‘এই নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও দক্ষিণ এশিয়ার স্ট্যান্ডার্ডে গ্রহণযোগ্য হচ্ছে না’: আলী ইমাম মজুমদার

134

ঢাকাঃ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক, শান্তিপূর্ণ ও দক্ষিণ এশিয়ার স্ট্যান্ডার্ডে হতে যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, দেশে একটি নিরেপক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থাকলেও বিএনপির মাঠ ছেড়ে দেওয়া উচিত হয়নি। মাঠে থেকেই তাদের দাবী আদায়ে সচেস্ট থাকা প্রয়োজন ছিল। এবারের নির্বাচনের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে দেশের সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার এসব মন্তব্য করেন।

প্রশ্ন: এবারের নির্বাচনকে সামগ্রিকভাবে কীভাবে দেখছেন?

আলী ইমাম মজুমদার: একজন ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে যেহেতু আমি কোনো পলিটিক্যাল পার্টিকে রিপ্রেজেন্ট করি না, এবারের নির্বাচন নিয়ে আমি হতাশ। ২০০৮ সালের পর আমাদের ভালো কোনো নির্বাচন হয়নি। আশা করেছিলাম, এবার পার্টিসিপেটরি বা ইনক্লুসিভ, শান্তিপূর্ণ ও দক্ষিণ এশিয়ার স্ট্যান্ডার্ডে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এটা হচ্ছে না।

প্রশ্ন:  এ না হওয়ার দায় কার দিকে যাবে?

আলী ইমাম মজুমদার: এর দায় অনেকের দিকেই যাবে। প্রথমত, নির্বাচন কমিশন লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারেনি। যে কারণে সবগুলো রাজনৈতিক দল আস্থা নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি।

দ্বিতীয় দায় দেবো সরকারকে। কারণ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা নির্বাচন কমিশনের একার দায়িত্ব না। সরকারেরও এতে ভূমিকা আছে। সরকারের তরফ থেকে কোনো প্রচেষ্টা ছিল বলে লক্ষ্য করা যায়নি। বরং বিপরীত দিকটাই লক্ষ্য করা গেছে।

পাশাপাশি যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, প্রধানত বিএনপির কথাই আমি বলব, কোনো রাজনৈতিক ফর্মুলা নন-নেগোশিয়েবল হয় না। তারা একটাই ফর্মুলা দিয়ে রাখছে, সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া তারা কোনো আলোচনায় যাবে না, ইলেকশন করবে না। এইরকম নন-নেগোশিয়েবল কিছু হয় না। আমি মনে করি বর্তমান প্রেক্ষিতেও যদি তারা নির্বাচনে যেত, সেটা তাদের জন্য ভালো হতো।

সবচেয়ে বড় কথা গত ২৮ অক্টোবর তাদের সমাবেশে যে হামলা হয়, সমাবেশটা যে পণ্ড হয়ে যায়, পুলিশের একটা যুক্তি আছে, চিফ জাস্টিসের বাসায় হামলা হয়েছে, সেগুলো দুঃখজনক এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যারা করেছে তাদের চিহ্নিত করা দরকার। কিন্তু গোটা সমাবেশটা পণ্ড করার মতো অবস্থা ছিল না। বরং এটার জন্য দায়টা দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, পরিকল্পিতভাবে সমাবেশ পণ্ড করে দেওয়া হয়েছে।

প্রশ্ন:  সরকার নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু এটা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কি গ্রহণযোগ্য হবে বলে মনে হয়?

আলী ইমাম মজুমদার: আমি থাকি ঢাকা উত্তরায়, ঢাকা-১৮। আওয়ামী লীগ এটা ছেড়ে দিয়েছে জাতীয় পার্টিকে। মানে নৌকা নেই। কিন্তু এখানে জাতীয় পার্টির সক্রিয় প্রচারণা দেখছি না। দুইজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আছে। তাদের বেশি সক্রিয় মনে হয়েছে আমার কাছে।

আমরা যখন কিছু কিনতে যাই, তখন কিন্তু যেখানে চয়েস করার সুযোগ বেশি থাকবে, সেখানে যাবে মানুষ। তেমন নির্বাচনের ক্ষেত্রেও অনেকগুলো থেকে সিলেক্ট করার ব্যাপার থাকে। কিন্তু যখন অনেকগুলোর অপরচুনিটি নষ্ট হয়ে যায়, প্রধান দুই দলের একটা যখন নির্বাচনে থাকে না, তখন কিন্তু চয়েসের জায়গাটা সীমিত হয়ে যায়।

এখানে সরকারি দল একটা দল। পাশাপাশি জাতীয় পার্টি তাদের সহযোগী হিসেবে আছে। তাদের জন্য ২৬টি সিট ছেড়েছে আওয়ামী লীগ। বৃহস্পতিবার নারায়ণগঞ্জে প্রধানমন্ত্রীর সমাবেশে জাতীয় পার্টির প্রার্থী উপস্থিত ছিলেন। ধরে নেওয়া যায়, জাতীয় পার্টি তাদের সঙ্গেই আছে। আর ১৪ দলের কথা যে বলা হয়, তাদের মধ্যে তিনটা দলকে সিট দিয়েছে সরকার। তারাও কিন্তু নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছে। সুতরাং এখানে দেখা যাচ্ছে যে দলগতভাবে নির্বাচনে শুধু আওয়ামী লীগই আছে।

এটা সত্যি যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন। এই স্বতন্ত্ররাও কিন্তু অধিকাংশ আওয়ামী লীগের লোক। এটা প্রকৃতপক্ষে জাতীয় নির্বাচন না। একটা জাতীয় নির্বাচন যখন হয়, তখন শুধু নিজের দেশের নয়, পাশের দেশের এবং অন্য দেশের লোকেরাও দেখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন কিন্তু সারা পৃথিবীর মানুষ দেখে, ফলাফল দেখে। ভারতের লোকসভা নির্বাচন, শুধু তাই না, পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনও আমরা খুব কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ্য রাখি যে কে জিততে যাচ্ছে। কারণ এটার সঙ্গে আমাদের ভালো-মন্দ সম্পর্কিত। ঠিক আমাদের বাংলাদেশের নির্বাচন, ২০০৮ সালের নির্বাচন পর্যন্ত সন্ধ্যার পর সবাই টিভির সামনে বসে যেত। ওই সময় আমাদের যারা প্রতিবেশী ছিলেন, তারাও কৌতূহলী ছিলেন।

কিন্তু এবার এ ধরনের কৌতূহলের জন্য শুধু ফলাফল জানা না, ভোট দিতে যাওয়ার জন্যও কোনো কারণ আমি দেখি না। কারণ একটা ডিসিসিভ গেম চলছে। নিশ্চিতভাবে ধরে নেওয়া যায় যে এখানে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করবে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হবেন। মন্ত্রিসভার মধ্যে হয়তো কিছু রদবদল আসবে। এ ছাড়া, তো এখানে কৌতূহল-উদ্দীপক কোনো ব্যাপার নেই। পানসে একটা ব্যাপার বলে আমার মনে হয়।

প্রশ্ন:  অতীতের কোনো নির্বাচনের সঙ্গে এই নির্বাচনের কোনো মিল বা অমিল পাচ্ছেন?

আলী ইমাম মজুমদার: ১৯৮৮ সালের নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল না। শুধু তা না, মানুষজন ভোটকেন্দ্রে যায়নি। আমি দুইটা গণভোট দেখেছি। একটা ৭৭-এ, একটা ৮৫-তে। একই ধরনের হয়েছে, কোনো লোকই যায়নি। সেগুলো তো কোনোটার সঙ্গে কোনোটার তুলনা করা যাবে না। একেকটার একেক বৈশিষ্ট্য। এবারের নির্বাচনে একেবারেই মানুষ যাবে না বা উৎসাহ নেই এরকম বলা যাবে না। কারণ যেসব জায়গায় স্বতন্ত্ররা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে পেরেছে, ওইখানে তো নিশ্চয়ই উত্তেজনা আছে।

প্রশ্ন: সরকার তাদের যে কৌশলগত জায়গায় দেখাতে চেয়েছিল, সেটা স্থানীয় কিছু আসনকেন্দ্রিক জায়গায় দেখাতে পারছে। ওভারঅল নেই…

আলী ইমাম মজুমদার: ওভারঅল প্রতিযোগিতা তাদের-তাদের মধ্যেই হচ্ছে। সায়েদুল হক সুমন যদিও আওয়ামী লীগের লোক, তা সত্ত্বেও একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ জায়গায় তো প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হচ্ছে না।

প্রশ্ন:  ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে…

আলী ইমাম মজুমদার: ৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে আমি ফিল্ডে ছিলাম না। আমি যতটা জানি, এটা সম্ভবত ৮৮ এর নির্বাচনের চেয়ে বেটার। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনটা করেছিল। কিন্তু অনেকগুলো জায়গায় কোনো ভোটারই যায়নি। আবার অনেকগুলো জায়গাতে ভোটগ্রহণকারী অফিশিয়ালরা যেতে পারেনি। পণ্ড হয়ে গিয়েছিল নির্বাচনটা।

আমরা তো চাই ৩০০ আসনে নির্বাচন হবে। ৩০০ আসনে নির্বাচন হোক, ৩০০ আসনে তারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিত হোক এবং শেষ পর্যন্ত আমরা জানতে পারি অমুক নির্বাচিত হলেন, অমুক দল মেজরিটি পেল, ওমুক দল মেজরিটি পার্টির লিডার প্রধানমন্ত্রী হবেন এবং মন্ত্রিসভা গঠিত হবে—এটাই তো আমরা আশা করি। সেটা কিন্তু হলো না।

প্রশ্ন: আপনি নির্বাচন কমিশন, আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে দোষ দিলেন। এখানে বিএনপি যে এক জায়গায় রিজিড ছিল, সেটাকে কি বিএনপির ভুল হিসেবে অভিহিত করবেন? নাকি কৌশলগতভাবে তারা ঠিক করতে পারেনি?

আলী ইমাম মজুমদার: ২০১৪ সালের নির্বাচন থেকে তারা বয়কট করা শুরু করে। আমি ওইখান থেকেই আসব। ১৪ এর ওই নির্বাচনের ইমিডিয়েট আগে পাঁচটা সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয়, সবগুলোতে বিএনপি জেতে। তারপর বিএনপির পক্ষ থেকে এই অবস্থান নেওয়া উচিত ছিল যে, আমরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চাই, কিন্তু মাঠ ফাঁকা রেখে দেবো না। আমরা জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।

পূর্বের খবরসারাদেশে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর বিজয় মিছিল ও সহিংসতা নয়: শেখ হাসিনা
পরবর্তি খবরবিএনপি দেশবাসীকে অভিনন্দন জানাল, সংবাদ সম্মেলন ডেকেছে বিএনপি