ঢাকাঃ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে, সেই দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছি। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এটা যুগান্তকারী ঘটনা। গতকাল সোমবার গণভবনে বিদেশি পর্যবেক্ষক ও সংবাদকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
প্রধানমন্ত্রী বিদেশি সাংবাদিক ও নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন এবং নিজেও তাদের উদ্দেশে কিছু প্রশ্ন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি অনেকবার নির্বাচন করেছি। সেই ১৯৮৬ সাল থেকে আটবার আমার নির্বাচন করা হয়ে গেছে। তবে এত মানুষের আগ্রহ আগে দেখিনি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের জনগণ অনেক আনন্দিত এবং নির্বাচন যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন, মতামত দিয়েছেন, সেটা উপযোগী। সেজন্য সবাইকে ধন্যবাদ।’
২০১৪ ও ২০১৮ সালের ফল তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সব সময় এটাই চেষ্টা ছিল, নির্বাচনটাকে সুষ্ঠু করা। মানুষের যে ভোটের অধিকার, মানুষ যাকে ক্ষমতায় চায়, সে সিদ্ধান্ত মানুষই নেবে। সেজন্য নির্বাচনের ব্যবস্থাকে সংস্কার করেছি।’
নির্বাচন কমিশন আইনসহ অন্যান্য বিধান তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন চলাকালে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাইকে নির্বাচন কমিশনের অধীনস্থ করে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাটাই লক্ষ্য ছিল।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘এবারের নির্বাচনটা আরেকটু ব্যতিক্রমী। সাধারণত আমরা দলের প্রার্থী ঠিক করে দিই বা সব দল তাদের প্রার্থী বাছাই করে দেয়। এবার আমরা আমাদের প্রার্থী বাছাই করেছি; পাশাপাশি নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিয়েছি, যার ইচ্ছামতো দাঁড়াতে পারবে।’
বিএনপির ভোট বর্জন প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দলটি সামরিক স্বৈরশাসকের হাতে তৈরি। তারা নিজেরা চলতে পারে না, নিজেদের জনসমর্থন থাকে না। সেজন্য নির্বাচনকে ভয় পায়। আমাদের দল হলো জনগণের।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এ বিজয়টা আমার বিজয় না। আমি মনে করি জনগণের বিজয়। কারণ, এখানে জনগণের যে অধিকার আছে, সরকার গঠন করার ক্ষমতা তাদের হাতে। আমরা দীর্ঘদিন সংগ্রাম করেছি এ জন্য যে, জনগণের ভোটের অধিকার নিজেরা প্রয়োগ করবে; সেটা সুষ্ঠুভাবে হয়েছে।’
নতুন সরকার গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন হয়ে গেছে, এখনো গেজেট হয়নি। তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। গেজেটের পর শপথ হবে, এরপর আমাদের সংসদীয় দলের বৈঠক করতে হবে। সেখানে সংসদীয় দলের নেতা কে হবে, সেটা নির্বাচন করতে হবে। তখন সরকার গঠন করতে রাষ্ট্রপতির কাছে যেতে হবে। সরকার গঠন হবে। এটাই সংবিধানিক প্রক্রিয়া।’
ভোট দেখতে আসায় বিদেশি পর্যবেক্ষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য এটা যুগান্তকারী ঘটনা।’ পর্যবেক্ষকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যে অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে, সে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পেরেছি। আপনাদের আগমনে দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার আরও সুরক্ষিত হয়েছে। আপনারা যার যার দেশে ফিরে যাবেন, বাংলাদেশের কথা বলবেন। আপনাদের আগমন আমাদের গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থাকে আরও মজবুত ও শক্তিশালী করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
বিবিসির সাংবাদিক সামিরা হুসেইন বলেন, ‘আপনি প্রধান বিরোধী দলকে ২০১৮ সালের পর থেকে সংলাপে অন্তর্ভুক্ত করেননি। তাদের অনুপস্থিতিতে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। ৬০ শতাংশ মানুষ ভোট দেননি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সীমিত করা হয়েছে বলে মানবাধিকারকর্মীরা আপনার সরকারের সমালোচনা করছেন। আপনি কি বিশ্বাস করেন, বাংলাদেশে একটি গতিশীল গণতন্ত্র থাকবে, যেখানে কোনো বিরোধী দল নেই?’
জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘প্রতিটি দলের নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। সেখানে যদি কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তার মানে এই নয় যে গণতন্ত্র নেই। আপনাকে বিবেচনা করতে হবে মানুষ অংশ নিয়েছেন কিনা। আপনি যে দলের (বিএনপি) কথা বলেছেন, তারা আগুন দেয়, মানুষ হত্যা করে। কিছুদিন আগে ট্রেনে আগুন দিয়ে মানুষ মেরেছে। এটা কি গণতন্ত্র? এটা সন্ত্রাসী কর্মকা-। মানুষ এটা গ্রহণ করে না। এ ধরনের ঘটনা এ দেশে একাধিকবার ঘটেছে। আমরা ধৈর্য দেখিয়েছি। মানুষের অধিকারকে রক্ষা করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিএনপি মানুষকে এ নির্বাচনে ভোট না দিতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মানুষ তাদের কথা শোনেনি।’
বিবিসির সাংবাদিকের প্রতি ইঙ্গিত করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি কত মানুষ মেরেছে, সে প্রশ্ন তিনি করেননি। তারা ২০১৪-১৫ সালে যা করেছে, তাতে তাদের কীভাবে গণতান্ত্রিক দল বলা যায়? তারা সন্ত্রাসী দল এবং মানুষ তাদের সমর্থন করে না।’
ভারতের টেলিগ্রাফের সাংবাদিক দেভাদীপ পুরোহিতের প্রশ্ন ছিল, ‘নির্বাচন শেষ হয়েছে। আপনি যখন গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তখন আপনার বিরোধী দলের প্রয়োজন হবে। এ ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন?’
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনি কি চান আমি একটি বিরোধী দল গঠন করি? আমি তা করতে পারি? আমি নিজেও বিরোধী দলে ছিলাম দীর্ঘ সময়। আমরা আমাদের দল গঠন করেছি। বিরোধীদেরও তা করতে হবে। আপনি যদি তা করতে ব্যর্থ হন, তা হলে তার জন্য কে দায়ী?’
বিদেশি এক সাংবাদিক প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, তার এই বিজয় উদ্?যাপনের সময় তিনি ড. ইউনূসকে ক্ষমার বিষয়টি বিবেচনা করবেন কিনা? জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ইউনূসের বিষয়টা শ্রম আদালতের। তার নিজের প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বঞ্চিত এবং তারা মামলা করেছেন। তিনি শ্রম আইন ভঙ্গ করেছেন, নিজের কর্মীদের বঞ্চিত করেছেন। এখানে আমার কিছু করার নেই। তার ক্ষমার বিষয়ের প্রশ্ন আমার কাছে আসে না। বরং তার উচিত নিজের কর্মীদের কাছে ক্ষমা চাওয়া।’
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিচালনাকারী ‘লৌহমানবীর’ সঙ্গে তাকে তুলনা করেন একজন বিদেশি নির্বাচন পর্যবেক্ষক। এ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, দেশ চালানোর সময় পুরুষ না নারী, সে চিন্তা করা উচিত নয়। একজন নারী হিসেবে তিনি কখনোই মনে করেন না তার কোনো বাধা আছে। তিনি দেশের মানুষের জন্য কাজ করেন। নারী একজন মা। যিনি পরিবার ও বাচ্চাদের দেখেন ও বড় করে থাকেন। মাতৃস্নেহ থেকেই তিনি দেশের মানুষের জন্য কাজ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি খুবই সাধারণ মানুষ। দেশের জনগণের জন্য দায়িত্ববোধ রয়েছে যে তাদের জন্য কাজ করতে হবে; তাদের উন্নত জীবন দিতে হবে। সেটা করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’
ভারতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি গৌতম লাহিড়ীর সুশাসন ও স্মার্ট বাংলাদেশবিষয়ক প্রশ্নে শেখ হাসিনা বলেন, ‘২০৪১ সালের স্মার্ট বাংলাদেশকে লক্ষ্য ধরে তরুণ জনগোষ্ঠীকে ভবিষ্যতের জন্য সঠিকভাবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তোলা হবে।’
এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনালের (এএনআই) সাংবাদিক অশোকা রাজের প্রশ্ন ছিল, আগামী পাঁচ বছরের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর লক্ষ্য কী? নির্বাচনে জয়ের পরে ভারত থেকে বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে কী ধরনের শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছেন? জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ভারত বাংলাদেশের বড় বন্ধু। ১৯৭৫-এ তার পরিবারকে হত্যার পর ভারত তাকে ও তার বোনকে আশ্রয় দিয়েছিল। যদিও কিছু সমস্যা আছে, কিন্তু সেটা দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করা হয়। এ ছাড়া সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের নীতি।
ওয়াশিংটন থেকে আসা একজন সংবাদকর্মী যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে জানতে চান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবার সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশের নির্বাচন ভালো হয়েছে, এটা বলার জন্য ওই ব্যক্তিকে প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ জানিয়ে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কী বলবেন, এটা আপনার দেশের (যুক্তরাষ্ট্র) চেয়ে ভালো নির্বাচন কিনা?’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ চমৎকার; তারা আমার কথা শোনে। তবে কিছু বিরোধী আছে। সেটা খুব স্বাভাবিক।’ শেখ হাসিনা বলেন, তিনি প্রতিশোধপরায়ণ নন। তিনি কখনো কারও ওপর প্রতিশোধ নেননি। তিনি খোলা মনের ও উদার। অনেক টিভি চ্যানেল আছে। কিন্তু সরকারের টিভি চ্যানেল একটি। সেখানে মানুষ কথা বলছে। অনেক পত্রিকা, যারা লিখতে পারছে। সেখানে তিনি কখনোই হস্তক্ষেপ করেন না। বরং কেউ সমালোচনা করলে তা ভালো। সেখান থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।