ভারতের সভ্যতায় সুলতানুল হিন্দ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.) এর অবদান

164

বিশেষ প্রতিবেদনঃ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরী (রহ.) ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের এক মহান সাধক ও আধ্যাত্মিক জগতের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি দক্ষিণ এশিয়ায় চিশতী তরিকার প্রবর্তক এবং ইসলামী সুফি মরমীধারার প্রসারে উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রাখেন। চিশতীয়া তরিকা মানবপ্রেম, সহনশীলতা, পরোপকারিতা এবং বস্তুবাদ থেকে দূরত্বে থাকার গুণাবলি শেখায়। এই বিশেষ তরিকা মধ্যযুগে ভারতে প্রভাবশালী মুসলিম আধ্যাত্মিক গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল এবং বিখ্যাত অলি শায়খ নিজামুদ্দিন আউলিয়া (মৃত্যু ১৩২৫) ও তুতিয়ে হিন্দ নামে পরিচিত কবি আমির খসরু (মৃত্যু ১৩২৫)-সহ অনেক প্রিয় এবং শ্রদ্ধেয় ভারতীয় সুন্নি সাধক চিশতী ছিলেন। ‘সুলতানুল হিন্দ’ ও ‘গরীব নওয়ায’ (দরিদ্রদের উপকারকারী) নামেও তিনি সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। ৯৭ বছরের পুরো জীবন তিনি তাওহীদের প্রচার, দ্বীনের দাওয়াত, আত্মসংযম ও মানবসেবায় উৎসর্গ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে চিশতিয়া তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) ১১৪৩ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ার সিজিস্তানের অন্তর্গত সানজার নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এটি বর্তমানে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান সীমান্তবর্তী ইরানের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত। শৈশব থেকেই তিনি ধার্মিকতা ও ত্যাগের গুণাবলির অধিকারী ছিলেন। কিশোর বয়সে তার পিতা ইন্তেকাল করেন। তিনি তার পিতার পেশা গ্রহণ করার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই আধ্যাত্মিক জীবনের দিকে ফিরে যান।

তৎকালীন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান ও সংস্কৃতির কেন্দ্র সমরকন্দ ও বুখারায় অবস্থিত মাদরাসাগুলোতে তিনি পবিত্র কুরআন, হাদিস, ফিকহ ও আরবি সাহিত্য অধ্যায়ন করেন। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী ছিলেন একজন সুন্নী মুসলিম দার্শনিক এবং ধর্মীয় প-িত। মাযহাবে তিনি ছিলেন হানাফী ও চিন্তাধারায় মাতুরিদী। তিনি ত্রয়োদশ শতকে ভারতীয় উপমহাদেশে আসেন এবং দিল্লী হয়ে আজমিরে বসতি স্থাপন করেন। তিনি দরিদ্র লোকদের সাহায্য করার জন্য আজমীরে খানাকাহ প্রতিষ্ঠা করেন।

ইতোমধ্যে নিজ মাতৃভূমি সিজিস্তান, খুরাসানসহ মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশ মোঙ্গলদের পৈশাচিকতার বীভৎস তা-বে বিধ্বস্ত হয়ে গেলে তিনি হিজরত তথা দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। মানবতার অধঃপতন রাজনৈতিক নোংরামি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে নিষ্কণ্টক করার জন্য নৃশংস পন্থায় মানুষ হত্যা হযরত খাজা সাহেবের অন্তরকে বিচলিত করে তোলে। তিনি সম্যক উপলব্ধি করেন যে, আর পরকালীন জবাবদিহি ও মহানবীর (সা.) আদর্শ থেকে বিচ্যুতির ফলে মানুষের মধ্যে ধনলোভ, নৃশংসতা, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতালোভের উদগ্র মোহ সৃষ্টি হয়। সমকালীন এহেন অমানবিক ও অধার্মিক আচরণ হযরত খাজা সাহেবের অন্তরে বিদ্যমান আধ্যাত্মবাদের স্পৃহাকে তীব্রতর করে তোলে। মানুষকে সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে ইসলামের শাশ্বত পথে আহ্বান জানানোর উদ্দেশে তিনি দেশভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ইরাক যাবার পথে নিশাপুর এলাকায় পৌঁছলে তিনি হযরত খাজা উসমান হারুনী (রহ.) নামক প্রসিদ্ধ দরবেশের দেখা পান। তার সান্নিধ্যে তিন বছর অতিবাহিত করে তিনি রুহানিয়্যাতের উচ্চমার্গে আরোহণ করেন। অতঃপর তিনি স্বীয় মুর্শিদের হুকুমে মক্কা, মদীনা, বাগদাদ, তাবরেজ, ইস্পাহান, বলখ, গজনী পরিদর্শন করেন। দীর্ঘ সফরে মুসলিম বিশ্বের প্রসিদ্ধ সুফী-সাধক ও প-িত বিশেষত হযরত শাহ আব্দুল কাদের জিলানী, শায়খ নাজমুদ্দীন কোবরা, শায়খ নাজিবুদ্দীন, শায়খ আবদুল কাহির সোহরাওয়ার্দী, শায়খ আবু সাঈদ তাবরিজী, শায়খ আবদুল ওয়াহিদ গজনভীর সাথে সাক্ষাত ঘটে।

দেশ ভ্রমণের বিচিত্রতা ও যুগশ্রেষ্ঠ আল্লাহর অলীদের সাহচর্য হযরত খাজা সাহেবের অভিজ্ঞতার ভা-ারকে সমৃদ্ধ করে এবং মুসলিম ধর্মীয় জীবনে সব গুরুত্বপূর্ণ তরিকার সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। অতঃপর হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) ভারতের উদ্দেশে লাহোরের পথে রওয়ানা হন। সেখানে কিছুদিন থাকার পর তিনি দিল্লী রওয়ানা হন। দিল্লী অবস্থানকালে বিপুলসংখ্যক মানুষ তার হাতে ইসলাম কবুল করে ধন্য হন। হিজরী ৫১৬ সালে রাজপুতদের শক্তিশালী ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কেন্দ্র আজমীরে গমন করেন। তথায় পাহাড়ের পাদদেশে খানকাহ স্থাপন করে নিরবিচ্ছিন্নভাবে আধ্যাত্মসাধনা, দাওয়াতী ও তাবলিগী খিদমাত আঞ্জাম দিতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর চরিত্রমাধুর্য, নিঃস্বার্থ ধর্মপ্রচার, মানবসেবা, আধ্যাত্মসাধনা ও অলৌকিক ঘটনাবলির খবর আজমীর ও আশপাশে তড়িতবেগে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য পথহারা মানুষ খাজা সাহেবের পুতঃসান্নিধ্যে এসে শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার বর্জন করে তাওহীদের অমিয় বাণী গ্রহণ করতে থাকেন এবং তাদেরই প্রচেষ্টায় বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠতে থাকে বেশকিছু মসজিদ ও মক্তব।

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর (রহ.) আজমীর আগমনকে চৌহান রাজা পৃথ্বিরাজ ভালো চোখে দেখেননি। তিনি খাজা সাহেবকে আজমীর থেকে বহিষ্কারের প্রয়াস চালান। কিন্তু খাজা সাহেবের প্রতি ধর্ম, বর্ণ ও গোত্র নির্বিশেষে জনগণের ভালোবাসা ও আল্লাহ প্রদত্ত তাঁর অলৌকিক ক্ষমতার কারণে পৃথ্বিরাজের এ দুরভিসন্ধি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। খাজা সাহেবের অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিরন্তর সাধনার ফলে শিরক ও বিদআতের পঙ্কে তাওহিদ ও সুন্নাতের পুষ্পগুচ্ছ প্রস্ফুঠিত হয়। ইতিহাসবিদ শায়খ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) হযরত খাজা সাহেব (রহ.)কে ‘শায়খুল ইসলাম’ অভিধায় আখ্যায়িত করেন (তারিখে দাওয়াত ওয়া আজিমাত, ৩ খ-, করাচি, ১৯৮৩, পৃষ্ঠা-২২)। ১১৯২ সালে তরাইনের যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘোরি পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করেন। ঘোরি তখন আজমীরে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতীর সাথে দেখা করতে আসেন। তিনি শিগগির দূর-দুরান্ত থেকে আগত স্থানীয় জনগণ, দরিদ্র কৃষক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন।

ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারে খাজা সাহেবের অবদান মূল্যায়ন করে ‘সিয়ারুল আউলিয়া’ গ্রন্থের লেখক অভিমত প্রকাশ করেন যে, ‘ভারতে যারা ইসলাম গ্রহণ করে ধন্য হন এবং আগামীতে কিয়ামত পর্যন্ত হবেন এবং ইসলামের পরিধি যত বিস্তৃত হবে তার সওয়াব খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.)-এর রূহ মুবারকের ওপর পৌঁছবে’ (সিয়ারুল আউলিয়া, পৃ.৪৭)। বিভিন্ন ইতিহাস সূত্রে জানা যায় যে, হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে স্থানীয় জনগণের প্রতি খাজা সাহেব (রহ.)-এর সহনশীল এবং সহানুভূতিশীল আচরণ তাঁর হাতে ইসলাম গ্রহণের পেছনে একটি প্রধান কারণ বলে মনে করা হয়। তিনি শায়খ বখতিয়ার কাকি (মৃত্যু ১২৩৫)-কে তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন, যিনি দিল্লিতে চিশতিয়া তরিকা প্রচারে আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন।

হযরত খাজা সাহেবের কর্মময় জীবনের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক হচ্ছে তিনি সুলতান ইলতুতমিশের আমলে দু’বার (১২১০-১২৩৫) দিল্লি সফর করেন। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্র হতে নিজকে সযতেœ দূরে রাখেন। এমনকি হযরত খাজা সাহেবের শিষ্য এবং চিশতীয়া তরিকার বুযুর্গবৃন্দ সুলতান ও রাজ দরবারের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখা অপছন্দ করতেন। উপঢৌকন রূপে সরকারি জমি-জায়গীর তাঁরা কখনো গ্রহণ করেননি। চিশতীয়া তরিকার প্রসিদ্ধ সাধক হযরত খাজা নিজামুদ্দীন আওলিয়া (রহ.)-এর সাক্ষাতের অনুমতি পাননি তৎকালীন দিল্লির সুলতান আলাউদ্দীন খিলজী বারবার আবেদন করা সত্ত্বেও।

হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী ছিলেন উদার, সহানুভূতিপ্রবণ, গভীর মানবতাবাদী, বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন এবং মহানবী (সা.)-এর আদর্শের বাস্তব রূপকার। তিনি ধর্মকে মানবসেবার প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেছেন এবং তাঁর অনুসারীদের নদীর মতো বদান্য, সূর্যের ন্যায় স্নেহবৎসল ও পৃথিবীর ন্যায় অতিথিপরায়ণ হওয়ার জন্য শিক্ষা দান করে গেছেন। তাঁর মতে, ইবাদতের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে দুঃখী মানুষের দুঃখ দূর করা, অসহায়ের অভাব মোচন করা এবং ক্ষুধার্তকে আহার যোগানোর মধ্যে নিহিত (ইসলামী বিশ্বকোষ, ১০ খ-, ঢাকা, ১৯৯১, পৃষ্ঠা-৭২৯)। দরিদ্র ও অসহায়দের জন্য দাতব্যসেবা, সমবেদনা, আল্লাহর নির্দেশের অনুবর্তী হয়ে ভক্তিপূর্ণ ও বিশুদ্ধ জীবনযাপন করা ছিল তার জীবনদর্শন।

ইসলাম ধর্মের এই মহান সাধক ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে আজমীরে ইন্তেকাল করেন। বড় ছেলে খাজা ফখরুদ্দীন চিশতী তাঁর নামাজে জানাজায় ইমামতি করেন। সুলতান ইলতুতমিশ, স¤্রাট আকবর, রাজিয়া সুলতানা, স¤্রাট জাহাঙ্গীর, স¤্রাট শাহজাহান, বাদশাহ আওরঙ্গজেব প্রমুখ শাসকগণ নিয়মিত তার মাজার জিয়ারত করতে আসতেন। তার মাজারের স্থাপত্যশৈলী ইন্দো-ইসলামিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলাম প্রচার, আধ্যাত্মসাধনা ও সুফি তরিকার বিকাশে তাঁর অবদান ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে এবং থাকবে। মোঘল সম্রাট আকবর পদব্রজে আজমীরে আসতেন হযরত খাজা সাহেবের মাজার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে। ইসলামের মহান সাধক হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী আজমিরীর অমূল্য জীবন ও কর্ম অনুসরণ করে মানুষ জীবনকে আলোকিত করতে পারে, শিরক ও বিদআতের পথ পরিহার করে তাওহিদ ও সুন্নাতে রাসুলের আদর্শকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করে জীবনে সফলতায় অভিষিক্ত করতে পারে।

পূর্বের খবরবাংলাদেশে সুশীল সমাজকে হয়রানি না করতে সরকারের প্রতি ইইউ’র আহ্বান
পরবর্তি খবরবিশ্বে গণতন্ত্র এখন হুমকির মুখে: জাতিসংঘ আন্তোনিও গুতেরেস