বাংলাদেশে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আগামী রোববার সকাল ছয়টা থেকে আবারো ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এটি চতুর্থ দফায় তাদের ডাকা অবরোধের কর্মসূচি। দুই দিন বিরতি দিয়ে আগামী রবিবার থেকে ফের দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের ডাক দিয়েছে বিএনপি।
ঢাকাঃ আজ বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) বিকেলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এই ঘোষণা দেন। এটি বিএনপিসহ বিরোধী দলসমূহের চতুর্থ দফার অবরোধ কর্মসূচি। এ ছাড়া আগামীকাল মসজিদে মসজিদে দোয়া মাহফিল করবে দলটি। রোববার থেকে চতুর্থ দফায় ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধ ডেকেছে বিএনপি। চতুর্থ দফায় অবরোধের বিকল্প হিসেবে হরতালের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত অবরোধের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপির হাইকমান্ড। সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে দেশব্যাপী তৃতীয় দফার অবরোধ কর্মসূচি চলছে। ৪৮ ঘণ্টার চলমান এই অবরোধ আগামীকাল শুক্রবার ভোর ৬টায় শেষ হবে।
এর আগে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ড ও নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার এবং সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ২৯ অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ডাক দেয় বিএনপি। হরতালের পর বিএনপি ও সমমনা দলগুলো ৭২ ঘণ্টার অবরোধের ঘোষণা দেয়। এরপর ৩ ও ৪ নভেম্বর বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ দেওয়া হয়। সেই অবরোধ শেষ হলে ৭ নভেম্বর বিরতি দিয়ে ৮ নভেম্বর থেকে আরো ৪৮ ঘণ্টা টানা অবরোধ পালনের ঘোষণা দেয় বিএনপি।
বাংলাদেশে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনরত বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আগামী রোববার সকাল ছয়টা থেকে আবারো ৪৮ ঘণ্টার সর্বাত্মক অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এটি চতুর্থ দফায় তাদের ডাকা অবরোধের কর্মসূচি।
বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফায় ডাকা দুদিনের অবরোধের শেষ পর্যায়ে নতুন এ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
“শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্তি ও পরিত্রান পেতে এক দফার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত অবরোধ চলবে,” এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বলছিলেন তিনি।
এদিকে তৃতীয় দফা ডাকায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের দ্বিতীয় দিনে বৃহস্পতিবার স্বল্প আকারে দূর পাল্লার যান চলাচল শুরু হয়েছে।
তবে যাত্রী সংখ্যা খুবই কম। দূর পাল্লার পরিবহন মালিকরা বলছেন, নানা ধরণের ‘নির্দেশনার কারণে’ যাত্রী কম থাকলেও বাধ্য হয়ে পরিবহন চালাতে হচ্ছে তাদের।
সকালে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গেলে পরিবহন মালিকদের সাথে কথা বলে এই তথ্য জানা যায়। তারা বলছেন, স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক কম যাত্রী থাকলেও বাস চলাচল চালু রাখার ‘নির্দেশনা’র কারণে গাড়ি ছাড়ছেন তারা।
সুগন্ধা পরিবহনের মালিক লিটন কাজী বলেন, “এখন নির্দেশনার কারণে গাড়ি চালাইতে হইতেছে, ব্যানারের স্বার্থে গাড়ি চালাইতে হইতেছে।”
গাড়ি ছাড়তে তারা বাধ্য হচ্ছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “বাধ্য হইলো, একদিকে ব্যানার, একদিকে সরকারের নির্দেশনা, গাড়ি চালাইতে অইবো, এইটা নিয়া গাড়ি চালাইতে অয়।”
“ক্ষতি অর্থে ঠিক আছে, সরকারতো গাড়ি চালাইতে কইতাছে, দেশে তো বিরোধীদলরা হরতাল ডাকছে, যার যার স্বার্থে তারা কথা বলে। আমরাও আমাদের ব্যবসার স্বার্থে গাড়ি চালাইতাছি।”
মি. কাজী বলেন, সকালে তার একটি গাড়ি ছেড়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে ৫-৬টি গাড়ি ছেড়ে গিয়েছে। সব কাউন্টার মিলিয়ে ১৬ জন যাত্রী হয়েছে। আর ছয়টি গাড়ি মিলে ৫০ জনের মতো যাত্রী হয়েছে বলে জানান তিনি।
স্বাভাবিক সময়ে ৪০ সিটের গাড়িতে ৩২-৩৫ জন যাত্রী থাকে। তবে বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে যাত্রী বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি।
রাজধানীর সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বিবিসির সংবাদদাতা শাহনেওয়াজ রকি জানান, ওই বাস টার্মিনালটি থেকে কিছু বাস ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে।
এসব পরিবহন দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলাগুলোতে যানবাহন চলাচল করে থাকে। এসব জেলার দিকে চলা উদ্দেশ্যে কয়েকটি বাস ছেড়ে যেতে দেখেছেন তিনি। তবে এসব বাসে যাত্রী সংখ্যা ছিল হাতে গোনা।
বাসের কর্মচারীরা বলছেন, সকালে যেসব বাস ছেড়ে গেছে সেই বাসগুলোতে সাত-আট জনের বেশি যাত্রী নেই। এরপরও বাস চলাচল শুরু করেছেন তারা।
বাস অপারেটর মো. দোলন হাওলাদার বলেন, আজ ৫টি গাড়ি ছেড়েছে তারা। সবগুলো গাড়িতেই যাত্রী কম ছিল। তিনিও বলেন, গাড়ি ছাড়ার জন্য ‘নেতাদের’ নির্দেশ রয়েছে তাদের।
“নেতারা তো বলছেই গাড়ি ছাড়তে, নেতারা না বললে কি আমরা গাড়ি ছাড়তে পারি? যাত্রী কম অইলেও ছাড়তে অইবে।”
টার্মিনালে বাস অপারেটররা বলছেন, যাত্রী না থাকলেও বাস চলাচলে বাধ্য হচ্ছেন তারা। কারণ পরিবহন মালিক সমিতি তাদেরকে বাস চলাচল করাতে বাধ্য করছে।
গাড়ি চালক শাহীন হাওলাদার বলেন, “মালিক সমিতির নির্দেশ গাড়ি চালাইতেছি। আর আমরা তো মনে করেন খেঁটে খাওয়া মানুষ, করতেই হবে আমাদের এই কাজ, ভয় অবশ্যই আছে।”
অন্য সময়ে ২০ মিনিট পর পর গাড়ি ছাড়লেও বর্তমানে এক ঘণ্টা ২০ মিনিট পর পর গাড়ি ছাড়ছে বলে জানান তিনি।
অবরোধের কারণে যাত্রীবাহী বাসগুলো ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে রাতের বেলা পুলিশি পাহারায় চলে বলে জানান পরিবহন শ্রমিকরা।
পরিবহন শ্রমিক মো. সোহেল বলেন, বাসগুলা যে জায়গা থেকে ছাড়ে সেখান থেকে পুলিশ সুরক্ষা দিয়ে নিয়ে আসে। একসাথে বিভিন্ন কোম্পানির চার পাঁচটা গাড়ি ছাড়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে শেষের গাড়িটির পেছনে পুলিশ থাকে। এরা অর্ধেক রাস্তা এসে আবার আরেকটি পুলিশের গাড়ির কাছে হস্তান্তর করে।
“কুমিল্লা পর্যন্ত পুলিশ পোটাক(নিরাপত্তা) দেয়, এর পর আমরা চলে আসি। এরপর আর পোটাক দেয়া লাগে না।”
তবে অবরোধের সময় কম গাড়ি চলছে। গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার ভয়ে মালিকরাও খুব একটা গাড়ি ছাড়ে না বলে জানান তিনি।
মি. সোহেল বলেন, “মালিক চার পাঁচটার বেশি গাড়ি ছাড়ে না। একটা গাড়ি পুড়িয়ে দিলে মনে করেন যে এক কোটি ২০ লাখ টাকা মাইর। আবার আমাদের জীবন আর পরিবারও শেষ।”
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে স্বাভাবিক সময়ে বিভিন্ন জেলার উদ্দেশ্যে প্রতিদিন অন্তত ২০০০ হাজার বাস ছেড়ে যায়। কিন্তু অবরোধের সময় গত চব্বিশ ঘণ্টায় সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে আড়াইশোর মতো বাস ছেড়ে গেছে।
এদিকে রাজধানী ঢাকায় যান চলাচল গতকালের তুলনায় আজ বেড়েছে।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বিবিসির সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন, যেসব এলাকায় অফিস-আদালত বেশি সেসব এলাকায় গণপরিবহন অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি চলাচল করছে।
রাজধানীর মালিবাগ চৌধুরী পাড়া, প্রগতি সরণী, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, বসুন্ধরা এলাকা ঘুরে দেখা যায় যান চলাচল বেশ বেড়েছে। অফিসগামী এবং স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের চলাচলও তুলনামূলক বেশি ছিল। শ্যামলী, আঁগারগাও এবং মহাখালীর ওয়্যারলেস গেট এলাকায় হালকা যানজটও চোখে পড়েছে।
কমলাপুর ট্রেন স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, অবরোধের মধ্যেও ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বেলা দুই টা ২৫ মিনিটে রাজধানীর শাহজাদপুরে রায়দা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
এর আগে বৃহস্পতিবার ভোর রাত চারটা ৪৫ মিনিটে হাজারীবাগের বেরিবাঁধ এলাকায় ভিআইপি পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হয়। এছাড়া সকাল পৌনে ছয় টার দিকে মিরপুর-১৩ নম্বর এলাকায় প্রজাপতি পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হয়।
বুধবার থেকে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত মোট ১৩টি যানবাহনে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সাতটি বাস, ৪টি কাভার্ড ভ্যান এবং দুইটি ট্রাক রয়েছে।
ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের কর্মকর্তা তালহা বিন জসিম জানান, রাজধানী ঢাকায় মোট পাঁচটি যানবাহন এবং গাজীপুরে তিনটি যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে।
এছাড়া ঢাকার বাইরে খাগড়াছড়িতে একটি, বগুড়ায় একটি, বরগুনায় দুটি, নোয়াখালীতে একটি যানবাহনে আগুন দেয়ার খবর দিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।
সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ভোর রাত পৌনে দুই টার দিকে গাজীপুরের শ্রীপুরে একটি কাভার্ড ভ্যানে আগুন দেয়া হয়।
রাত দুইটায় নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আমিনবাজার এলাকায় একটি ট্রাকে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।
প্রথম দিনের চিত্র কেমন ছিল?
বিএনপি বুধবার থেকে যে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ ডেকেছে এটি এই দলটির দুই সপ্তাহের ডাকা তৃতীয় দফার অবরোধ কর্মসূচি।
এর মধ্যে বুধবার রাজধানীতে যান চলাচল থাকলেও দূর পাল্লার পরিবহন ছেড়ে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
এদিন সন্ধ্যার পরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় বাস ও ট্রাকে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে।
ফায়ার সার্ভিস জানায়, বুধবার রাত আটটার দিকে ঢাকার বনানী এলাকার কাকলী পুলিশ ফাঁড়ির সামনে একটি মিনি বাসে আগুন দেয়া হয়।
এর আগে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড় এলাকায় আকাশ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়া হয়।
খবর পেয়ে সদরঘাট ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
ঢাকার বাইরে আরো কয়েকটি জেলায় বাস ও ট্রাকে অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বগুড়ার শিবগঞ্জে রাত নয়টার কিছু আগে একটি ট্রাকে আগুন দেয়া হয় বলে নিশ্চিত করে ফায়ার সার্ভিস।
এছাড়া দক্ষিণাঞ্চলীয় বরগুনা জেলার আমতলী এলাকায় হাড় পাঙ্গাসিয়ায় রাত সাড়ে নয়টার দিকে সাকুরা পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয়ার ঘটনা ঘটে।
এখানেও ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
তবে এসব ঘটনার কোনটিতেই কাউকে চিহ্নিত বা আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বগুড়ায় জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া আর খাগড়াছড়িতে একটি কাভার্ডভ্যানে আগুন দেয়ারও ঘটনা ঘটে।
বুধবার ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্ন জায়গায় মিছিল করে বিএনপি ও তাদের যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দলগুলো।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে দলটি ঢাকায় ২৮শে অক্টোবরের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালন করে আসছে।
উনত্রিশে অক্টোবর হরতালের পর ৩১শে অক্টোবর থেকে দোসরা নভেম্বর পর্যন্ত প্রথম দফায় তিনদিনের সর্বাত্মক অবরোধ পালন করেছিলো বিএনপি। এরপর দু দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনের পর ৫ই ও ৬ই নভেম্বর আবারো অবরোধ পালন করে দলটি। সাতই নভেম্বর বিরতি দিয়ে বুধবার থেকে আবার দুদিনের অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে দলটি।
বিএনপি ছাড়াও তাদের যুগপৎ আন্দোলনে থাকা কিছু সমমনা দল ছাড়াও জামায়াতে ইসলামিও গতকাল ও আজ সর্বাত্মক অবরোধ পালনের ঘোষণা দিয়েছে।
এর আগে হরতাল-অবরোধ চলার সময় সারাদেশে যাত্রীবাহী বাসসহ বেশ কিছু যানবাহনে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।