নিজস্ব প্রতিবেদক ঃ বাংলাদেশের বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে হুঙ্কার দিয়েছিল, ভয় ভীতি দেখিয়েছিল তা কেটে গেছে। বরং গত বৃহস্পতিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, নির্বাচন নিয়ে তাদের অস্বস্তি থাকলেও নতুন সরকারের সঙ্গে তারা কাজ করে যেতে চান। বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারিত্বের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মার্কিন প্রত্যয়ে কয়েক দফায় দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সর্বশেষ ম্যাথিউ মিলারের সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে তার ফলে মার্কিন অবস্থান সুস্পষ্ট হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না, বরং নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করে যাবে সে ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক অবস্থান ঘোষণা করা হয়েছে৷ অথচ দুবছর আগে দৃশ্যপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এক ধরনের আগ্রাসী ভূমিকা অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচন যেন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, নির্বাচন যেন অংশগ্রহণমূলক হয় এবং সকল রাজনৈতিক দল যেন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা কম ছিল না। একাধিক মার্কিন উচ্চ পর্যায়ের কূটনীতিকরা বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ উভয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও কথা বলেছিলেন।
নির্বাচন যদি শেষ পর্যন্ত নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু না হয় তাহলে ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে এমন ঘোষণাও দেওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। কিন্তু নির্বাচনের আগে থেকেই হঠাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মৌনব্রত শুরু করে এবং সর্বশেষ নির্বাচনের পর এখন নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘুরে যাওয়ার পেছনে প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে ভারতের ভূমিকা। ভারতের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করেছে এমন ধারণা কূটনীতিকদের। তারা মনে করেন, একাধিক কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। যখন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে, ঠিক সেই সময় নীরবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতে প্রায় চারশ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র বিক্রি করার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
বৈশ্বিক রাজনীতিতে ক্রমশ কোণঠাসা এবং স্ববিরোধিতার কারণে বিতর্কিত হওয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নকেই সবচেয়ে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। না হলে সারা বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে আধিপত্য এবং প্রভুত্ব তা হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে ইতোমধ্যে চীনের অর্থনৈতিক আগ্রাসন প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। চীন আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য গুলোতে তার অর্থনৈতিক কূটনীতিকে সম্প্রসারণ করেছে এবং এই দেশগুলো পুরোপুরিভাবে এখন চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি ভাবে এই উপমহাদেশেও অন্তত তিনটি দেশে চীনের আধিপত্য এখন প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা এবং নেপাল চীনের অর্থনীতির জালে বন্দি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশও চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ককে জোরদার করেছে এবং বাংলাদেশের যে মেঘা প্রকল্পগুলো চলছে তার অনেকগুলো চীনের অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে। এরকম বাস্তবতায় বাংলাদেশে চীনা আগ্রাসণ ঠেকানো এবং বাংলাদেশকে চীনের বলয় থেকে মুক্ত রাখতে ভারত ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামনে আর কোন পথ খোলা ছিল না।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক গভীর এবং গত একযুগে এই সম্পর্ক আরও গভীরতর হয়েছে। যে কারণে ভারত এখন বাংলাদেশের সঙ্গে একটা বিশ্বস্ততা সম্পর্কই শুধু স্থাপন করেনি। বাংলাদেশকে নির্ভরশীলও করেছে। যেহেতু ভারতের প্রভাব বলয় এখানে বেশি সে কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে একটা নতুন পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়নি। তাছাড়া বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের একটি কৌশলগত অবস্থান রয়েছে। যেই কৌশলগত অবস্থানে যুক্তরাষ্ট্র অংশীদার। মূলত, চীনবিরোধী যে বিশ্ব জোট সেই বিশ্ব জোটে প্রধান দুইটি দেশ হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত। আর সে কারণেই ভারতের পরামর্শ শুনল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের পরামর্শ অনুযায়ী তারা এখন বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের আগ্রাসী অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াল।