রাজনৈতিক সহিংসতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখে

195

নিজস্ব প্রতিবেদনঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং নির্বাচনী  সংঘর্ষ  স্থানীয় এবং রাষ্ট্রীয় স্তরের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত করে । অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতোই, বাংলাদেশের রাজনীতি এবং নির্বাচন ‘অর্থ, পেশী এবং মানবশক্তি দ্বারা  প্রভাবিত এবং এর ফলশ্রুতি- দেশের রাজনীতি গভীরভাবে সংঘর্ষপূর্ণ  ও হিংসাত্মক ।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে  শুরু করে  সর্বশেষ ২০১৮ সালের শেষ জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত, বাংলাদেশর রাজনৈতিতে বিভিন্ন ধরনের প্রতিহিংসামুলক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু নির্বাচন বা  রাজনীতির মাঠে নারীদের প্রতি আক্রমনের ধরনটা প্রচলিত রাজনীতিক হিংসার ধরন থেকে থেকে  কিছুটা  আলাদা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রাজনৈতিক হিংসার লক্ষ্য হল নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ বা বাধাগ্রস্থ করা।

এই রাজনৈতিক সহিংসতা নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের উপর নেতিবাচক  ও উদ্দেশ্যমূলক প্রভাব ফেলছে। ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের একটি সমীক্ষা অনুসারে, বাংলাদেশের ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ১,৮৪৮ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র  ৬৯ জন মহিলা ছিলেন।বাংলাদেশে নারীর জন্য রাজনীতি কতটা সহজ? - BBC News বাংলা

কিভাবে রাজনৈতিক সহিংসতা নারীদের প্রভাবিত করে:

বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিভিন্ন ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতা রয়েছে যা নারীরা পুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি সম্মুখীন হয় তার মধ্যে মৌখিক হয়রানি, সাইবার বুলিং, পারিবারিক বাধা এবং শারীরিক হুমকি অন্যতম ।

রাজনীতিতে নারীরা মৌখিক হয়রানির সম্মুখীন হয় যার অধিকাংশই ব্যক্তিগত এবং লিঙ্গমুখী। ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির প্রভাবে রাজনীতিকে পুরুষের বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে এবং নারীর অংশগ্রহণের জন্য অনুপযুক্ত হিসাবে বিবেচনা করা হয় । ফলস্বরূপ, প্রায়শই দেখা যায় যে, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে আগ্রহী একজন নারীকে তাড়ানোর একটি কার্যকর হাতিয়ার হল তার চারিত্রে কলঙ্ক লেপন করা।

আই এফ ই এস – এর ইলেকট্ররাল ভাইওলেন্স এডুকেশন ও রেজুলেশন (ই ভি ই আর ) রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, নারীর প্রতি সহিংসতার ৪২% হল মানসিক সহিংসতা যা তাকে ‘ভয় দেখানো এবং মৌখিক হয়রানি’ আকারে সম্মুখীন হতে হয় এবং নারীরা পুরুষদের তুলনায় তিনগুণ বেশি এই সহিংসতার শিকার হয়। এই গবেষণার  আরও তুলে ধরা হয়েছে যে, মহিলা দলের নেতা, সমর্থক এবং প্রার্থীরা যে সকল রাজনৈতিক হিংসার সম্মুখীন হয়  তার প্রায় ৯০ ভাগ হল মানসিক সহিংসতা ।

ইন্টারনেট নারীদের বিরুদ্ধে নতুন একটি রাজনৈতিক হিংসার মাধ্যম তৈরি করেছ। জাতীয় এবং স্থানীয় নারী রাজনীতিবিদদের জন্য সামাজিক মাধ্যমে সাইবারবুলি আরও একটি আতঙ্ক । বাংলাদেশের দুটি প্রধান রাজনীতি দলের নারী নেত্রীবৃন্দ আলোচনা ও সাক্ষাতকারে  সাইবার হারাসমেন্ট বিরুদ্ধে  হতাশা এবং অসহায়তা প্রকাশ করেছেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে নারী রাজনীতিবিদরা কেবলমাত্র প্রতিপক্ষ দল থেকে নয়  এবং অনেক সময়ই  নিজ দল থেকেও এই  হারাসমেন্ট  গুলোর সম্মুখীন হতে হয়।

একজন বিরোধীদলের জাতীয় মহিলা নেত্রী বলেছেন, “… প্রতিপক্ষ ব্যাক্তি বা দল সামাজিক মাধ্যমেগুলতে  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল তৈরি করে যার কাজ হল  নারী রাজনীতিবিদের বিভিন্নভবে উৎপীড়ন করা। তাদের এই আক্রোশের শিকার কেবলমাত্র নোমিনেশন বা নির্বাচন প্রার্থী নারীরাই নয় বরং যে কোন সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক নারী সদস্য। দুর্ভাগ্যবশত, এটি  কেবলমাত্র প্রতিপক্ষের দল থেকেই  করা হয় এমন নয়, বরং অনেক সময়ই তাদের নিজস্ব দলের প্রতিযোগী পুরুষ ও এমনকি নারী সহকর্মীরাও  একইভাবে সাইবারবুলি করে থাকে ।”

রাজনীতিতে নারীদের অংশগ্রহনের ক্ষেত্রে পরিবারিক চাপও  একটি বিরাট প্রতিবন্ধক । বাংলাদেশে, সকল সেক্টরে নারীদের উন্নয়নের জন্য পারিবারিক সমর্থন অপরিহার্য,  বিশেষত, রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে যা  নারীর জন্যে একটি নিষিদ্ধ ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পরিবার জোড়পূর্বক  নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ  না করতে অথবা তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্নধরনের চাপ সৃষ্টি করে । সাক্ষাতকারে একাধিক নারী রাজনীতিবিদ বহু ঘটনার উল্লেখ করেছেন যেখানে নারী রাজনীতিবিদরা জানিয়েছেন তাদের অনেক নারী সহকর্মী  রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার কারনে তাদের স্বামী দ্বারা তালাক প্রাপ্ত বা তালাকের  হুমকির  শিকার হয়েছেন।

দুঃখজনক হলেও সত্যি যে বর্তমানে, শারীরিক সহিংসতা এবং সহিংসতা হুমকি  নারীর রাজনৈতিক জীবনের একটি অংশ হিসাবে বিবেচ্য । ধর্ষণ ও প্রাণনাশের হুমকি খুবই সাধারণ ঘটনায় রূপান্তরিত হয়েছে। নারী রাজনীতিবিদ এবং কর্মীরা  প্রায়শয়ই নিজেদের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ঘৃণা বা প্রতিহিংসামূলক  বক্তব্য ও বিভিন্নধরনের হুমকির সম্মুখীন হন। উদাহরণস্বরূপ,  গত ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ সালে, একজন মহিলা জেলা পরিষদ প্রার্থী একটি নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন, যখন তাকে পাঁচজন লোক পথ দেখিয়ে বাগমারা উপজেলার মাহমিংগ্রাম গ্রামে বন্দুকের মুখে ধর্ষণ করে। ভুক্তভোগী একটি সংবাদপত্রের পরে বলেছিলেন, “আমাকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেওয়ার জন্য তারা আমাকে ধর্ষণ করেছে।”

যদিও নারীর প্রতি এই ধরনের রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা  খুবই পরিচিত এবং নথিভুক্ত, কিন্তু  খুবই কম গবেষণা রয়েছে যা সমস্যার সম্পূর্ণ মাত্রা পরীক্ষা করে।

নারীর প্রতি নির্বাচনী সহিংসতা রোধ করা

নারীর প্রতি রাজনৈতিক সহিংসতা একটি সামাজিক সমস্যার পাশাপাশি আইনি সমস্যাও এবং যার কারনে এটি সমাধান করা  অতন্ত্য কঠিন। সরকার নারীদের ইভ-টিজিং এবং যৌন হয়রানি প্রতিরোধে আইন পাস করেছে এবং বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বিতর্ক থাকা সত্ত্বেও, নারীদের অনলাইন হয়রানি থেকে রক্ষা করতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

যদিও বাংলাদেশ সরকার নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, কিন্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, বর্তমান আইন এবং নীতিসমূহ নারীদের রাজনৈতিক মাঠের প্রথম সারিতে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করার জন্য  অপর্যাপ্ত। সব রাজনৈতিক দলগুলি সমস্ত স্তরে বাধ্যতামূলক ৩৩ শতাংশ নারী সদস্যের পূরণে ব্যর্থ  হয়েছে যা নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার অন্তরায়।

সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন নারী অধিকার বিষায়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ  বৃদ্ধি  লক্ষ্যে আরও অনেকবেশি সরব  হতে পারে এবং বিভিন্ন সময় উপযোগী  কর্মসূচী নিতে পারে।  যার মধ্যে নারীর দক্ষতা বৃদ্ধি প্রশিক্ষন, সোশাল মিডিয়া ও সাইবার বুলি  প্রতিরোধ, নারীর নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি এবং পুরুষদের মধ্যে নারীদের রাজনীতিতে ভূমিকার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা  ইত্যাদি বিষয়ে  বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে ।

পরিশেষে, নারীর ক্ষমতায়ন প্রতিষ্ঠার অগ্রযাত্রায়  বাংলাদেশ-তাদের পরিবার,  সম্প্রদায় ও সমাজে -নারীকে রাজনীতিতে অংশগ্রনের জন্যে অপরাধী হিসাবে বিবেচনা না করে বরং এই সকল নারীর রাজনৈতিক প্রাঙ্গনে অবাধ বিচারণ সুনিশ্চিত করতে হবে ।

লেখকঃ রোকসানা হক, (অ্যাডভোকেসি বিশেষজ্ঞ) আই.আর.আই

পূর্বের খবরজাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল বাতিল চেয়ে ১৪১ অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তার বিবৃতি
পরবর্তি খবরদেশের ৯ ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, প্রভিশন ঘাটতি ২৮ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা