ইসরায়েলের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র শুরু থেকে যেভাবে কথা বলে আসছে, তাতে পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে ব্লিঙ্কেনের এই দুঃখ প্রকাশ। এ পরিবর্তনের কারণও আছে। অবরুদ্ধ গাজায় দিন দিন বাড়তে থাকা লাশের সারি, বিশ্বজুড়ে ইসরায়েলের হত্যাযঞ্জের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ এবং হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরে বাড়তে থাকা অসন্তোষ মার্কিন প্রশাসনের ইসরায়েলপন্থী অবস্থানের ওপর বড় চাপ সৃষ্টি করেছে।
গত শুক্রবার ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘অনেক বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। বিগত কয়েক সপ্তাহে অনেক বেশি ফিলিস্তিনি ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। তাঁদের ক্ষয়ক্ষতি রুখতে যা যা সম্ভব তার সবকিছুই করতে চাই। একই সঙ্গে তাঁদের কাছে পৌঁছানো সহায়তার পরিমাণ বাড়াতে চাই। এই লক্ষ্যগুলো সামনের দিকে এগিয়ে নিতে আমরা ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাব।’
মার্কিন কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, গাজায় মানবিক সংকট কাটাতে কাজ করছেন তাঁরা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফলতাও পেয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউস থেকে জানানো হয়েছিল, উত্তর গাজায় প্রতিদিন চার ঘণ্টা করে সামরিক অভিযান বন্ধ রাখতে রাজি হয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। তবে ইসরায়েলের যুদ্ধ পরিকল্পনায় সংশোধন আনতে ওয়াশিংটন যে পরিমাণ চাপ দেবে বলে অনেক মার্কিন কর্মকর্তা প্রত্যাশা করছেন, তা এখনো অর্জিত হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এক বিক্ষোভে ‘বাইডেন আপনি পালাতে পারবেন না, আমরা আপনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলছি’ এবং ‘যুদ্ধবিরতি হবে না তো ভোটও দেব না’ স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
গত ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ১১ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এরপরও উপত্যকাটিতে হামলার তীব্রতা কমাচ্ছে না ইসরায়েলি বাহিনী। গত কয়েক দিনে গাজার বিভিন্ন হাসপাতালেও নিশানা করছে তারা। বাদ পড়ছে না শিশু হাসপাতালও। এরই মধ্যে বৃহস্পতিবার নেতানিয়াহু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, হামাস জিম্মিদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত গাজায় কোনো যুদ্ধবিরতি দেওয়া হবে না। ৭ অক্টোবর হামাস দুই শতাধিক মানুষকে ধরে নিয়ে জিম্মি করেছে বলে দাবি ইসরায়েলের।
জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য বৃহৎ পরিসরে কোনো চুক্তিরও দেখা মিলছে না। জিম্মি মার্কিন নাগরিকদের মুক্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তবে চুক্তি নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। এ নিয়ে জানাশোনা আছে এমন একজন মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, পক্ষগুলো আলাপ–আলোচনার মধ্য দিয়ে একটি চুক্তির দিকে এগোচ্ছে। ওই চুক্তিতে জিম্মিদের বড় অংশের মুক্তির বিনিময়ে দিনব্যাপী ও টেকসই যুদ্ধবিরতির শর্ত থাকতে পারে।
এমন কোনো চুক্তি হলে কয়েক দফায় গাজা থেকে জিম্মিদের মুক্তি দেওয়া হতে পারে। মুক্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেতে পারেন নারী ও শিশুদের মতো ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিরা। তবে এমন চুক্তি নিয়ে আলোচনা যেকোনো সময়ে থেমে যেতে পারে বা আলোচনা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে মনে করেন ওই মার্কিন কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এভাবে আলোচনা আগেও বন্ধ হয়েছে। তাই এ বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যায় না।
এদিকে লন্ডন, ইস্তাম্বুল, নিউইয়র্ক, বাগদাদ ও রোমের মতো বিশ্বের বড় শহরগুলোয় ফিলিস্তিনের সমর্থনে বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশ হচ্ছে। সামনে আরও বিক্ষোভের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব বিক্ষোভ থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হচ্ছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে এক বিক্ষোভে ‘বাইডেন আপনি পালাতে পারবেন না, আমরা আপনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ তুলছি’ এবং ‘যুদ্ধবিরতি হবে না তো ভোটও দেব না’ স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
গত সপ্তাহে ব্যক্তিগতভাবে তহবিল সংগ্রহের এক আয়োজনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে গাজায় যুদ্ধবিরতির ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান এক বিক্ষোভকারী। পরে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে মুখপাত্র জন কিরবি সাংবাদিককের বলেন, ‘সব জায়গায়, এমনকি মার্কিন প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় সরকারের ভেতরেও যে শক্তিশালী আবেগ কাজ করছে, তা প্রেসিডেন্ট বোঝেন। আমরা বিভিন্ন মতে বিশ্বাসী অংশীদার, সংস্থা, বিশেষজ্ঞ ও মানুষের সঙ্গে কাজ করছি। তাদের উদ্বেগগুলো জানছি। নিশ্চিত করছি, তাদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই যেন আমরা নীতিতে পরিবর্তন আনতে পারি।’
গাজায় ইসরায়েলের হামলার জেরে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের সম্ভাব্য টানাপোড়েন নিয়েও ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র। সিএনএনের হাতে আসা একটি কূটনৈতিক তারবার্তা অনুযায়ী, আরব বিশ্বে অবস্থান করা মার্কিন কূটনীতিকেরা বাইডেন প্রশাসনকে সতর্ক করে বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতি শক্ত সমর্থন দেওয়ায় আরব জনগণের একটি প্রজন্মের কাছে সমর্থন হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
একটি কূটনৈতিক তারবার্তা অনুযায়ী, আরব বিশ্বে অবস্থান করা মার্কিন কূটনীতিকেরা বাইডেন প্রশাসনকে সতর্ক করে বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের প্রতি শক্ত সমর্থন দেওয়ায় আরব জনগণের একটি প্রজন্মের কাছে সমর্থন হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
এদিকে ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ও বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে ইরানপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। ১৭ অক্টোবর থেকে ইরাক ও সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্র জোটের ঘাঁটিগুলোয় অন্তত ৪০ বার হামলা হয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন মার্কিন সেনা আহত হয়েছেন। দুবার পাল্টা হামলা চালিয়েও এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দমাতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের একজন কর্মকর্তা সিএনএনকে জানিয়েছেন, বুধবার পূর্ব সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালানোর পরও মার্কিন সেনারা অন্তত চারবার হামলার শিকার হয়েছেন।
নয়াদিল্লিতে শুক্রবার ব্লিঙ্কেন আবারও বলেন, হামাসের হাতে জিম্মি মার্কিন নাগরিকদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন তাঁরা। একই সঙ্গে গাজার সংঘাত যেন মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে না পড়ে, সে চেষ্টাও করবেন। তিনি বলেন, তেল আবিবে নেতানিয়াহু ও অন্যান্য ইসরায়েলি কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর এসব কাজে ‘কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে’।
তবে গাজায় নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেও এখনো ব্লিঙ্কেন ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য কর্মকর্তার কথাবার্তায় এটা পরিষ্কার যে তাঁরা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষেই সাফাই গাইছেন। এমনকি যুদ্ধবিরতি নিয়ে কোনো কথা তুলছেন না। মার্কিন প্রশাসন এটা বলেই দিয়েছে যে গাজায় ইসরায়েলের অভিযান যখন পরবর্তী ধাপে প্রবেশ করেছে, তখন এই মুহূর্তে যুদ্ধ থামানো সম্ভব নয়।
যেমন দেশি–বিদেশি চাপ থাকা সত্ত্বেও বুধবার বিঙ্কেন নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছেন, যাঁরা দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছেন, তাঁদের এটা ব্যাখ্যা করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, যুদ্ধবিরতি যে অগ্রহণযোগ্য পরিণতি বয়ে আনবে, তা কীভাবে সমাধান হবে।
সিএনএন