইস্যুতেও বিএনপি শক্ত অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু যত যাই হোক, বিএনপিকে মাইনাস করে দেওয়া হবে কিংবা কেউ এই চেষ্টা করলেই সেটি সফল হয়ে যাবে, ব্যাপারটা এত সহজ নয়।

বরং রাজনীতির নিয়মই হলো এই যে, কেউ ক্ষমতায় থাকবে, কেউ বিরোধী পক্ষে। এখানে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রশ্নটিই অবান্তর, অগণতান্ত্রিক। কিন্তু মুশকিল হলো, বাংলাদেশে ক্ষমতায় আরোহণের ব্যাপারটি এখন বাঘের পিঠে সওয়ারের মতো। যে কারণে কেউ একবার বাঘের পিঠে বসে পড়লে আর নামতে চায় না ওই বাঘ তাকে খেয়ে ফেলবে এই ভয়ে। গত ৫ আগস্ট তা-ই হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা, একটি পুরো পরিবার এমনকি তৎকালীন সরকার ও দলের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষকে পালিয়ে যেতে হলো। অথচ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলেও দলের সব সিনিয়র নেতাকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয়নি। তার মানে ক্ষমতায় আরোহনের ব্যাপারটি এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ—যে ঝুঁকিটা তৈরি হয়েছে মূলত প্রতিপক্ষ নির্মূলের রাজনীতির মধ্য দিয়েই।

বাংলাদেশের রাজনীতি যে চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসা এবং বিরোধী মতের অনুসারী তথা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাওয়ারই ইতিহাস—তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।

প্রতিপক্ষকে সমূলে ধ্বংস তথা নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার আরেকটি বড় ঘটনা ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীতে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জনসভায় ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা। এই হামলার দায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি এড়াতে পারে না।

কিন্তু এরপরে গত ১৫ বছর ভোটের মাঠে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিকেও রাজনৈতিকভাবে পুরোপুরি নির্মূল করে দেওয়ার নানাবিধ আয়োজন হয়েছে। নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজারো মামলা; বছরের পর বছর ধরে কারাবন্দি; ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস; আত্মীয়-স্বজনের ওপর নানাভাবে হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তাতে বিএনপি ধ্বংস হয়ে যায়নি। কারণ জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত কোনো দল, অর্থাৎ যার শেকড় গভীরে, তাকে ধ্বংস বা নির্মূল করা যায় না।

মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগের মতো প্রভাবশালী দল এবং শেখ হাসিনার মতো পরাক্রমশালী শাসক টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও এই দলকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করতে পারেনি। বরং আওয়ামী লীগের পতনের পেছনে বিএনপিকে মাইনাস করতে চাওয়াও একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়।

সুতরাং একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তুলতে হলে প্রথমে নিজেকে গণতন্ত্রের প্রতি সমর্পণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিরোধী মত ও পথের প্রতি দমনমূলক আচরণ বন্ধ করে সংলাপ ও সহযোগিতার মাধ্যমে রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসন করতে হবে।

জুলাই অভ্যুত্থানের পরে বাংলাদেশ যে একটি বিরাট অনিশ্চয়তার ভেতরে পড়ে গেল, সেখান থেকে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে টেনে তুলতে গেলে বিএনপির মতো দলকে প্রয়োজন হবে। তাকে বাদ দেওয়ার চিন্তা হবে আত্মঘাতি।

এমনকি এটিও বিবেচনায় রাখা দরকার যে, সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগেরও বিরাট ভোটব্যাংক ও জনসমর্থন রয়েছে। সুতরাং তাকেও রাজনীতি থেকে মাইনাস করে দেওয়া অসম্ভব। তবে এটা ঠিক যে, এই দলের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, দুর্নীতি ও লুটপাটের মতো গুরুতর অভিযোগ রয়েছে—আদালতে প্রমাণসাপেক্ষে তাদের বিচার হতে হবে। সেই বিচার অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্যও হতে হবে।

দলটি যে গভীর সংকটে পড়েছে, সেখান থেকে তারা কী করে বেরিয়ে আসবে, সেই কৌশল তারাই ঠিক করবে। হয়তো তাদেরকে নতুন নেতৃত্বের সন্ধান করতে হবে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আওয়ামী লীগকে নির্মূল করে দিতে হবে। নির্মূলের রাজনীতি দেশকে পিছিয়ে দেয়। চরমপন্থার উদ্ভাব ঘটায়।

অতএব নির্বাচন হবে, জনগণ যাকে খুশি ভোট দেবে। যদি তারা মনে করে বিএনপিকে রাষ্ট্র পরিচালনার ভার দেবে, তাহলে ক্ষমতায় আসবে। যদি তারা অন্য কোনো দলকে ম্যান্ডেট দেয়, তাহলে তারা সরকার গঠন করবে। কিংবা কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পেলে হয়তো একটি কোয়ালিশন সরকার হবে। কী হবে সেটি ভোটের আগে বলার সুযোগ নেই। সরকারের দায়িত্ব একটি অবাধ-সুষ্ঠু-নিরপেক্ষ-গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করা। সেই নির্বাচনে জনগণই ঠিক করবে কে মাইনাস হবে আর কে সরকার গঠন করবে। কোনো একটি দলকে মাইনাস করে দেওয়ার এখতিয়ার অন্য কোনো দল বা গোষ্ঠীর নেই। সরকারেরও নেই।

পরিশেষে, কোনো দল যদি জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়—সে একসময় এমনিতেই মাইনাস হয়ে যাবে। কেননা প্রতিপক্ষ নির্মূল করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে গিয়ে সে তার অজান্তেই নিজের জন্য গর্ত খুঁড়তে থাকে।

আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।

পূর্বের খবরNo pressure on media from govt: Adviser
পরবর্তি খবরঅন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নাকি অন্যকিছু?