উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—এ বছরের ২৮ অক্টোবরের রাজনৈতিক সমাবেশকে কেন্দ্র করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ওই দিনই যুক্তরাষ্ট্র এক বিবৃতিতে ঘটনাবলিকে ‘রাজনৈতিক সহিংসতা’ হিসেবে উল্লেখ করে ‘নিন্দা’ জানায় এবং ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে। একদিন পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন অনেক নমনীয় বিবৃতি প্রকাশ করে শুধু ‘সহিংসতার’ বিষয়টি উল্লেখ করে ঘটনাবলির জন্য ‘অত্যন্ত মর্মাহত’ বলে জানায়। ইইউর বিবৃতি প্রকাশের পর সাতটি দেশ– যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়া একযোগে বিবৃতি প্রকাশ করে তাদের ‘উদ্বেগ’ জানায়।
বিবৃতিগুলো লক্ষ করলে দেখা যায়—একই ঘটনার ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের বিবৃতি কঠোর হলেও ইইউ’র বিবৃতি নমনীয় এবং সাত দেশের বিবৃতি দুটোর মাঝামাঝি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘এ ধরনের প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে একটি দেশ অন্য দেশের প্রতি তাদের মনোভাব প্রকাশ করে থাকে।’
বিষয়টিকে বিবেচনায় নেওয়া হলে বলা যায়, পশ্চিমা বিশ্বের সবাই যুক্তরাষ্ট্রের মতামতের সঙ্গে একমত নয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমেরিকাকে একা (লোনলি বয়) বলার এখনও সময় আসেনি। তবে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দূর হয় কিনা বা কীভাবে দূর হবে, সেটি দেখার বিষয়।’
মতের মিল-অমিল
কয়েকটি বিষয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সবার মত একই রকম এবং তারা একই সুরে কথা বলে। যেমন, অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুশীল সমাজের বর্ধিত ক্ষেত্রসহ অন্যান্য নাগরিক অধিকারগুলো।
এ বিষয়ে আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, ‘বড় আকারে নাগরিক অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে সবার মধ্যে ঐকমত্য আছে। একই সঙ্গে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে না বাংলাদেশও।’
যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও সরকারের পক্ষ থেকে সবসময় বলা হয়—নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, গণমাধ্যম অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করে এবং সুশীল সমাজকে কাজ করতে বাধা দেওয়া হয় না বলে তিনি জানান।
তবে, মতের অমিল কোথায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সবাই নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা বললেও যদি সেটি ঠিকমতো পালন করা না হয়, তবে এজন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দ্বিমত রয়েছে দেশগুলোর মধ্যে।’
উদাহরণস্বরূপ তিনি বলেন, ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে সারা বিশ্ব বাংলাদেশকে বিভিন্নভাবে এবং অনেক ক্ষেত্রে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে, কিন্তু কোনও ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি এবং এর একমাত্র ব্যতিক্রম যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময়ে বাংলাদেশ যে যৎসামান্য মার্কিন জিএসপি সুবিধা পেতো, সেটিও যুক্তরাষ্ট্র কেড়ে নিয়েছিল।
একইভাবে র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলেও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি একই ধরনের কোনও ব্যবস্থা নেয়নি অন্য দেশগুলো জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশগুলোর মধ্যে এখনও ঐকমত্য নেই।’
রাজনীতি ও উন্নয়ন
যুক্তরাষ্ট্র একটি দেশের সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং তাদের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অংশগ্রহণের বিষয়টিকে একই লেন্স দিয়ে দেখে থাকে। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বা অন্য দেশগুলো বিষয়টিকে আলাদা করে দেখে।
এ বিষয়ে সাবেক আরেকজন কূটনীতিক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক ভালো না থাকলে, ওই দেশকে উন্নয়ন সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে পারে।’
উদাহরণ হিসেবে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স করপোরেশন থেকে অবকাঠামো খাতে বাংলাদেশ কোনও ধরনের সহায়তা পায় না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতিকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র। সেজন্য ১১০টি দেশে প্রায় ৩,৭০০ কোটি ডলার অর্থায়ন করলেও বাংলাদেশকে কিছুই দেয়নি যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে ইইউ গ্লোবাল গেটওয়ে নামে একটি তহবিল তৈরি করেছে, যেখান থেকে সম্প্রতি ৪৫০ মিলিয়ন ইউরো ঋণ পেয়েছে বাংলাদেশ বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, ‘শ্রম অধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ একই ধরনের মানদণ্ড ব্যবহার করে থাকে। বরং ইইউর মানদণ্ড কিছু ক্ষেত্রে বেশি কঠোর। বাংলাদেশের জন্য ইইউ তহবিল দিতে রাজি হলে এবং যুক্তরাষ্ট্র অজুহাত দেখালে বুঝতে হবে এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ রয়েছে।’