হাঁকডাকেই সীমাবদ্ধ নির্বাচন কমিশনের

147
ঢাকাঃ আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ ১৫টি দল বর্জন করলেও প্রতি আসনে গড়ে লড়াই করছেন ৬ জন করে প্রার্থী। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে একই দলের নৌকা প্রতীক বঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থীর। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক স্থানেই হুমকি-ধমকি ছাড়িয়ে সংঘাতে পর্যন্ত রূপ নিয়েছে। ভোটগ্রহণের সুষ্ঠু পরিবেশের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হাঁকডাকেও থেমে নেই পেশিশক্তি প্রদর্শন ও সংঘাত। এসব কাণ্ডে শুধু শোকজ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ইসির কার্যক্রম।
Image not found

নির্বাচন কমিশনের সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ২১৭ প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ, তদন্ত ও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইসির সংশ্লিষ্ট শাখার এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে জানান, বাস্তবে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি। সব জেলার তথ্য পাঠানো হয়নি। এখনো অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, সে তথ্য ইসিতে পাঠানো হয়নি। সব মিলিয়ে হাজারের বেশি প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে, জানান তিনি।প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে বিভিন্ন জেলায় সফর করছেন; সুষ্ঠু ভোটগ্রহণ, আচরণবিধি লঙ্ঘনে শাস্তির হুশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। বাস্তবে এর ফল মিলছে না।

উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটগ্রহণে সব প্রার্থীর সহযোগিতা চেয়েছেন সিইসি কাজী হাবীবুল আউয়াল। গতকাল রবিবার সকালে ময়মনসিংহ জেলা পরিষদ মিলনায়তনে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, প্রার্থীদের আন্তরিক সহযোগিতা ছাড়া সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণ সম্ভব নয়। তারা আচরণবিধি না মানলে নির্বাচন ভ-ুল হয়ে যেতে পারে।

অপরদিকে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানা স্থানে সহিংসতার মধ্যেই নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, প্রচারকে ঘিরে ‘ছোটখাটো’ কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সব নির্বাচনে ‘এ ধরনের ঘটনা’ ঘটে থাকে। গতকাল সোমবার নিজ কার্যালয়ে বসে তিনি বলেন, বিভাগীয়, জেলা সফরে বলা হয়েছে- পুলিশ ও প্রশাসনকে কঠিন থাকতে হবে। প্রার্থীদের আচরণবিধি লঙ্ঘনের মাত্রা দেখে শাস্তি নির্ধারণের কথা জানিয়ে মো. আলমগীর বলেন, ছোট আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য বড় শাস্তি দেওয়া যাবে না, আবার বড় আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য ছোট শাস্তি দেওয়া যাবে না। এটা যথাযথ হতে হবে।

আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হবে। গত ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া, ভাঙচুর এমনকি মারধরের ঘটনাও ঘটছে। মাদারীপুরে ভোটের প্রচারকালে হামলার কারণে স্বতন্ত্র এক প্রার্থীর কর্মীর মৃত্যুও হয়েছে। এসব সহিংসতার ঘটনায় শুধু শোকজে সীমাবদ্ধ ইসি। আচরণবিধি লঙ্ঘনে প্রার্থিতা বাতিলের মতো কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে যাচ্ছে বলে গত শনিবার সাংবাদিকদের বলেছিলেন নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান। তবে এ পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। জানা গেছে, এতসব অভিযোগের বিপরীতে ইসি গতকাল শুধু একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করার নির্দেশ দিয়েছে। অন্যসব ক্ষেত্রে তলব ও শোকজের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে ইসি।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী, নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে। কমিশন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা দলকে ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা জরিমানা করতে পারে বা প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে।

অন্যদিকে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে কেউ নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদ- বা সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং রাজনৈতিক দল কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করার বিধান আছে। মূলত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এটি করে থাকেন।

কুমিল্লা-৬ আসনে নৌকার প্রার্থী সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের নির্দেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনা তদন্ত করে কুমিল্লার ডিসি ও পুলিশ সুপার কী জানিয়েছেন- এ প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, প্রতিবেদন এলে দেখা যাবে। অনুসন্ধান কমিটি তাকে তিনবার শোকজ দিয়েছে। কী ঘটেছিল সেসব প্রতিবেদনে উঠে আসবে।

গত ১৮ ডিসেম্বর প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর সিইসিসহ অন্য সব নির্বাচন কমিশনার জেলায় জেলায় সফর করে প্রার্থী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় সভা করছেন। প্রার্থীদের বলছেন, আচরণবিধি প্রতিপালন এবং এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তদারকি করতে। কিন্তু এতে কর্ণপাত নেই প্রার্থীদের।

একাত্তর টেলিভিশনের কুমিল্লা প্রতিবেদক ও ক্যামেরা পারসনের ওপর হামলার ঘটনায় কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। এ নিয়ে তাকে তিনবার নোটিশ দেওয়া হলো। ইসিও প্রতিবেদন চেয়েছে। তবে এখনো কোনো শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। চাঁদপুর-২ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে দ্বিতীয়বারের মতো শোকজ করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি।

লালমনিরহাট-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী আতাউর রহমান প্রধানের গণসংযোগে হামলা, গাড়ি ও ক্যাম্প ভাঙচুরের অভিযোগে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান এমপি মোতাহার হোসেনের ব্যক্তিগত সহকারী আবু বক্কর সিদ্দিক শ্যামলকে কারণ দর্শাতে বলেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি।

নির্বাচনী জনসভায় নাসিরনগর উপজেলার কু-া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিনের নাম মুছে ফেলার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে তলব করেছে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি। এছাড়া ঝালকাঠি-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আমির হোসেন আমুকে তলব করেছিল ইসি।

উল্লেখিত ঘটনায় কেউকে শাস্তি দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। এছাড়া বেশ কয়েক জায়গায় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে, যা তদন্তাধীন।

তফসিল ঘোষণার পর থেকেই সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের বিষয়ে কঠোর হওয়ার হুশিয়ারি উচ্চারণ করে আসছে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। প্রশাসন ও পুলিশের বেশ কিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বদলিও করা হয়েছে। আচরণবিধি প্রতিপালনে যথাযথ দায়িত্ব পালনে নির্লিপ্ততায় দুই থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এসব ভোটের মাঠে কতটা প্রভাব ফেলবে, সেটা দেখার বিষয়।

জানা গেছে, নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলা হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য প্রায় ৮০০ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে আছেন। এছাড়া ভোটপূর্ব অনিয়ম প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার জন্য জুডিশিয়াল (বিচারিক) ম্যাজিস্ট্রেটদের সমন্বয়ে প্রতিটি আসনে একটি করে নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি রয়েছে। তারাও আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে। তবে তারা নিজেরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিটিগুলো ইসিকে সুপারিশ করতে পারে।

ইসি সূত্র জানিয়েছে, অনুসন্ধান কমিটিগুলো কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রার্থীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে বরগুনা-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ধীরেন্দ্র দেবনাথের (শম্ভু) বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়ে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে অভিযোগ দায়ের করার জন্য সুপারিশ করেছে অনুসন্ধান কমিটি। পাবনা-৩ আসনে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতার বিরুদ্ধে, গাজীপুর-৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মেহের আফরোজের একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী মাজেদুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা করার সুপারিশ করেছে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী অনুসন্ধান কমিটি।

এছাড়া মাঠে থাকা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা কিছু ক্ষেত্রে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় জরিমানা করেছেন। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে লক্ষ্মীপুরে তিনটি নির্বাচনী আসনে ৪ প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের মোট ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এর আগে কুষ্টিয়া-৪ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় নৌকার এক কর্মীকে এক দিনের কারাদণ্ড দিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

ইসি লোক দেখানো কথা আগেও বলেছে : ড. ইফতেখারুজ্জামান

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমাদের সময়কে বলেন, ইসি লোক দেখানো কথা আগেও বলেছে। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপের প্রতিফলন আমরা দেখতে পাইনি। আচরণবিধি প্রতিপালনসহ বর্তমান প্রেক্ষাপটেও তারা কতটুকু সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে পারবে, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান শুধু ইসির ওপর নির্ভর করে না। এর জন্য নির্বাচনকালীন সরকার, প্রশাসনসহ অন্য সংস্থারও ভূমিকা রয়েছে। তারা দলীয় সরকারের সমর্থনের ঊর্ধ্বে গিয়ে কতটুকু দায়িত্ব পালন করতে পারবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

পূর্বের খবরআওয়ামী লীগ কি আন্তর্জাতিক স্তরে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে অস্বস্তিতে?
পরবর্তি খবরএ বছরের পাঠ্যপুস্তক নিম্নমানের নিউজপ্রিন্টে ছাপা হচ্ছে!