অনলাইন ডেস্কঃ বৃটেন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় বাংলাদেশে। ঢাকা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সক্ষমতা আছে আমাদের। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায় বৃটেন। মঙ্গলবার ঢাকা-লন্ডন ৫ম কৌশলগত সংলাপে দেশটির তরফে এমন প্রত্যাশার কথা জানানো হয়। ‘কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন’ আয়োজনে যে কোনো ধরনের সহযোগিতা দেয়ারও প্রস্তাব দিয়েছে বৃটিশ সরকার। জবাবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ ধরনের নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতাও রয়েছে বাংলাদেশের। বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ওই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ ও ডেভেলপমেন্ট অফিসের পার্মানেন্ট আন্ডার সেক্রেটারি স্যার ফিলিপ বার্টন। সংলাপ শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন সাংবাদিকদের বিস্তারিত জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ আছে। তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন দেখতে চায়। সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করছে বলে আমরা জানিয়েছি।
নির্বাচনে কোনো ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন হলে তারা সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। আমরা বলেছি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে আমরা সক্ষম। নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠাতে চাইলে বাংলাদেশ স্বাগত জানাবে।
সংলাপে নির্বাচন নিয়ে যা আলোচনা হলো: এদিকে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মানবজমিনকে জানিয়েছে বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণের একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং সহিংসতাপূর্ণ নির্বাচন দেখার আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করেছে বৃটেন। দীর্ঘমেয়াদি বৃটিশ তথা বিদেশি বিনিয়োগের রক্ষাকবচ হিসেবে তারা এমন নির্বাচন চায় বলে জানানো হয়েছে। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে সরকার বা নির্বাচন কমিশনের যেকোনো উদ্যোগে প্রয়োজন হলে বৃটেন সহযোগিতা করতে তৈরি আছে বলেও জানানো হয়েছে। স্মরণ করা যায়, ২০১৪ এবং ’১৮ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ‘অংশগ্রহণমূলক’ করতে অব্যাহতভাবে বার্তা দিয়ে যাচ্ছেন বৃটেনের প্রতিনিধিরা।
বিশেষ করে নবনিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে বিভিন্ন লেভেলের সাক্ষাৎ-বৈঠকে বার্তাটি স্পষ্ট করেছেন। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠকে তিনি জানান, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এখনই বিরোধী দল এবং ভিন্নমতের লোকজনের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা, আশঙ্কা এবং অবিশ্বাস দূর করতে হবে। এমন কোনো ম্যাকানিজম বের করতে যাতে স্টেকহোল্ডাররা এটি বিশ্বাস করেন যে, নির্বাচনটি অবশ্যই অবাধ, সুষ্ঠু এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, সেই সঙ্গে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড অর্থাৎ সবার সমান সুযোগ থাকবে। বিরোধীদের আস্থায় নেয়ার এই উদ্যোগ সরকার কিংবা নির্বাচন কমিশন যে কেউ নিতে পারে। বৃটেনের সঙ্গে স্ট্র্যাটেজিক সংলাপে অংশ নেয়া প্রতিনিধি দলের প্রধান থেকে শুরু করে অন্যদের অভিন্ন অবস্থান ছিল জানিয়ে একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মানবজমিনকে বলেন, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিয়ে শঙ্কিত বৃটেন। তাই দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন দেখার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে তারা। বৃটেন মনে করে স্থিতিশীলতার আগাম গ্যারান্টি পেলে বৃটেনের বড় বড় বিনিয়োগ আসবে, অন্যথায় বিদ্যমান বিনিয়োগে টান পড়া তথা দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়বে।
সূত্র জানায়, নির্বাচন, সংলাপ এবং সমঝোতার আকাঙ্ক্ষায় বৃটেনের প্রতিনিধিরা আগে যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগে তা-ই পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে। লন্ডনে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক সাইদা মুনা তাসনিম এবং ঢাকাস্থ বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুকসহ উভয়পক্ষের দায়িত্বশীল প্রতিনিধিরা স্ট্রাকচার্ড ওই সংলাপে উপস্থিত ছিলেন। সংলাপ শেষে ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, বাংলাদেশ বলেছে নির্বাচনে যাতে সকল ভোটার অংশ নিতে পারেন সেটা সরকার ও নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করতে পারে। তবে সব দল নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা সেটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাজনৈতিক দলগুলোর। তিনি জানান, পঞ্চম অংশীদারিত্ব সংলাপে জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন আইপিএস, অভিবাসন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সাইবার নিরাপত্তা, সুশাসন মানবাধিকার, নির্বাচনসহ সম্পর্কের সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি।
সচিব বলেন, তারা যেহেতু পুরোনো বন্ধু, অনেক দিনের উন্নয়ন অংশীদার নির্বাচনের ব্যাপারে তাদের আগ্রহ আছে। তারা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও সহিংসতামুক্ত নির্বাচন দেখতে চায় সেখানে যাতে সবাই অংশগ্রহণ করে। আমাদের পক্ষ থেকেও অবাধ, সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যাপারে অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছি। অন্য কোনো দেশ না বললেও বৃটেন অংশগ্রহণের কথা বলছে। এখন অংশগ্রহণ সরকার কীভাবে নিশ্চিত করবে এমন এক প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, অংশগ্রহণের তো অনেক অর্থ হতে পারে। একটা হতে পারে জনগণের সবাই ভোট দেবে। সব পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কি করবে না সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। প্রত্যাশা থাকতে পারে যে সবাই করবে। কিন্তু আসল হচ্ছে যে, জনগণ তাদের ভোটাধিকার যাতে প্রয়োগ করতে পারে। এটা সরকার এবং নির্বাচন কমিশন নিশ্চিত করবে। অংশগ্রহণমূলক সহায়ক পরিবেশের কথা বলতে বৃটেনের আন্ডার সেক্রেটারি কি বুঝিয়েছেন? তিনি কি মধ্যস্থতা করতে চেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, নির্বাচনের জন্য সব দলের অংশগ্রহণের জন্য আমরা যদি সুনির্দিষ্ট সহযোগিতা চাই তারা তৈরি আছে। আমরা বলেছি এটা আমাদের নিজস্ব ব্যাপার। নির্বাচন আগেও আমরা করেছি। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন তারা যথেষ্ট যোগ্য অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে। ওরা বলছে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যেখানে সহিংসতা কম হবে। আমাদের কথা হচ্ছে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারি। প্রতিটি পার্টি করবে কি করবে না সেটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। রাজনৈতিক সমঝোতার কোনো প্রস্তাব যুক্তরাজ্য দিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, সরাসরি তারা এমন কোনো প্রস্তাব দেয়নি।
অবৈধদের ফেরাতে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে এসওপি চুক্তি করছে বাংলাদেশ: এদিকে অনিয়মিত বা অবৈধ হয়ে পড়া বাংলাদেশিদের ফেরাতে বৃটেনের সঙ্গে শিগগিরই স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর বা এসওপি সই করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মঙ্গলবার ঢাকা-লন্ডন পঞ্চম কৌশলগত সংলাপে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। বলেন, আজকের বৈঠকে আমরা দু’একটা মেকানিজমের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা এসওপি শিগগিরই সাইন করব, যেন বৃটেনে যারা ভিসার বাইরে থাকছে বা অবৈধ হয়ে আছেন তাদের নিয়ে আসতে পারি। এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। মাসুদ বিন মোমেন জানান, মাইগ্রেশন অ্যান্ড মবিলিটি নিয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ করতে বৃটেন সম্মত হয়েছে। সামপ্রতিক সময়ে আমাদের কিছু শিক্ষার্থী এবং কর্মী সেখানে যাচ্ছে সেটাকে আরও যেন বাড়ানো যায়; সে বিষয়ে আমরা আলোচনা করেছি। সংলাপে অংশ নেয়া লন্ডনন্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আমাদের এ ধরনের এসওপি আছে। ইইউ’র পুরনো সদস্য বৃটেন এটি নতুন করে সই করতে চাইছে। এসওপি হলে প্রতি মাসে তিন থেকে চারজন অবৈধ বাংলাদেশি দেশে ফেরত পাঠানো হবে বলেও জানান হাইকমিশনার মুনা তাসনিম।
পররাষ্ট্র সচিবের ব্রিফিংয়ে এক সাংবাদিক জানতে চান তারেক রহমানের পাসপোর্টের মেয়াদ নেই, তাকে এদেশে ফেরানো হবে কিনা? জবাবে সচিব বলেন, আমাদের জানামতে তিনি রাজনৈতিক আশ্রয়ে সেদেশে আছেন। আমাদের সঙ্গে তাদের যেই লিগ্যাল মেকানিজমগুলো আছে সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিস্টেন্স, এক্সট্রা এডিশন এসব বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের বিভিন্ন সংস্থাগুলোর মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। তবে আজকে আমরা বেশি আলোচনা করেছি যে, ওখানে যারা রেগুলার যাচ্ছেন তারা আসছেন না সময় মতো। বা ইউরোপের অন্যান্য দেশে থেকে হয়তো ঢুকে পড়ছেন, সেখানে অবৈধ হয়ে পড়ছেন সেই ব্যাপারেই আলোচনাটা বেশি হয়েছে। এসময় ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের বিষয়ে তিনি বলেন, ওই অ্যাক্টকে সংশোধন করে সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট করা হয়েছে। এটা প্রয়োগেও যদি সমস্যা হয় সে বিষয়টিও আমরা দেখবো। প্রতিরক্ষা ক্রয় বিষয়ে কী আলাপ হয়েছে জানতে চাইলে সচিব বলেন, সম্প্রতি তাদের কাছ থেকে আমরা সি-১৩০ বিমান সংগ্রহ করেছি। আমাদের নেভির সঙ্গে অনেক বিষয় আছে। তবে আমরা নতুন কোনো ক্রয় নিয়ে আলোচনা করিনি।
উল্লেখ্য, সংলাপে ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দুই দেশের সহযোগিতার নতুন পরিসর নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে গত এপ্রিলে বাংলাদেশ যে ইন্দো-প্যাসিফিক আউটলুক (আইপিও) ঘোষণা করেছে তা নিয়ে কথা হয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডনে চতুর্থ কৌশলগত সংলাপ হয়েছিল। সেই সংলাপে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ওপর জোর দিয়েছিল বৃটেন। ঢাকার পঞ্চম সংলাপে সর্বশেষ সংলাপের সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা ছাড়াও বাণিজ্য, বিনিয়োগ, প্রতিরক্ষা, উন্নয়ন সহায়তা, সুশাসন, মানবাধিকার, রোহিঙ্গা সংকট, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সহায়তা, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবের মতো দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। পরবর্তী ৬ষ্ঠ সংলাপ লন্ডনে আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়েছে।