সম্পাদক পরিষদের সদস্যরা ৩ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে যেসব আইনে সাংবাদিক নিপীড়নের ধারা আছেতা এখনই বাদ দেয়ার প্রস্তাব করে। পরে তারা প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা বলে। সম্পাদক পরিষদের সভাপতি এবং দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক সাংবাদিকদের এই তথ্য জানিয়েবলেন, “আমরা সংবিধানসজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইনে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছি।”
অন্য দিকে ডিএসএ (ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) ভিকটিমস নেটওয়ার্ক এখনো সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট বাতিলের উদ্যোন না নেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এই আইন বাতিলের জন্য তারা প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে স্মারক লিপি দিয়েছে।
দেশেরসাংবাদিক, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশিজাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিরোধিতার মধ্যেই ২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর সংসদে পাস হয়েছিলো ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। তারপর সেই প্রতিবাদ সামাল দিতে ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর করা হয় সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট। আসলে এই আইনটি পুরনো আইনই নতুন নামে করা হয়। তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন,” এটি একটি কালা কানুন। তাই আমরা এই আইনটি বাতিলের দাবি করেছি শুরু থেকেই। এই আইনের উদ্দেশ্য হলো বাকস্বাধীনতা , স্বাধীন সাংবাদিকতা ও ভিন্ন মতের মানুষকে দমন। এই আইনটি হয়রানির কাজেই সরকার ও সরকারের লোকজন ব্যবহার করেছে।”
এটি কালা কানুন: সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার
তার কথায়, “আইনটি বাতিল করা প্রয়োজন। তবে আগের মামলাগুলো কী হবে। সবই কী প্রত্যাহার হবে, না যাচাই বাছাই করা হবে তার জন্য সময় দেয়া প্রয়োজন। আর যদি আইন ও সাংবিধানিক সংস্কার হয় তাহলে এক সঙ্গেই করা যায়। কিন্তু সাইবার অপরাধ দমনে নগারিকদের জন্য প্রয়োজনীয় আইন লাগবে।”
সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্ট্যাডিজ বলছে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট এক হাজার ৩৬টি মামলা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। তাতে আসামি চার হাজার ৫২০ জন। তার মধ্যে এক হাজার ৫৪৩ জনের পেশাগত পরিচয় পাওয়া গেছে। দুই হাজার ৯৮৬ জনের পেশাগত পরিচয় পায়নি সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্ট্যাডিজ। যাদের পেশাগত পরিজয় জানা গেছে, তাদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতারাই সংখ্যায় বেশি, ৪৯৫ জন। তারপরই রয়েছে সাংবাদিক ৪৫১ জন। এছাড়া সরকারি চাকুরে, চিকিৎসক, এনজিও কর্মী, আইনজীবী, ছাত্র, শিক্ষক রয়েছেন। শতাংশ হিসাবে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ৩২.২৭ শতাংশ এবং সাংবাদিক ২৯.৪ শতাংশ। এইসব মামলায় আসামিদের মধ্যে ২৮ জন আছেন যাদের বয়স ১৮ বছরের নিচে।
মামলায় এক হাজার ৫৪৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১৪৩ জন রাজনৈতিক নেতা- কর্মী , ছাত্র ১০৪ জন এবং সাংবাদিক ৯৭ জন।
মামলা দায়েরকারীদের মধ্যে শীর্ষে আছে র্যাব, পুলিশ, সরকারি কর্মকর্তা, রাজনৈতিক নেতা। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতারাই সবচেয়ে বেশি মামলা করেছেন, ৩৩৪টি। যেসব রাজনৈতিক লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তারা প্রায় সবাই বিরোধী নেতা-কর্মী।
এইসব মামলায় শাস্তি হয়েছে খুবই কম। তারপরও জেলে থাকতে হয়। হয়রানির শিকার হতে হয়। এই মামলার আসামি লেখক মুশতাক আহমেদ ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে কারাগারেই মারা যান। আর্টিক্যাল ১৯ বলছে শুধু ২০২১ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বাংলাদেশে যত মামলা হয়েছে, তার মধ্যে ৪০ শতাংশ মামলাই হয়েছ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসহ সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নামে কটূক্তির কারণে।
আর্টিক্যাল নাইনটিন-এর বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক শেখ মঞ্জুর ই আলম বলেন, “আইন সংস্কারের কথা সরকার বলছে। তারা সংবিধান সংস্কারের কথা বলছেন। তবে তাদের অগ্রাধিকার কোথায় তা আমরা এখনো বুঝতে পারছিনা। সরকার যে এই আইনটি বাতিল বা সংস্কারের দ্রুত কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে তা আমার জানা নেই। তবে আমি দ্রুত উদ্যোগ চাই।”
তিনি বলেন, “তবে এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। পুরণো মামলাগুলোর কী হবে। সাইবার অপরাধ দমনের আইন কেমন হবে। সব কিছু ভাবতে হবে। তবে প্রচলিত আইনটি রাখা যাবেনা। এটা নিবর্তনমূলক আইন।”
‘সরকার এ আইন বাতিলের উদ্যোগ নিচ্ছে কি না জানিনা’
সরকারি দুই-একজন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সংশোধনের কথা বললেও তার প্রক্রিয়া এখনো স্পষ্ট নয়। আইন ও সালিস কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক ফারুক ফয়সাল বলেন,” আমি যত দূর জানি এই আইনটি সংশোধন করা হবে। আইন উপদেষ্টা এব্যাপারে উদ্যোগ নিচ্ছেন। তবে এটা দ্রুত হওয়া প্রয়োজন।”
ব্যারিস্টার ওমর ফারুক বলেন,” এই আইনটিতে পুলিশকে অবাধ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে মামলা ও গ্রেপ্তারের ব্যাপারে। তারা এই আইনের আওতায় অনুভূতির কথা বলে যে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে। আবার যেকেনো সংবাদ মাধ্যমের প্রকাশনা বা সম্প্রচার কৌশলে বন্ধ করে দিতে পারে। সাধারণ মানুষের মোবাইল ফোন চেক করতে পারে। এই আইনটি ফিলিপাইনের একটি কালো আইনের কপি পেস্ট। ওই দেশের আদালত তাদের দেশে আইনটি বাতিল করলেও আমাদের দেশে এখনো বহাল আছে।”
আর ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়সের সভাপতি সাজ্জাদ আলম খান বলেন,” ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বেশ কিছু ধারা উপধারা আছে যা স্বাধীন সাংবাদিকতার বিরুদ্ধে যায়। আমরা আগেও ওই ধারাগুলো বাতিলের দাবী করেছি। এখনো বাতিলের দাবি জানাই।”
তবে এই বিষয় নিয়ে চেষ্টা করেও আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের বক্তব্য জানা যায়নি।