‘সরকার পুলিশ প্রশাসন গণমাধ্যম সবই নিয়ন্ত্রণ করছে’ বর্তমান সরকারকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকার পুলিশ, প্রশাসন, গণমাধ্যম সবই নিয়ন্ত্রণ করছে। এক সেমিনারে সভাপতির বক্তৃতায তিনি এসব কথা বলেন। ‘বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যম ও দুঃশাসনের দেড় দশক’ শীর্ষক এই সেমিনারের আয়োজন করে বিএনপি।
নিউজ ডেস্কঃ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘অবৈধ সরকার আমাদের সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছে। ফ্যাসিবাদের অন্যতম প্রধান অস্ত্র হচ্ছে গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করা, সরকার সেই কাজ করে আসছে। আমাদের গণতান্ত্রিক ন্যূনতম অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। আজ যারা ক্ষমতায় বসে আছে, তারা নিজেদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করা ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে তারা সংবিধান পরিবর্তন করেছে, সংসদকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, নির্বাচন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে, প্রশাসন এবং পুরো গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তিনি বলেন, তারা যেসব অপকর্ম করে এবং মানুষের অধিকার কেড়ে নেয়, তা লোকচক্ষুর অন্তরালে নিয়ন্ত্রণ করার প্রয়োজন হয়। সেজন্য আওয়ামী লীগ গত দেড় দশক ধরে সুকৌশলে সেটা করে আসছে। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম: দুঃশাসনের দেড় যুগ’ শীর্ষক বিএনপি আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। সেমিনারে ‘বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম: দুঃশাসনের দেড় যুগ’ নামে একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ। এতে বলা হয়েছে, দমনপীড়নমূলক কালাকানুন তৈরি করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে এই সরকার।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের পর সরকারবিরোধী পোস্টে লাইক, কমেন্ট বা শেয়ার দিলেও আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতিতে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। ভয়ের সংস্কৃতি চালুর পর সংবাদপত্রে এখন রাজনৈতিক কার্টুন দেখা যায় না। সরকারের সমালোচকদের কণ্ঠরোধ করতে বরেণ্য সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গত দেড় দশকে বর্তমান সরকারের সময়ের ৮টি আইনের কথা উল্লেখ করে সেগুলোকে গণমাধ্যমবিরোধী ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হরণমূলক বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি।
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বর্তমান সরকার জোর করে চিরদিন ক্ষমতায় থাকতে সংবিধান সংশোধন করেছে। পুলিশ, প্রশাসন, গণমাধ্যম সবই নিয়ন্ত্রণ করছে। পুরো সমাজকে তারা নষ্ট সমাজে পরিণত করেছে।’
তিনি বলেন, বর্তমানে কর্পোরেট গণমাধ্যম তৈরি করা হয়েছে। বড় বড় কোম্পানিগুলো টেলিভিশন চ্যানেল, সংবাদপত্রের মালিক। তারা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেউ কিন্তু টাকা পাচারের বিরুদ্ধে কথা বলে না। আসলে গণতন্ত্র ছাড়া মুক্ত গণমাধ্যম সম্ভব নয়। আজকে ৫২ বছর পরে এসে আমাদের বলতে হচ্ছে যে, এখানে কোনো গণতন্ত্র নেই। গণমাধ্যমের কোনো স্বাধীনতা নেই। মিডিয়াগুলো চাইলেও আসলে কোনো কাজ করতে পারে না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজকে শুধু দেশের মানুষ নয় বিদেশিরাও বলছে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই। তারা সবাই আপনাদের সঙ্গে আছে। অতীতে যেভাবে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছিলাম আবারো শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে এই সরকারকে চলে যেতে বাধ্য করতে হবে। এরপর জনগণের ভোটে একটি দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ফখরুল আরও বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে গিয়ে আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দি রেখেছে। ৬ শতাধিক নেতাকর্মীকে গুম করেছে। সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে খুন করেছে। চল্লিশ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মিথ্যা মামলা দিয়েছে। সুতরাং এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে হলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। ‘একদফা’র আন্দোলনে শুধু রাজনৈতিক দল নয়, সকল পেশার মানুষকে ‘রাস্তায় নেমে সোচ্চার হওয়া’র আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
খালেদা জিয়ার চিকিৎসা প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, যিনি সারাটা জীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, এখনো করছেন এই অসুস্থ অবস্থায়। এখনো এভারকেয়ার হাসপাতালে তাকে জীবন-মরণ লড়াই করতে হচ্ছে। সেই নেত্রীকে মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করে রেখেছে। আজকে তাকে চিকিৎসার সুযোগ পর্যন্ত দিচ্ছে না। আমরা বার বার বলেছি, তার পরিবার থেকে বলা হয়েছে যে, তাকে বিদেশে চিকিৎসা করার সুযোগ দেয়া হোক। সরকার সেটুকু দিচ্ছে না। এই যে অমানবিক, ভয়াবহ, অগণতান্ত্রিক পরিবেশÑ এটা একটি সর্বগ্রাসী, এটাকে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো জায়গায় দেখাতে পারবেন না।
সেমিনারে বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে মামলা ও হামলার শিকার ব্যক্তিরা। গুম থেকে ফিরে আসা সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল বলেন, যেদেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই সেদেশে স্বাধীনতা শব্দটাই সুদূরপরাহত। আমরা কি আসলে স্বাধীন? আমার পরিবারের ওপরে যে নিপীড়ন করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত যেভাবে ফোন দিয়ে হুমকি দেয়া হয়। প্রতি মুহূর্তে আমার পরিবারের মানুষ ভাবে আমি কি আবার গুম হয়ে যাবো, আমাকে কি আবার তুলে নিয়ে যাওয়া হবে? হতেই পারে। আমি জানি না মৃত্যু কখন কোথায় হবে। নিয়ত পরিষ্কার করেছিÑ আমি সাংবাদিক, সত্য কথা বলে যাবো।
জামালপুরে সন্ত্রাসীদের হাতে মৃত্যুবরণকারী সাংবাদিক গোলাম রাব্বানীর কন্যা রাব্বাতুন জান্নাত বলেন, ‘আমাদের বকশীগঞ্জ উপজেলায় আওয়ামী লীগের কমিটির নেতৃত্ব পেয়েছিল দুইজন রাজাকারের সন্তান। এই নিউজের জের ধরে ১৪ই জুন তাদের নির্দেশে আব্বুকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। আব্বু গুরুতর আহত হয়ে ১৫ই জুন মারা যান। আমার আব্বুর কী দোষ ছিল এই রাজাকারের সন্তানদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য। আমরা তো জানি বাংলাদেশ রাজাকারমুক্ত। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও কেন রাজাকারের সন্তানরা দেশ শাসন করবে? রাজাকারের হাতেই আব্বু খুন হন। রাজাকারের বিরুদ্ধে নিউজ না করলে আমার আব্বু মারা যাইতো না। আমরা কোনো দল করি না। আমরা এখানে এসেছি আব্বুর হত্যার সঠিক বিচার চাইতে।
গণমাধ্যমের পক্ষে বক্তব্য রাখেন বিএফইউজে’র সাবেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, বর্তমান সভাপতি এম আবদুল্লাহ, সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ ও যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক মাহবুব কামাল। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের সভাপতিত্বে ও সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদের সঞ্চালনায় সেমিনারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের সভাপতি নুরুল হক নূর, ইসলামী আন্দোলনের প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ আখন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ, অধ্যাপক শাহিদুজ্জামান, এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির অধ্যাপক এটিএম নুরুল আমিন প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সেমিনারে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, শাহজাহান ওমর, জয়নাল আবেদীন, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা মনিরুল হক চৌধুরী, মিজানুর রহমান মিনু, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, জয়নুল আবদিন ফারুক, তাজমেরী এস এ ইসলাম, সুকোমল বড়ুয়া, আবদুল হালিম, হাবিবুর রহমান হাবিব, তাহসিনা রুশদীর লুনা, সুজা উদ্দিন, একরামুজ্জামান, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, কামরুজ্জামান রতন, অধ্যক্ষ সেলিম ভুঁইয়া, অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, সাইদ সোহরাব, তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন, সাবেক বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ ফয়জী, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) মোস্তফা জামাল হায়দার, আহসান হাবিব লিংকন, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, গণঅধিকার পরিষদের একাংশের রেজা কিবরিয়া, জেএসডির শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের শামসুল আলম, হারুন চৌধুরী, আবুল কালাম আজাদ, বিএলডিপি’র আবদুল করিম আব্বাসী, শাহাদাত হোসেন সেলিম, ন্যাপ ভাসানীর আজহারুল ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মুফতি মহিউদ্দিন ইকরাম, মাইনোরিটি জনতা পার্টির সুকৃতি মন্ডল, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের অধ্যাপক আফম ইউসুফ হায়দার, অধ্যাপক সদরুল আমিন, কাদের গনি চৌধুরী, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের নুরুল আমিন রোকন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের শহীদুল ইসলাম, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ইলিয়াস খান, আমিরুল ইসলাম কাগজী প্রমূখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ডেনমার্কসহ ৭টি দেশের কূটনীতিকরা এই সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন।