তিনি বলেন, ‘‘সংবিধান অনুযায়ী এছাড়া আমাদের আর কিছু করার নেই৷ এখন আর কোনো সংলাপ বা আলোচনা নয়, রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি আমরা৷”
তিনি জানান, বুধবার বিকেলে কমিশনের বৈঠকের আগেই সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন কমিশন সচিব৷ সেই ব্রিফিং-এ নির্বাচনের তফসিলের ব্যাপরে বিস্তারিত জানানো হবে৷
মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশন সচিব জাহাংগীর আলম জানান, কখন কীভাবে তফসিল ঘেষণা হবে তা বুধবার সকাল ১০টায় সাংবাদিকদের জানানো হবে৷
এদিকে শর্তহীন সংলাপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর তিন প্রধান রাজনৈতিক দলকে দেয়া চিঠির ব্যাপারে কমিশন অবহিত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘নির্বাচনের তফসিলে এর কোনো প্রভাব পড়বে না৷”
জানা গেছে, বুধবারের বৈঠকের পর রাতেই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে পারেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিুবল আউয়াল৷ ওই ভাষণে তিনি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবেন বলে জানা গেছে৷ নির্বাচন হতে পারে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে৷
এদিকে, মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মঙ্গলবার এক ভার্চুয়াল উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘‘হয়তো দুই-একদিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে৷”
সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু শাসক দল আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে শর্তহীন সংলাপের জন্য চিঠি দেন৷
নির্বাচন কমিশন এমন এক সময় নির্বাচনের জন্য তফসিল ঘোষণা করতে যাচ্ছে যখন বিএনপির নেতৃত্বে ৩৭টি রাজনৈতিক দল সরকার বিরোধী আন্দোলনে আছে৷ তারা সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চাচ্ছে৷
তারা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবে না৷ এর বাইরে জামায়াতে ইসলামীসহ আরো কয়েকটি দল একই দাবিতে আন্দোলনে আছে৷ তারা এখন হরতাল ও অবরোধ করছে৷ তফসিল ঘোষণা হলে তারা আন্দোলন আরও তীব্র করবে৷ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করতে পারে৷
জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, ‘‘ডোনাল্ড লু তিন বড় রজনৈতিক দলকে শর্তহীন সংলাপের চিঠি দেয়ার পরইদিনই আমরা দেখলাম প্রধানমন্ত্রী তার উদ্বোধনী কাজের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন৷ তফসিল ঘোষণার পর প্রধানমন্ত্রী নিয়মতান্ত্রিক প্রধানমন্ত্রী থাকবেন৷ তাই তফসিল আর উদ্বোধন একসঙ্গে চলতে পারে না৷ আমার মনে হয় ডোনাল্ড লুর চিঠি তফসিলকে ত্বরান্বিত করছে৷”
‘‘শাসক দল আর কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না৷ নির্বাচন কমিশনও তফসিলের ইঙ্গিত দিয়েছে,” বলেন তিনি৷
তার কথা, ‘‘তফসিল ঘোষণার পর থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন কমিশন ঘেরাওয়ের কর্মসূচি পালন করবে বলে জানিয়েছে৷ তারা হরতাল অবরোধের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনে যাবে৷ ফলে পরিস্থিতি পয়েন্ট অব নো রিটার্নের দিকে চলে গেল৷”
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে ডেনাল্ড লুর পত্রবাণের পর অগ্নিবাণ আসতে পারে৷”
এদিকে সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম মনে করেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন এক-দুই দিনের মধ্যে নির্বাচনের তফসিল হবে সেটা নির্বাচন কমিশনকে ডিকটেট করার মতো৷ তফসিল কবে হবে এটা নিয়ে তিনি কেন, রাষ্ট্রপতিও কথা বলতে পারেন না৷ এটা বলে তিনি ঠিক করেননি৷”
তার কথা, ‘‘নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই৷ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করছে৷ তবে তাদের হাতে আরো সময় আছে৷ আরো একটু সময় নিতে পারতো পরিস্থিতি বিবেচনা করে৷ জানুয়ারির ২০ তারিখে নির্বাচন করা যায়৷ আর তাতে ২৫ নভেম্বরেও তফসিল ঘোষণা করা যেত৷ তবে এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই৷ জরুরি পরিস্থিতি হলে আরো তিন মাস সময় পাবে৷ সেটা সেই পরিস্থিতি হতে হবে৷ তখন নির্বাচন কমিশন একা পারবে না৷ সরকারকে লাগবে৷”
তার কথা, ‘‘আজকালের মধ্যে যে তফসিল ঘোষণার কথা বলা হচ্ছে এটা অবাক করা কাণ্ড৷ এটা প্রধানমন্ত্রীর ডিকটেশনে হচ্ছে বলে আমার মনে হয়৷ আরেকটু সময় নেয়া যেত, পরিস্থিতি বিবেচনায়৷”
তিনি মনে করেন,‘‘এখন যে পরিস্থিতিতে তফসিল ঘোষণা করা হচ্ছে তাতে এটা যদি আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করে যদি পরিস্থিতি আরও সহিংস হয় তাহলে সেটা গণতন্ত্রের জন্য কল্যাণকর হবে না৷ এটা গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন না হয়ে ক্ষমতার বাহন হয়ে যাচ্ছে নির্বাচন৷”
নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান বলেন, ‘‘আমাদের বিবেচনায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক আছে৷ বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটছে সেগুলো রাজনৈতিক৷ সেগুলো নিয়ে আমাদের কিছু করার নেই৷ সংবিধান অনুযায়ী আমাদের সামনে বিকল্প কিছু নাই৷ আমরা রোড ম্যাপ ধরে নির্বাচনের দিকে যাচ্ছি৷”
তার কথা, ‘‘নির্বাচনের জন্য আমরা সার্বিকভাবে প্রস্তুত৷ তফসিলের আগের যে কাজ ছিলো তা শেষ হয়েছে৷ এখন তফসিল ঘোষণার পর যা কাজ তাও সম্পন্ন হবে৷”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘আমরা আর কোনো সংলাপ করব না৷ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আমাদের আর কোনো আলোচনার সুযোগ নেই৷ আমাদের সামনে এখন শুধুই নির্বাচন৷”
নির্বাচনের তফসিলে তারিখ ছাড়াও যা যা থাকে
তফসিলের মাধ্যমে জানা যাবে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঠিক কবে অনুষ্ঠিত হবে। রেওয়াজ অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণের দিনের মধ্যে ৪০ থেকে ৪৫ দিনের পার্থক্য থাকে।
বুধবার তফসিল ঘোষণা করা হলে আর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হলে প্রায় ৫০ দিনের পার্থক্য থাকবে। এর মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণার জন্য তিন থেকে চার সপ্তাহ সময় দেয়া হয়ে থাকে।
কিন্তু তফসিল মানে শুধুই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা নয়। নির্বাচনের সাথে সম্পর্কিত খুঁটিনাটি আরও অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত জড়িত থাকে এই তফসিলের সাথে। কী সেগুলো?
নির্বাচনের তফসিলে কী থাকে?
নির্বাচন আয়োজন করার জন্য যেসব কাজকর্ম জড়িত রয়েছে তার সবকিছুর জন্যে একটি সময় বেঁধে দেয়া হয় তফসিলে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, খুব সহজ ভাষায় এটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখের একটি আইনি ঘোষণা।
যেমন প্রার্থীরা তাদের প্রার্থিতার মনোনয়নের কাগজ কত তারিখ জমা দেয়া শুরু করতে পারবেন সেটি ঘোষণা করা হয়। মনোনয়নের কাগজ নির্বাচন কমিশন কতদিনের মধ্যে বাছাই করবে, বাছাই প্রক্রিয়ায় যদি সেটি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে প্রার্থিতা প্রত্যাশী ব্যক্তি কতদিন পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনে আপিল করতে পারবে তার সময় বেঁধে দেয় কমিশন।
যারা প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পাবেন তাদের তালিকা কবে নাগাদ ছাপানো হবে, নির্বাচনী প্রচারণা কবে থেকে শুরু করা যাবে আর কতদিন পর্যন্ত তা চালানো যাবে – সেটির উল্লেখ থাকে। সাধারণত প্রার্থীর নির্বাচনী প্রতীক ঘোষণার সাথে প্রচারণা শুরুর তারিখ সম্পর্কিত থাকে।
নির্বাচন কত তারিখ হবে, কোন সময়ে শুরু হবে আর কোন সময় পর্যন্ত ভোট গ্রহণ চলবে তার বিস্তারিত এবং ভোটের পর ভোট গণনা কিভাবে এবং কোথায় হবে তারও পরিষ্কার উল্লেখ থাকে। এই পুরো বিষয়টির সমষ্টিকেই নির্বাচনের তফসিল বলা হয়।
এসব সিদ্ধান্ত কারা নেয়?
কিছু বিষয় সংবিধানে একদম নিশ্চিত করে বলা আছে। তাই সেগুলো নিয়ে আদৌ কোন সিদ্ধান্ত নেয়ারই দরকার হয়না। যেমন সংবিধানে বলা আছে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
অর্থ্যাৎ ২৮শে জানুয়ারি সংসদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। কিন্তু এই ৯০ দিনের মধ্যে কবে নির্বাচনের তারিখ সেটি ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। কমিশনারদের মধ্যে সেটি নিয়ে এবং নির্বাচনের তফসিলের অন্যান্য সকল বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর বেশিরভাগ কমিশনার যে সিদ্ধান্ত দেয় সেটি গৃহীত হওয়ার কথা।
নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর কি বদল করা যায়?
নির্বাচন কমিশন চাইলে সংসদ মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ঐ ৯০ দিনের মধ্যে দেয়া নির্বাচনের তারিখ বদলাতে পারে।
যদি সেটি দরকার হয় তাহলে নির্বাচন কমিশনের সেই এখতিয়ার রয়েছে। সেক্ষেত্রে তফসিল সংশোধন করে দেয়া যায়। এর সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য তারিখগুলো পরিবর্তন করে দিতে পারে কমিশন।
ডঃ এম সাখাওয়াত হোসেন একটি নমুনা দিয়ে বলছিলেন, ২০০৮ সালে ডঃ এটিএম শামসুল হুদার নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের ১৮ তারিখ নির্বাচনের তারিখ দিয়েছিলো।
কিন্তু বিএনপি তখনো নির্বাচনে আসবে কিনা সেনিয়ে নানা ধরনের আলোচনা চলছিল। এরপর বিএনপির সাথে আলোচনার পর তাদের দাবির ভিত্তিতে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে ২৯ ডিসেম্বর করা হয়েছিলো।
সেসময় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন বিরোধী রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সংলাপের মাধ্যমে সংকটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনী তফসীল ঘোষণা না করার অনুরোধ জানিয়েছিল।
২০০৬ সালে একবার নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক সংকটের মুখে নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেছিলো। কিন্তু নির্বাচনের তারিখটি রয়ে গিয়েছিলো। সেই তারিখ পরে বাতিল করেছিলো আদালত।
অন্য দেশেও কি একইভাবে তফসিল দেয়া হয়?
সাধারণত বাংলাদেশের তফসিলে যেসব কার্যক্রম দেয়া থাকে তা করার জন্য সবমিলিয়ে পুরো সময়কাল ৪৫ দিন হয়ে থাকে।
সেটাই সাধারণত বাংলাদেশের রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্রিটেনে তফসিলের সময়কাল হল সব মিলিয়ে ১৭ দিন।
সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ১৭ দিনের মধ্যে সেখানে নির্বাচন সহ তার আগের সবকিছু শেষ করতে হবে।
সেখানে আইন করে স্থায়ী একটি তফসিল তৈরি করাই রয়েছে। আর সেখানে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন আয়োজন করে না। সেটি করে থাকে স্থানীয় কাউন্সিল।
ভারতের সংবিধান অনুযায়ী, বিলুপ্ত হওয়া লোকসভা বা বিধানসভার সর্বশেষ অধিবেশন থেকে নতুন সরকার গঠনের মধ্যে সময়সীমা ছয় মাসের বেশি হতে পারবে না। এই সময়সীমার মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।
নির্বাচনী আইন অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পরবর্তী আট দিনের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হয়। এরপর বাছাইয়ের জন্য একদিন বরাদ্দ থাকে। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের জন্য দুইদিন বরাদ্দ থাকে। এরপরে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করা হয়।
নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সাধারণত দুই সপ্তাহ সময়সীমা দেয়া হয়ে থাকে। তবে নির্বাচনের ৪৮ ঘণ্টা আগে প্রচারণা বন্ধ করতে হয়।
পাকিস্তানে নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা, বাছাই, প্রচারণায় সবমিলিয়ে ৫৪ দিনের মতো সময় পাওয়া যায়।
ভারতের মতো এখানেও নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর বাছাই, প্রত্যাহারের সময়সীমা পার হওয়ার পর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হয়।
পাকিস্তানের নিয়ম অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর অন্তত ২২দিন পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।