“কোনো কিছুতেই আমরা বিচলিত নই। নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন, আদালত সবই আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়েছে। ফলে কবে তফসিল হলো, আর কবে নির্বাচন- এ নিয়ে আমরা ভাবছি না। আমাদের আন্দোলনের কর্মসূচি হবে ১৯৯৬ সালের চেয়েও কঠিন। ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে জাতীয় পার্টি আর জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তখন আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ। নতুন ধারায় সামনে সেই আন্দোলন দেখবেন,” এ কথা বলেছেন বিএনপির অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিন ৩০ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার। এমন সময়ে হরতাল আর অবরোধের রাজনীতিতে আটকে আছে বিএনপিসহ আরো কিছু বিরোধী দল। সামনের দিনে তারা কী ধরনের কর্মসূচির কথা ভাবছেন? জনগনকে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন কিনা?
‘কোনো কিছুতেই আমরা বিচলিত নই’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশে ভার্চুয়ালি কর্মসূচি ঘোষণা করছেন সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ। তবে সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই এখন কারাগারে। সহসাই তাদের জামিন হবে এমন কোনো তথ্যও নেই দলটির নেতা-কর্মীদের কাছে।
গত ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশের আগে বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের মধ্যে যে সক্রিয়তা ও উচ্ছ্বাস ছিল, এখন তাতে ভাটা পড়েছে। হরতাল ও অবরোধের টানা কর্মসূচিতেও মিছিল তেমন চোখে পড়ছে না। রাজধানী ঢাকায় সেরকম কোনো তৎপরতা নেই তাদের, দলটির প্রধান কার্যালয়েও ঝুলছে তালা। দৃশ্যত গ্রেপ্তারের ভয়ে সেখানে যান না কোন নেতা-কর্মী।
এ অবস্থায় বিএনপির আন্দোলন কোন পথে যাচ্ছে? তৃণমূলেই বা কী বার্তা যাচ্ছে? মাগুরার শালিখা উপজেলার বিএনপি কর্মী তাহেরুল ইসলাম হতাশা নিয়েই ডয়চে ভেলেকে বলেন, “বিএনপি ক্ষমতার বাইরে ১৭ বছর। নির্বাচন আসলে বয়কট করবেন- এটা তো হতে পারে না। সরকারকে ফ্যাসিস্ট বলেও শুধু নির্বাচন বর্জনে কি সমাধান আসবে? নিশ্চয় নয়। কৌশল যেটা তারা, নিচ্ছেন তার বিকল্প থাকতে হবে। এবার দেখা গেছে সরকারের ক্র্যাকডাউনে নেতারা সব আত্মগোপন চলে গেলেন, অনেকে গ্রেপ্তার হলেন। তাহলে তৃণমূলের প্রতি বার্তাটা কী? সেটা আমরা কিছুই জানতে পারছি না। আগে রাতে বাড়িতে ঘুমাতাম, আর এখন পালিয়ে থাকি। এভাবে তো রাজনীতি হয় না।”
এদিকে বিএনপির টানা কর্মসূচির মাঝে অফিস-আদালত চলছে। দূরের পথে যাত্রীবাহী বাস চলাচলে ব্যহত হলেও পণ্য সরবরাহ অনেকটাই স্বাভাবিক। এবার ব্যবসায়ীদের থেকেও রাজনৈতিক সমঝোতার ডাক সেভাবে আসছে না। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের দৌঁড়ঝাপ ছাড়া আগের বছরগুলোর মতো কূটনীতি পাড়ার তৎপরতাও খুব একটা চোখে পড়েনি।
তবে বিএনপির প্রশিক্ষন বিষয়ক সম্পদক এ কে এম মোশারফ হোসেন ডয়চে ভেলেকে বলেন, “মানুষ আমাদের কর্মসূচিতে যথেষ্ট সাড়া দিয়েছে। দৈনন্দিন প্রয়োজনে মানুষকে ঘর থেকে বের হতে হয়। এর অর্থ এই নয় যে, তারা কেউ কর্মসূচি পালন করছেন না। সারা দেশে আওয়ামী লীগ যেভাবে পুলিশ-প্রশাসন সাজিয়ে রেখেছে তাতে নির্বাচনে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না। এমনকি আওয়ামী লীগের সঙ্গে যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে যাচ্ছে তাদের অনেকেই সুষ্ঠু ভোট নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। আমরা নির্দলীয় কোনো সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচনে যাবো না। দেশের মানুষকে সঙ্গে নিয়েই আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো। ফ্যাসিস্ট এই সরকারের পতন হবেই।”
বিএনপি নেতাদের দাবি, সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার অব্যহত চাপ ও প্রলোভন এখনও বিএনপির প্রভাবশালী কোনো নেতাকে টলাতে পারেনি। চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা সৈয়দ এ কে একরামুজ্জামান, নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহ মো. আবু জাফর, মরহুম শাহজাহান সিরাজের মেয়ে সারওয়াত সিরাজ শুল্কা, খন্দকার আহসান হাবিব ও এ কে এম ফখরুল ইসলামসহ কয়েকজন নীতিভ্রস্ট হয়েছেন। আর দলের বহিস্কৃত কিছু নেতা বিএনএম বা তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন। তারা দলের গুরুত্বপূর্ণ কোন দায়িত্বে নেই। নেতাদের ধরে রাখাকে এক ধরনের সফলতা বলে মনে করছেন তারা।
বিএনপির আন্দোলনে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে জানতে চাইলে দলটির সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কেন্দ্রীয় নেতারা আলোচনা করে সেটা ঠিক করবেন। তবে এটা নিশ্চিত যে জনবান্ধব কর্মসূচি দেওয়া হবে। দেশের সাধারণ মানুষ বিএনপির কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। হরতাল-অবরোধে প্রয়োজন ছাড়া কেউ বের হন না। যাত্রীর অভাবে দূরপাল্লার গাড়ি চলে না। এটা মানুষের সমর্থনের কারণে সম্ভব হয়েছে। বুধবার বাসা থেকে বের হওয়ার পর ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাত্রদল সভাপতি ফজলুর রহমান খোকনকে ধরে পুলিশে দিয়েছে। এ থেকে তো বোঝা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ-পুলিশ সব একাকার হয়ে গেছে। কর্তৃত্ববাদী এই শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মানুষ রাজপথে নামবেই। শুধু সময়ের অপেক্ষা।”
গত ৮ নভেম্বরের বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমেদ সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, তিনি মনে করেন-তার দলের ভোটে যাওয়া উচিত। বিএনপির এই নেতা মনে করেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জন করাটাই ভুল ছিল।তিনি বলেন, ‘‘সশস্ত্র প্রতিরোধের সামনে নিরস্ত্র ব্যক্তি কতটুকু করতে পারে? আমি মনে করি বিএনপির এই নির্বাচনে যাওয়া উচিত।”
বিএনপির সঙ্গে রাজপথে আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলোকেও এখন আর রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। তাদের কেউ গ্রেপ্তার না হলেও কোনো ধরনের সভা-সমাবেশে তারা অংশ নিচ্ছেন না। বিরোধীদের আন্দোলন কোন দিকে যাচ্ছে- জানতে চাইলে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা জোনায়েদ সাকি ডয়চে ভেলেকে বলেন, “যে আন্দোলন চলছে, সেটা চলবে। সরকার তামাশার একটি নির্বাচন করতে যাচ্ছে। সেখানেও এর প্রতিফলন দেখবেন। এরশাদ ৯ বছর শাসন করেছে। কিন্তু জনগণ কি তাকে মেনে নিয়েছে? নেয়নি। এক সময় এরশাদের পতন হয়েছে। এই সরকারকেও মানুষ মেনে নেয়নি, তাদেরও পতন হবে। আমরা আন্দোলনের নানা ধরনের দিক নিয়ে আলোচনা করছি, সামনের দিনে তার প্রতিফলন দেখা যাবে।”
বিএনপির সঙ্গে না থাকলেও পৃথকভাবে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। সিপিবির নেতৃত্বে এই জোটে কয়েকটি বাম দল রয়েছে। আন্দোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স ডয়চে ভেলেকে বলেন, “কেউ কেউ আন্দোলন করছে সরকারের পতনের জন্য। আর আমরা আন্দোলন করছি, সরকারের পতন ছাড়াও ব্যবস্থা বদলের জন্য। এই ৫২ বছরে জনগণ দেখেছে অনেক দল ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু ব্যবস্থা বদল হয়নি। জনগণের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। কোনো আন্দোলন সফল হয়, যখন জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। আমরা এখন পর্যন্ত জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, ব্যবস্থার বদল না হলে শুধু সরকার পরিবর্তনে তাদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হবে না। সেটা জনগণ বুঝতে পেরেছে। এখন কাজ হলো তাদের রাস্তায় নামানো। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।”