ঢাকাঃ বাংলাদেশ এখন কূটনীতিবিদদের পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠেছে। আজ বাংলাদেশ সফরে এলেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। এরপর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন দিল্লিতে জি-২০ সম্মেলনে যোগ দিতে। সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোসহ বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার হবার কথা রয়েছে। এরপরই বাংলাদেশ সফরে আসবেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। সবকিছু মিলিয়ে এই কূটনৈতিক তৎপরতার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য রয়েছে। তা হলো- বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সম্পূর্ণ মিশনে রয়েছে। তারা বারবার বলছে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন হতে হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক। অর্থাৎ এই নির্বাচনে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে অংশগ্রহণ করতে হবে। আর সেটি যদি না করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের নির্বাচনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গ্রহণযোগ্যতা দেবে না, এটি মোটামুটি নিশ্চিত। আর এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন ভিসা নীতিও ঘোষণা করেছে। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ রাশিয়া, চীন, ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশের সাথে আলাদা করে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে এবং তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সফরে এলেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। প্রশ্ন হচ্ছে মার্কিন মিশন কি রুখতে পারবে রাশিয়া, চীন বা ফ্রান্স? বাংলাদেশ কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলকে অন্যান্য দেশগুলোর মাধ্যমে প্রতিহত করতে পারবে?
রাশিয়া এখন বিশ্ব কূটনীতিতে অনেকটাই একঘরে হয়ে পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর প্রায় বন্ধুহীন রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে চীন। তাছাড়া রাশিয়া এখন নানারকম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও হাবুডুবু খাচ্ছে। এ অবস্থায় ল্যাভরভের বাংলাদেশ সফর যতটা না বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বন্ধুত্বের খোঁজেই রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছেন। একাত্তরে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পরীক্ষিত বন্ধু। আর তাই এখন যেন মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক অটুট রাখে, সেটি ল্যাভরভের সফরের প্রধান উদ্দেশ্য। তবে রাশিয়া -ইউক্রেন যুদ্ধের পর বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই একটি নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং একাত্তরের বন্ধুত্বের মর্যাদা রক্ষা করেছে। আর সে কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর কিছুটা হলেও ক্ষুব্ধ, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পদক্ষেপে। কিন্তু বাংলাদেশ ঝুঁকি নিয়েও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছে এবং রাশিয়ার প্রতি বাংলাদেশের বন্ধুত্বের ঋণ শোধ করার জন্য বাংলাদেশ এখনো সজাগ, সচেতন এবং সক্রিয়। এরকম বাস্তবতায় রাশিয়া যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশন খুব একটা রুখতে পারবে এমনটি নয়।
চীন বাংলাদেশের ব্যাপারে সরাসরি এবং স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেছে। চীন জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তারা হস্তক্ষেপ করবে না। চীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়, গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতা চায় এবং বর্তমান সরকারের সঙ্গে তাদের যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক সেটাকে এগিয়ে নিতে চায়। তার অর্থ এটাই যে, চীন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের ব্যাপারে একমত নয়। তাছাড়া বৈশ্বিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরস্পর মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় চীনের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক পরাজয় সকলেরই জানা। এই বাস্তবতায় চীন আগামী নির্বাচনে মার্কিন কৌশল ঠেকাতে কতটুকু কাজ করবে?
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছে, চীনের সহায়তায় বাংলাদেশের অর্থনীতি বড় ধরনের ধাক্কা থেকে রক্ষা পাবে বটে, তবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মার্কিন অভিপ্রায় বন্ধ করার ক্ষেত্রে চীন খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে না।
আর ফ্রান্স এখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর শক্তি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিন্ন অবস্থান নিয়ে কাজ করছিল। তবে বাংলাদেশের ব্যাপারে তাদের ভিন্ন অবস্থান সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় এমানুয়েল মাখোঁ বাংলাদেশ সফর করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই সফরের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে একটি আলাদা অবস্থান গ্রহণ করবে। সেটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক হবে।
তবে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দেশগুলোর চেয়ে সবচেয়ে বড়ো ফ্যাক্টর হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত। এই দুটি দেশের ভূমিকা কি হবে তার উপরে নির্ভর করছে বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ।