ঢাকাঃ জাতীয় নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও যে কারণে আন্দোলন ধরে রাখতে চায় বিএনপি? নির্বাচনের পর বিএনপি’র পাশাপাশি ভোট বর্জন করা অন্যান্য দলগুলোও কমবেশি বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে।
ঢাকার মতিঝিলে পীরজঙ্গি মাজার এলাকা। গেলো মঙ্গলবার এখান থেকেই বিএনপি’র কালো পতাকা মিছিল বের হওয়ার কথা ছিল। তবে সেদিন দুপুরে নির্ধারিত সময়ের আগেই সেখানে পুলিশে শক্ত অবস্থান দেখা যায়।
ফলে মিছিলের নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও কর্মসূচি পালনে বিএনপি’র কোনো নেতা-কর্মীকে আসতে দেখা যায়নি। দুয়েকজন এলেও পুলিশের অবস্থান দেখে সরে যান।
শেষ পর্যন্ত দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নির্ধারিত স্পটে আসেন গাড়িতে করে। পুলিশ যে সড়কে অবস্থান করছিলো তার বিপরীত সড়কে গাড়ি থেকে নেমে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন কিছুক্ষণ। তারপর গাড়িতে করেই স্থান ত্যাগ করতে দেখা যায় তাকে।
ত্রিশে জানুয়ারি মতিঝিলের মতো উত্তরাতেও বিএনপি’র কর্মসূচি বাধার মুখে পড়ে। উত্তরায় কয়েকজন নেতা-কর্মীসহ দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাকে আটক করে। যদিও ঐদিনই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়।
এভাবেই সেদিন কোথাও গ্রেফতার, কোথাও নিরাপত্তা জোরদার করে ঢাকার যেসব স্থানে বিএনপি’র কর্মসূচি নির্ধারিত ছিলো সেগুলোতে নেতা-কর্মীদের জড়ো হতে দেয়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
যদিও বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও ঝটিকা মিছিল করেছেন দলটির নেতা-কর্মীরা। এছাড়া ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচি পালন করতে দেখা গেছে বিএনপিকে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধার মুখে বিশেষতঃ ঢাকায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের দাঁড়াতে না পারা আবারো দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই স্পষ্ট করেছে বলে অনেকে মনে করেন।
কিন্তু একদিকে দাবি আদায় না হওয়া অন্যদিকে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পরও আন্দোলন ধরে রেখে কী অর্জন করতে চাইছে বিএনপি?
আর এই আন্দোলনে বিএনপিসহ সমমনা দল এবং বিএনপি বলয়ের বাইরে থাকা ভোট বর্জনকারী দলগুলোরই বা আগ্রহ কতটা আছে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর বিএনপি কি এখন নিরাশ?
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় নতুন কোনো কর্মসূচি পালন করেনি বিএনপি। দলটির নেতা-কর্মীরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন।
নির্বাচন নিয়ে আমেরিকা, বৃটেনের মতো দেশগুলো প্রশ্ন তুললেও সেটা দৃশ্যত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য নতুন কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি। বিএনপিও এ সময় কোনো কর্মসূচি দেয়নি।
তবে শেষ পর্যন্ত গেলো সাত দিনে তিন দফায় কালো পতাকা মিছিলের মতো কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। যদিও এসব মিছিল/সমাবেশে আগের মতো নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি সেভাবে দেখা যায়নি। বিশেষ করে ঢাকায় কর্মসূচি নিয়ে সর্বশেষ দলটির দাঁড়াতে না পারা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।
যদিও বিএনপির কর্মসূচিতে ঢাকায় কী হয়েছে সেটাকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে চান না দলটির কেন্দ্রীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদীন ফারুক।
তিনি বলছেন, দলের মধ্যে হতাশা-নিরাশা নেই। ঢাকায় দুয়েকটি স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বাধা থাকলেও তার ভাষায় বিএনপি’র কর্মসূচিকে ‘আটকে রাখা যায়নি’।
তিনি বিবিসিকে বলেন, “আমরা এই সপ্তাহে যেসব কর্মসূচি পালন করেছি, দুয়েকটা জায়গা ছাড়া কোথাও পুলিশের বাধা কাজ করেনি। হাজার হাজার নেতা-কর্মী বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে। এটাতেই প্রমাণ করে বিএনপি এখনও নিরাশ নয়। আমরা উজ্জীবিত আছি। আন্দোলনও চলবে।”
কিন্তু বাধার মুখে ঢাকাসহ যেসব স্থানে বিএনপি কর্মসূচি পালন করতে পারেনি সেটা দলটির সাংগঠনিক দুর্বলতাকেই স্পষ্ট করছে কি-না এমন প্রশ্নে জয়নুল আবদীন ফারুক দাবি করেন, এটা বরং আওয়ামী লীগেরই দুর্বলতাকে আবারো স্পষ্ট করেছে।
“স্বৈরাচাররা ক্ষমতায় থাকার জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে, রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে। এখানে আওয়ামী লীগের কোন ক্ষমতা নেই বিএনপিকে রাস্তায় ঠেকায়। রাষ্ট্রযন্ত্র নিরপেক্ষতা বজায় রাখুক, একদিনের জন্যও তারা ক্ষমতায় থাকতে পারবে না।”
ফলবিহীন আন্দোলনে লাভ কী?
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গত ষোল বছর ধরেই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আন্দোলন করে এসেছে বিএনপি। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের আন্দোলনেও পার হয়েছে এক যুগেরও বেশি সময়। এর মধ্যে একে একে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বিএনপি লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়নি।
সর্বশেষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপির যে আন্দোলন সেটাতেও তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারেনি।
কিন্তু নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর এখন এটা স্পষ্ট যে দাবি আদায় না হলেও বিএনপি আন্দোলন ধরে রাখতে চায়। কিন্তু সুস্পষ্ট ফল ছাড়া এমন কর্মসূচি ধরে রেখে বিএনপির অর্জন কী?
দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সহ-সম্পাদক রুমিন ফারহানা অবশ্য বলছেন, গণ-মানুষের যে দাবি এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা সেখান থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বিএনপি’র।
“এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে কারণ, বাংলাদেশের আঠারো কোটি মানুষ বিশ্বাস করে যে গত সাতই জানুয়ারি বাংলাদেশে আসলে কোনো নির্বাচন হয়নি এবং মানুষের যে ভোটের অধিকার সেটাও তারা প্রয়োগ করতে পারেনি। সে কারণেই এই কর্মসূচি জারি থাকা মানা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে থাকা, মানুষের দাবির পাশে থাকা।”
“আমরা আজকেই একটা কিছু করবো, কালকেই এটার ফল পাওয়া যাবে – এমনটা নাও হতে পারে। কিন্তু একটা বিষয় পরিস্কার যদি আমাদের দাবি জনগণের দাবি হয় এবং ন্যায্য দাবি হয়, তাহলে সেটা আজকে হোক কিংবা কালকে হোক অজির্ত হবেই”, বলছিলেন রুমিন ফারহানা।
বিএনপি বলয়ের বাইরে থাকা দলগুলোও আন্দোলন করবে
যুগপৎ আন্দোলনে থাকা জামায়াতসহ সমমনা অন্যান্য দল যেমন আছে, তেমনি যুগপৎ আন্দোলনে নেই এমন কিছু বাম দলও আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে।
বিএনপি মনে করছে, নির্বাচন বর্জনকারী সব দল কর্মসূচিতে থাকলে সেটা আন্দোলনে গতি সঞ্চার করবে।
অন্যদিকে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ধরে রাখতে পারলে, দ্রব্যমূল্যসহ অর্থনীতি নিয়ে বেকায়দায় থাকা সরকারের জন্য ‘জন রোষ’ সামাল দেয়া কঠিন হবে। ফলে নির্বাচনের পরে বিএনপির এখনকার কর্মসূচিতে দ্রব্যমূল্য এবং অর্থনৈতিক সংকট একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাজেন্ডা হিসেবেই উঠে আসছে।
তবে দলটি চায় ভোট বর্জনকারী সবগুলো দলই আন্দোলনে থাকলে সেটা বাড়তি সুবিধা দেবে।
জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যেই যুগপৎ ধারায় আলাদাভাবে কর্মসূচি পালন করছে। গণঅধিকার পরিষদও মাঠে আছে। আছে গণতান্ত্রিক মঞ্চসহ সমমনা জোট। এর বাইরে বামপন্থী সাতটি দলের ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’ও ‘গণতন্ত্র এবং ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা’র আন্দোলন শুরুর কথা জানিয়েছে।
বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক রুহিন হোসেন প্রিন্স বিবিসিকে বলেন, সরকার বিরোধী আন্দোলনে তাদের জোট নিজেদের মতো করেই অংশ নেবে।
“আমরা বলছি যে চলমান দুঃশাসন এবং একক কর্তৃত্ববাদি শাসনের অবসানের জন্য যার যার অবস্থান থেকে দলগুলো রাজপথে নামুক। কেউ ডানপন্থী অবস্থান থেকে করবে, কেউ বামপন্থী অবস্থানে থেকে করবো। তবে এখানে একটা বিষয় স্পষ্ট যে আমরা একদফায় থাকবো না। দ্রব্যমূল্যসহ জনজীবনের ইস্যু, তার সঙ্গে ভোটাধিকার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এই লক্ষ্যে আমরা পুরো সংগ্রামকে অগ্রসর করবো।”
কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে ভোট বর্জনকারী দলগুলোর আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলেও এই আন্দোলনে খুব একটা জোর দেখছেন না রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন।
তিনি বলেন, যখন একটা দল চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসে তখন তার দাপট অনেক বেশি থাকবে এটাই স্বাভাবিক। এর বিপরীতে বিরোধী দলগুলো যে কারণেই হোক সেরকম শক্তিশালী নয় এখন।
“বিএনপি বলুন কিংবা বাম মোর্চা তারা সেভাবে আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা পায়নি। এবং এ মুহূর্তে বিএনপিও কিছুটা অসংগঠিত। নতুন কোনো নীতি কৌশল সেভাবে তারা নির্ধারণ করতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে। ফলে এমন অবস্থায় এসব দলগুলো সরকারের জন্য বড় কোনো চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। দলের কর্মসূচিকে নিজের কর্মসূচি মনে করে জনগণ বের হয়ে আসবে – এমন পরিস্থিতিতে আন্দোলন নিয়ে যাওয়ায় মুন্সিয়ানার উপর নির্ভর করবে তারা সরকারকে কতটা চ্যালেঞ্জ দিতে পারবে।”
জোবাইদা নাসরীনের মতে, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে। অর্থনীতি নিয়ে সরকারও বেকায়দায় আছে। ফলে এসব বিষয় সামনে এনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।
বিএনপি ২০২২ সালে সরকার বিরোধী আন্দোলনের যে সূত্রপাত করেছিলো, সেখানে শুরুতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো জনসম্পৃক্ত দাবিগুলো সামনে নিয়ে এসেছিলো দলটি।
একপর্যায়ে সেখান থেকে একদফা আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সেই একদফা আন্দোলন কার্যত ব্যর্থ হওয়ার পর এখন আবারো দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মতো জনসম্পৃক্ত দাবিগুলো তুলে ধরতে চায় বিএনপিসহ ভোট বর্জনকারী দলগুলো।
কিন্তু এটি কতটা জোরালো রূপ পাবে, আপাতদৃষ্টিতে দলগুলোর অসংগঠিত অবস্থা দেখে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মধ্যেই।