অটোমান সাম্রাজ্যে সুলতানদের ভাই হত্যার বিতর্কিত সে অধ্যায়

141
অনলাইন ডেস্কঃ অটোমান সাম্রাজ্যের শত শত বছরের রাজত্বের বিভিন্ন চরিত্র (যারা ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ অংশ শাসন করেছে এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছে) এখনো অনেক টিভি নাটক এবং সিরিজের আলোচ্য বিষয়।

এর মধ্যে প্রথম সুলতান আহমেত এবং তার স্ত্রী কুসুম সুলতানের জীবন নিয়ে একটি ধারাবাহিক নাটক নির্মিত হয়েছে।

সেখানে দেখা যায়, সুলতান আহমেত আশপাশের লোকজন এবং সাম্রাজ্যের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে রাখতেন, যেন তিনি তার ছোট ভাইদের হত্যা করেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি সমাজে সিংহাসনের দখল পেতে ভাই-বোন, পিতা-পুত্র এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে হানাহানি বা যুদ্ধের ঘটনা নতুন কিছু নয়।

তাহলে অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এমন ঘটনার কী ধরণের উদাহরণ রয়েছে? প্রথমে সুলতান আহমেদের বাবা সুলতান মেহমেত-এর (তৃতীয়) সিংহাসন দিয়ে শুরু করা যাক।

একসাথে ১৯ রাজপুত্রকে হত্যা

১৫৯৫ সালের একদিন। অটোমান সাম্রাজ্য তাদের ক্ষমতার চরম শিখরে রয়েছে। এটি সেইদিন যেদিন সুলতান মুরাতের (তৃতীয়) মৃত্যুর পর তার সিংহাসনের ক্ষমতা পুত্র মেহমেতের হাতে অর্পণ করা হয়, যিনি এখন সুলতান মেহমেত তৃতীয় নামে পরিচিত।

কিন্তু ইতিহাসে এই দিনটি স্মরণীয় থাকার কারণ নতুন সুলতানের আগমন নয় বরং ইস্তাম্বুলের রাজপ্রাসাদে ১৯ জন রাজকুমারকে হত্যার ঘটনা দিনটিকে স্মরণীয় করেছে।

এই সমাধিগুলো নতুন সুলতান মেহমেত -এর (তৃতীয়) ভাইদের ছিল, যাদের সেই সময়ে রাজ্যে প্রচলিত ভ্রাতৃহত্যার রাজকীয় ঐতিহ্য অনুসারে, নতুন সুলতান সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল।

অটোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসের উপর ভিত্তি করে “লর্ডস অফ দ্য হরাইজনস” বইতে, লেখক জেসন গুডউইন ইতিহাসের বিভিন্ন কথা উদ্ধৃত করে লিখেছেন যে ওই রাজপুত্রদের একে একে হত্যা করা হয়েছিল।

তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ রাজপুত্র, যিনি বেশ সুন্দর ও সুস্থ দেহের অধিকারী ছিলেন, তিনি মিনতি করে বলেছিলেন – ‘আমার জাহাঁপনা, হে আমার ভাই, যিনি এখন আমার বাবার জায়গায় আছেন, আমার জীবন এভাবে শেষ করবেন না।’

সেই দিনটির কথা উল্লেখ করে, জেসন লিখেছেন যে ইস্তাম্বুলের নাগরিকরা রাস্তায় এই শেষকৃত্যের মিছিল দেখে কেঁপে উঠেছিল।

ইতিহাসবিদ লেসলি পি. পিয়ার্স তার ‘ইম্পেরিয়াল হেরেম: উইমেন অ্যান্ড সরোরিটি ইন দ্য অটোমান এম্পায়ার’ বইতে ওই সময়ের আলোকে লেখা ইতিহাসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে সুলতান মুরাতের (তৃতীয়) শেষকৃত্যের পরের দিন, তার ১৯ জন রাজপুত্রকেও দাফন সম্পন্ন করা হয়েছিল।

ওই শেষকৃত্যে যোগ দিতে ইস্তাম্বুলের বহু মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সবার চোখ অশ্রুতে ভিজে উঠেছিল।

সুলতান মুরাত তৃতীয়
, সুলতান মুরাত তৃতীয়

নয় রাজকুমারের হত্যা

আমরা যদি ১৫৯৫ সাল থেকে একুশ বছর পিছিয়ে যাই, তাহলে আমরা দেখতে পাব যে সুলতান মেহমেত সোয়াইমের বাবা সুলতান মুরাত সোয়াইম তার শাসনের প্রথম দিন যা করেছেন, সেটি এই ঘটনা থেকে আলাদা কিছু ছিল না। অর্থাৎ তাকেও এই ধরনের কঠিন সিদ্ধান্তের সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

সুলতান মুরাতের পিতা, অটোমান সাম্রাজ্যের ১১তম সুলতান দ্বিতীয় সেলিম, ১৫৭৪ সালে ৫০ বছর বয়সে মারা যান। ওসমানীয় সাম্রাজ্য সেই বছর উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়াও জয় করেছিল।

সাম্রাজ্যের লাগাম তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মুরাত সোয়াইমের হাতে চলে যায়, যিনি তার প্রয়াত ভাইয়ের থেকে ২০ বছরের বড় ছিলেন এবং তার উত্তরাধিকার দৃশ্যত অবিসংবাদিত ছিল।

কিন্তু তারপরেও সুলতান মুরাত সিংহাসনে আরোহণের সময় তার সব ভাইদের হত্যা করেছিলেন এবং তাদেরকে পিতা সুলতান সেলিম দ্বিতীয়ের পাশে সমাহিত করা হয়েছিল।

ইতিহাসবিদ ক্যারোলিন ফিঙ্কেল তার বই ‘উসমানস ড্রিম: দ্য স্টোরি অফ দ্য অটোমান এম্পায়ার ১৩০০-১৯২৩’ বইয়ে সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের ইহুদি চিকিৎসক ডোমেনিকো হারসোলমিতানোকে উদ্ধৃত করেন, যিনি রাজকুমারদের মৃত্যুদণ্ডের বর্ণনা দিয়েছিলেন

ওই চিকিৎসকের ভাষ্য মতে, ‘ সুলতান মুরাদ খুব দয়ালু ছিলেন। তার নয় ভাইয়ের জীবন কীভাবে বাঁচানো যায় যে উপায় সম্পর্কে চিন্তা করেছিলেন তিনি। এজন্য সিংহাসনে বসার আগে তিনি আঠার ঘণ্টা অপেক্ষা করেন এবং শহরে তার আগমনের কোন ঘোষণাও দেননি। সুলতান মুরাদ রক্তপাত সহ্য করতে না পারছিলেন না, তার হৃদয় ভেঙে পড়েছিল।

শেষ পর্যন্ত অটোমান সাম্রাজ্যের আইন লঙ্ঘনের ভয়ে, তিনি রাজকুমারদের শ্বাসরোধ করে হত্যার নির্দেশ দেন।

সে সময় এই কাজটি করতো বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত বধির-মূক ব্যক্তি। ওই রাজকুমারদের শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলার জন্য তাদের নয়টি রুমাল দেয়া হয়েছিল।

“ভাই মুরাত এবং মেহমেতের ভাইদের ছোট কবরগুলো দেখলে ধারণা পাওয়া যায়, একজন নতুন সুলতান সিংহাসনে আরোহণের পরে তখন সাম্রাজ্যে ক্ষমতার বিশৃঙ্খলা এড়াতে কী চরম মূল্য দিতে হয়েছে।”

সাম্রাজ্য দখলের লড়াই।
সাম্রাজ্য দখলের লড়াই।

প্রেক্ষাপট কী ছিল?

বহু রাজপুত্র ও রাজকন্যা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যে বিষয়টি লক্ষণীয় ছিল সেটি হচ্ছে – এতো রাজপুত্র ও রাজকন্যা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কোন বিদ্রোহ বা কোন অপরাধের কারণে হয়নি বরং হত্যার শিকার উত্তরসূরীদের মধ্যে এমন অনেকেই ছিলেন যাদের ভুল করার বয়সও হয়নি।

যে আইন বা ঐতিহ্যের অধীনে এই রাজপুত্র এবং রাজকুমারীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল তা ১৫ শতকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত ১৪৮১ সালে তার মৃত্যুর কয়েক বছর আগে একটি নির্দেশ জারি করেছিলেন। সেই নির্দেশ অনুসারে নতুন সুলতান তার ভাই বোনদের হত্যা করতে পারতেন।

মি. ফিঙ্কেল লিখেছেন, সুলতান মেহমেত (দ্বিতীয়) তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করেননি। তবে নিজের মৃত্যুর কয়েক বছর আগে উত্তরাধিকার সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশ করেছিলেন।

তিনি তার বক্তব্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তার ভাইদের হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন। তার যে ছেলে সুলতান হবে, তার বাকি ভাই বোনদের মেরে ফেলা উচিত হবে। এটি বিশ্বের জন্য ভালো হবে।

তুরস্কের ইতিহাস ও আইনের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আকরাম বোরা আকাঞ্জে এই ঐতিহ্য সম্পর্কে একটি নিবন্ধ লিখেছেন যে, সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত তৎকালীন প্রচলিত আইন সংস্কারের জন্য নতুন এই আইন প্রণয়ন করেছিলেন এবং সুলতানের মতে, ‘ অধিকাংশ আলেম এর পক্ষে ছিলেন।

ড. আকরামের এই লেখাটি তুরস্কের সংবাদপত্র “রোজনামা সাবাহ” এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।

“প্রকৃতপক্ষে, ভ্রাতৃ হত্যার আইন অটোমান ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়গুলির মধ্যে একটি ছিল,” ড. আকাঞ্জে লিখেছেন।

তখন শুধু ভুল বোঝাবুঝি থেকেও অনেক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। তিনি আরও লিখেছেন যে, কোন রাজপুত্র কোন ভুল করেছেন বলেই তাকে হত্যা করা হতো এমন কোন আবশ্যকতা ছিল না।

অনেক সময় তাদেরকে হত্যা করার বিষয়টিকে ন্যায্য দেখানোর জন্য তারা শুধু একটি বিপদের অনুমান করতেন। সেটি হচ্ছে, রাজকুমার/রাজকুমারীরা ভবিষ্যতে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে।

কিন্তু সুলতান দ্বিতীয় মেহমেত কেন এই আইনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন? এটা বোঝার জন্য আমরা একটি ঘটনার সাহায্য নিতে পারি। এজন্য আমাদের উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসের প্রায় ৭০ বছর পিছিয়ে যেতে হবে যখন ১৪০২ সালের জুন মাসে আঙ্কারার কাছে উসমানীয় শাসক সুলতান বায়েজিদ এবং সুলতান তৈমুরের (তিমুর লিং) মধ্যে একটি বড় যুদ্ধ হয়েছিল।

ইস্তাম্বুলের সামরিক জাদুঘরে সুলতান মুরাদ, সুলতান বায়েজিদ এবং সুলতান মেহমেতের প্রতিকৃতি
ইস্তাম্বুলের সামরিক জাদুঘরে সুলতান মুরাদ, সুলতান বায়েজিদ এবং সুলতান মেহমেতের প্রতিকৃতি

তৈমুর এবং অটোমান সাম্রাজ্য

ক্যারোলিন ফিঙ্কেল লিখেছেন, তিমুর লিং তার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ৩০ বছর পরে যুদ্ধের বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা শুরু করেন। এই সময় তিনি চীন এবং ইরান হয়ে আনাতোলিয়ায় অটোমান সুলতানদের অঞ্চলে এসে পৌঁছান।

ক্যারোলিন ফিঙ্কেল বলেছেন যে তৈমুর লিং নিজেকে চেঙ্গিস খানের উত্তরসূরি হিসাবে বিবেচনা করতেন। আনাতোলিয়ান সেলজুক মঙ্গোল অঞ্চল নিজের দখলে নেয়ার উপর ভিত্তি করে তিনি এই দাবি করতেন।

তিনি আনাতোলিয়ার বিভিন্ন রাজ্যের (যেগুলো তখনো অটোমান সুলতানদের প্রভাবে আসেনি) মধ্যে মতভেদ কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উসমানীয় সুলতান বায়েজিদেরও নজর ছিল রাজ্যগুলোর ওপর।

ফিঙ্কেল বলেছেন যে, এর ফলে ১৪০২ সালের ২৮শে জুন, তৈমুর লিং এবং বায়েজিদের বাহিনী আঙ্কারার কাছে মুখোমুখি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। এই যুদ্ধে সুলতান বায়েজিদ পরাজিত হন এবং এরপর বেশিদিন তিনি বাঁচতে পারেননি। তিনি কিভাবে মারা গিয়েছেন? ফিঙ্কেল বলেছেন, বিভিন্ন কারণে হতে পারে।

কিন্তু এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে অটোমান সাম্রাজ্য একটি কঠিন সময়ে প্রবেশ করেছিল। পরবর্তী ২০ বছর ধরে গৃহযুদ্ধের কারণে অটোমান সাম্রাজ্যকে ভয়াবহ ধ্বংসের সম্মুখীন হতে হয়েছে।

ড. আকাঞ্জের ভাষ্য মতে বায়েজিদের চার ছেলের হাজার-হাজার সমর্থক ছিল কিন্তু তারা বছরের পর বছর পরস্পরের সাথে যুদ্ধ লিপ্ত ছিল।

গৃহযুদ্ধ শেষে সুলতানের কনিষ্ঠ পুত্র মেহমেত (প্রথম) তার ভাইদের পরাজিত করেন এবং ১৪১৩ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের একমাত্র উত্তরাধিকারী হন।

সুলতান মেহমেত প্রথম অটোমান সাম্রাজ্যকে পুনরুদ্ধার করার জন্য বহু বছর ধরে সংগ্রাম করেছিলেন। যখন এই সাম্রাজ্য তার পিতা সুলতান বায়েজিদের অধীনে ছিল।

এর মধ্যে নতুন সুলতান এবং তৈমুর লিং-এর ছেলে শাহরুখের (যিনি মারা গিয়েছিলেন) চিঠির মাধ্যমে এক দারুণ যোগাযোগ তৈরি হয়।

ক্যারোলিন ফিঙ্কেল লিখেছেন, ১৪১৬ সালে শাহরুখ তার ভাইদের হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে সুলতান মেহমেত প্রথমকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। অটোমান সুলতানের উত্তর ছিল ‘দুই রাজা এক দেশে থাকতে পারে না’। আমাদের চারপাশের শত্রুরা সবসময় সুযোগের সন্ধানে থাকে।

এখানে লক্ষণীয় যে সুলতান বায়েজিদ নিজেই তার ভাইকে ‘হত্যা’ করে সিংহাসনে বসেছিলেন। ১৩৮৯ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের তৃতীয় সুলতান মুরাত প্রথম সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মারা যান। এই সুযোগে যুবরাজ বায়েজিদ তার ভাইকে হত্যা করে রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করেন।

ফিঙ্কেল লিখেছেন যে, প্রিন্স বায়েজিদ তার ভাই প্রিন্স ইয়াকুবকে হত্যা করেছিলেন “এটি অটোমান রাজবংশের প্রথম কোনও ভাইকে হত্যার ঘটনা যা নথিভুক্ত হয়েছে।”

তবে তিনি আরও লিখেছেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে তার বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়ার সাথে সাথে তিনি ভাইকে হত্যা করেছেন নাকি কয়েক মাস পরে তিনি এই হত্যা করেছেন তা স্পষ্ট নয়। যাই হোক, অটোমানরা যুদ্ধে জয়লাভ করে এবং সার্বিয়া তাদের রাষ্ট্রের অংশে পরিণত হয়।

অটোমান সাম্রাজ্যের সময় রাজকীয় প্রাসাদের হারেমের একটি দৃশ্য
অটোমান সাম্রাজ্যের সময় রাজকীয় প্রাসাদের একটি অংশ

তুর্কি উত্তরাধিকারের নিয়ম

জেসন গুডউইন তুর্কিদের মধ্যে উত্তরাধিকারের ঐতিহ্য সম্পর্কে তার ‘মাস্টারস অফ দ্য ওয়েস্ট অ্যান্ড দ্য ইস্ট’ বইতে উল্লেখ করেছেন যে শুরুতে অটোমান সাম্রাজ্যে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টন নিয়ে সমস্যা ছিল।

কারণ সেই ক্ষমতা দখলের দৌড়ে রাজার ভাই, চাচা, চাচাতো ভাই, এবং কখনও কখনও নারী আত্মীয়রাও কিছুটা অংশীদার ছিল। এই পরিস্থিতি বিশ্বের অন্য রাজ্যগুলোর থেকে ভিন্ন ছিল। অন্য রাজ্যগুলোয় শুধুমাত্র বড় ছেলের ক্ষমতায় বসার অধিকার ছিল।

লেসলি পিয়ার্স লিখেছেন, অটোমান সুলতানরা শতাব্দী ধরে একটি ঐতিহ্যও পরিবর্তন করতে পারেনি।

“অটোমান রাজবংশ কখনই তার শাসনের নীতিকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করতে পারেনি,। ওই নীতি অনুসারে প্রত্যেক রাজপুত্র সিংহাসনে বসার যোগ্য ছিল, তা বাস্তবে যত অসম্ভবই হোক না কেন,” লিখেছেন লেসলি পিয়ার্স।

“সুলতান মুরাত এবং তার পুত্র মেহমেত দ্বারা নিজ ভাইদের হত্যার ঘটনা প্রমাণ করে যে তুর্কিয়েদের এই নীতি ইউরোপীয় আইনের বিকল্প হতে পারেনি। ইউরোপীয় আইনের অধীনে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার সম্পূর্ণভাবে বড় ছেলের কাছে হস্তান্তর করা হয়। যেখানে ছোট ভাই বড় ভাইয়ের জন্য হুমকি হয় না।”

প্রতিটি ছেলে তার পরিবারের উত্তরাধিকারী হয়। এই পরিস্থিতিতে সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বা ষড়যন্ত্র করার জন্য কোনও ভাইয়ের প্রয়োজন ছিল না। তবে সাম্রাজ্যের শক্তিশালী চক্রগুলি সুলতানের উপর অসন্তুষ্ট হলে তারা অন্য যুবরাজকে সুলতান হিসাবে বসানোর চেষ্টা করতেন।

ড. আকরাম আকঞ্জে তার প্রবন্ধে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রদূত ওগিয়ের গুসলিন ডি বিসবেকের মতামত উল্লেখ করেছেন, যিনি সুলতান সুলেমান প্রথমের শাসনামলে সেখানে ছিলেন।

“একজন অটোমান সুলতানের ছেলে হওয়া সৌভাগ্যের বিষয় নয়। কারণ তাদের একজন যখন সুলতান হয়, তখন বাকিদের জন্য মৃত্যু অপেক্ষা করে,” লিখেছেন ড. আকঞ্জে।

কেননা সুলতানের যদি আরও কোন ভাই বেঁচে থাকে তাহলে ক্ষমতাসীন সুলতানের ওপর সেনাবাহিনীর নানারকম দাবির চাপ থাকতো।

এবং সুলতান তাদের কথা না শুনলে সেনারা বলতেন, “ঈশ্বর আপনার ভাইকে আশীর্বাদ করুন” অর্থাৎ ঈশ্বর চাইলে তার স্থলে তার ভাইকে সিংহাসনে বসাতে পারতেন।

এর মাধ্যমে সেনাবাহিনী ক্ষমতাসীন সুলতানের প্রতি তাদের অসন্তোষ এবং ওপর ভাইয়ের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সুযোগ পেতো।

ইস্তাম্বুলের নীল মসজিদ প্রথম সুলতান আহমেদ নির্মাণ করেছিলেন।
ইস্তাম্বুলের নীল মসজিদ প্রথম সুলতান আহমেদ নির্মাণ করেছিলেন।

ভাই হত্যার প্রথার অবসান

লেসলি পিয়ার্স-এর মতে – রাজপরিবারে ভাইদের হত্যার প্রথা অপ্রিয় হয়ে উঠছিল।

“প্রাথমিকভাবে এই ঐতিহ্যকে ক্ষমতার ঐক্য বজায় রাখার জন্য সহ্য করা হয়েছিল যাতে শাসক কোন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হয়।”

তিনি আরও লিখেছেন, শুরুতে যখন অটোমান বা উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রসার ঘটছিল এবং সুলতান নিজেই রাজধানী থেকে দূরে দীর্ঘ অভিযান চালিয়েছিলেন, তখন ঐতিহ্যটি হয়তো মানুষের কাছে ঠিকই মনে হয়েছিল।

কিন্তু ‘সুলতান সুলেমানের রাজত্বের পরে অল্প বয়সী রাজকুমার এবং যেসব শিশু তখনও মায়ের গর্ভে ছিল, তাদেরকে এই ঐতিহ্যের অধীনে রাখা হতো, প্রায়শই সুলতানদের রক্ষা করার জন্য তারা খুব কমই রাজধানী ছেড়ে যেতেন। ১৫৭৪ সাল পর্যন্ত ইস্তাম্বুলের মানুষ তাদের সামনে রাজকুমারদের মৃত্যুর এই নাটক আর দেখেনি।

ইতিহাসবিদ লেসলি পিয়ার্স লিখেছেন, ‘একজন সুলতান সিংহাসনে আরোহনের পর তার সব ভাইদের একসঙ্গে ফাঁসি দেওয়া এবং প্রাসাদ থেকে তাদের লাশের মিছিল করা, যার মধ্যে কয়েকজন রাজকুমার রীতিমতো শিশু ছিলেন, এই বিষয়গুলো সাধারণ মানুষকে ভাবতে বাধ্য করে যে ভাই হত্যার এই নিয়ম পুরানো দিনের জন্য প্রযোজ্য ছিল।’

তিনি তার বইয়ে ভাই হত্যার প্রথার কথা উল্লেখ করেছেন এবং এর নির্মূলের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

সুলতান মেহমেতের (তৃতীয়) পরে সিংহাসনে আরোহণ করেন সুলতান আহমেদ (প্রথম), কিন্তু চাপ থাকা সত্ত্বেও সুলতান আহমেদ তার ভাইকে হত্যা করেননি, তবে এই ঐতিহ্য তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুলতান আহমেত (প্রথম) এর সাত পুত্রের মধ্যে চারজনকে সুলতান ওসমান (দ্বিতীয়) এবং সুলতান মুরাত-এর (চতুর্থ) আদেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যিনি সিংহাসনে বসেছিলেন।

ড. আকরাম আকঞ্জে লিখেছেন, যখন সুলতান আহমেত প্রথম মারা যান, তার ছেলেরা উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তার ভাই সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই প্রথম কোন সুলতানের মৃত্যুর পর তার ভাই তার স্থলাভিষিক্ত হন।

বিবিসি উর্দু, লন্ডন

পূর্বের খবরমোহাম্মদপুরে কাদের সিদ্দিকীকে ১০০১ টাকায় বাড়ি বরাদ্দ
পরবর্তি খবরধরাছোঁয়ার বাইরে তাঁরাঃ অর্থমন্ত্রী অনিয়মিত, দেখা দেন না গভর্নর, অর্থসচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান