নিউজ২১ডেস্কঃ রাজধানী ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) একটি মাস্টারপ্ল্যানের গ্যাজেট প্রকাশ করেছিল, যার নাম ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’ বা সংক্ষেপে ড্যাপ। এর মেয়াদ ধরা হয় ২০১৬-২০৩৫ সাল পর্যন্ত। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ড্যাপের নতুন গেজেট (২০২২-২০৩৫) প্রকাশিত হয়। কিন্তু ড্যাপের গেজেট প্রকাশের পর থেকেই এনিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে সরকারের পটপরিবর্তনের পরপর এই আলোচনা এখন তুঙ্গে। কেউ বলছেন এই প্রকল্প বাতিল করতে হবে। আবার কেউ বলছেন, এটি বাতিল নয়, বরং সংশোধন করা দরকার।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, ২০২২ সালে প্রকাশ করা ড্যাপের নতুন গেজেট (২০২২-২০৩৫) অনুযায়ী ভবন নির্মাণে ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও), রাস্তার প্রশস্ততা, ভবনের উচ্চতাসহ নানা বিষয়ে কড়াকড়ি শর্ত থাকায় রাজধানীতে ভবন নির্মাণে ধস নামে। ওই গেজেট প্রকাশিত হওয়ার পর অন্যান্য সময়ের তুলনায় রাজউক থেকে ভবনের নকশা অনুমোদনের হার অর্ধেক নেমে আসে।
আবাসন ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) প্রজ্ঞাপন জারির পর আবাসন খাতে ব্যাপক মাত্রায় স্থবিরতা নেমে আসে। আগামীতে এই সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। বিগত সরকার প্রণীত ‘বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ’ ড্যাপের (২০২২-২০৩৫) কারণে খালবিল, জলাশয় ও কৃষিজমি দ্রুতগতিতে হ্রাস পাবে যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর হবে। তাছাড়া এই প্রকল্প ঢাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে নয় বরং এই প্রকল্প তৈরি হয়েছিল কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের সুবিধাভোগের জন্য। তাই এই প্রকল্প বাদ দিয়ে নতুন প্রকল্পের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান তাদের।
অন্যদিকে স্থপতিরা বলছেন, বাতিল নয়, বরং সংশোধনই এর সমাধান। এই প্রকল্পে ইতোমধ্যে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। তাছাড়া ঢাকাকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য ড্যাপ যে ধারণা দিয়েছে তা একেবারে অযৌক্তিক নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান। সেসব বিষয় সংশোধন করলে আবাসন ব্যবসায়ীদের যে রাগ-ক্ষোভ আছে তা কমবে বা বৈষম্য দূর হবে।
রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব)-এর সভাপতি ওয়াহিদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একটি সুন্দর ও সময়োপযোগী ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮কে উপেক্ষা এবং মাস্টার প্ল্যান-২০১০ অন্যায়ভাবে রহিত করা হয়। আবাসন খাত যাতে কুক্ষিগত করা যায় এবং বিগত সরকারের মদদপুষ্ট একটি স্বার্থান্বেষী মহলকে খুশি করতে কিছু অসাধু কর্মকর্তা এ কাজ করে।
ওয়াহিদুজ্জামান আরও বলেন, আবাসন শিল্পের স্থবিরতা কাটেনি এবং জনগণের অসন্তোষ বিদ্যমান রয়েছে। অনেক এলাকায় আগে যেখানে আট তলা ভবন তৈরি করতে পারতেন, নতুন ড্যাপের ফার (ফ্লোর এরিয়া রেশিও) অনুযায়ী বাড়ি তৈরি করতে পারবেন চার থেকে পাঁচ তলা। এই ড্যাপ প্রজ্ঞাপন জারির পর আবাসন খাতে ব্যাপক মাত্রায় স্থবিরতা নেমে এসেছে। আমরা চাই না পূর্বের সরকার প্রণীত বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ ড্যাপের (২০২২-২০৩৫) কারণে এই তিলে তিলে গড়ে ওঠা আবাসন শিল্প বন্ধ হয়ে যাক।
এদিকে রাজউকের মাস্টারপ্ল্যান ড্যাপকে ‘বৈষম্যমূলক’ আখ্যা দিয়েছে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (বাস্থই)। একইসঙ্গে এই মাস্টারপ্ল্যান স্থগিত করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের দাবি জানিয়েছে তারা। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক স্থপতি নবী নেওয়াজ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) এর নতুন গ্যাজেট (২০২২-২০৩৫)বাস্তবায়ন স্থগিত করে আইনি এবং অন্যান্য অসঙ্গতি দূর করার জন্য সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে অবিলম্বে এই মাস্টারপ্ল্যান সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, স্থপতি ইনস্টিটিউট শুরু থেকেই বলে আসছে, এই পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রক্রিয়া নগর পরিকল্পনা সংক্রান্ত দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইতোপূর্বে ঢাকা মহানগরীর পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রথম পর্যায়ে প্রস্তাবিত নগর অঞ্চলের ‘কাঠামো পরিকল্পনা’ গ্যাজেটের মাধ্যমে অনুমোদন করার পর নগরের বিভিন্ন এলাকার জন্য ‘আরবান এরিয়া প্ল্যান’ এবং পরিশেষে ‘ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান’ গ্যাজেটের মাধ্যমে অনুমোদন করা হয়।
ড্যাপ (২০২২-৩৫) প্রণয়নের আগে ‘ঢাকা কাঠামো পরিকল্পনা’ ২০১৬ সালে প্রণয়ন করা হলেও তা গ্যাজেটভুক্ত না করে আইনি ব্যত্যয় ঘটিয়ে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ করে ২০২২ সালে এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) গ্যাজেট করা হয়। কাজেই এই বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (২০২২-৩৫) বেআইনি প্রক্রিয়ায় প্রণীত হয়েছে। প্রকল্পে বন্যা প্রবাহ অঞ্চলের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে এবং কৃষি জমিতে অবাধ নগরায়নের সুযোগ দিয়ে এই পরিকল্পনা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে, যুক্ত করেন তিনি।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সভাপতি স্থপতি ড. খন্দকার সাব্বির আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকার জনঘনত্ব বেশি এটা সত্য। ঢাকাকে বিশ্বের অন্য শহরের সঙ্গে তুলনা করলে চলবে না। কেননা বাংলাদেশের ছোট ভূখণ্ডে ১৮ কোটি মানুষের বাস। সে হিসাবে ঢাকার জনসংখ্যা কিছুটা বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে ঢাকা উপরমুখী করতে না দিলে সমস্যা আরও প্রকট হবে। সিঙ্গাপুরের নগরায়ণ ফর্মুলায় (ঊর্ধ্বমুখী) নগরায়ন করতে হবে দেশের।
ড্যাপ সম্পর্কে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকার (অব.) এর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি নগর পরিকল্পনাবিদ মাহফুজা আক্তারের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
মাহফুজা আক্তার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শহরকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে কোনও না কোনও প্ল্যান তো নিশ্চয়ই থাকবে। নয়তো শহরের উন্নয়ন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাবে। প্ল্যান ছাড়া নিশ্চয়ই শহর এগুবে না। ড্যাপের বিষয়ে অনেক ধরনের আলোচনা হচ্ছে। তবে বাতিল হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে হ্যাঁ সংশোধনের বিষয় থাকলে সেটা নিশ্চয়ই হবে।
তিনি আরো বলেন, দেড় হাজার স্কয়ার কিলোমিটারের প্ল্যান যখন আপনি করবেন তখন আপনি নিখুঁতভাবে করতে পারবেন না। কিছু অসঙ্গতি থাকবেই স্বাভাবিক। সিদ্ধান্তের বিষয়ে সবাই একমত থাকবে সেটাও না। আবাসন ব্যবসায়ীদের মূল ইস্যু হচ্ছে প্লটের পার ইস্যুটা। আমাদের গুটি কয়েকের সুবিধার জন্য তো আমরা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুবিধা বঞ্চিত করতে পারি না।