সম্প্রতি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের পরাজয়ের পর যেভাবে বাংলাদেশি সমর্থকদের একাংশ প্রকাশ্যেই আনন্দোল্লাস প্রকাশ করেছেন এবং ভারতীয়রাও অনেকেই তাদের ‘অকৃতজ্ঞ’ বলে পাল্টা গালমন্দ করেছেন, তা থেকেও বোঝা যায় এই মানসিকতাটা উভয় দেশের জাতীয় জীবনের অনেক গভীরেই শিকড় বিছিয়েছে।
ইস্যুটা হয়তো ঘন ঘন পাল্টে যায় – কখনো সেটা ক্রিকেট, কখনো বা রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ – কখনো আবার তিস্তার জল, পেঁয়াজ কিংবা সীমান্তে বিএসএফের গুলি – কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে ক্ষোভের ঢেউ কিন্তু থেমে থাকে না। ভারতেও তার প্রতিক্রিয়া হয় যথারীতি।
বিশেষ করে বাংলাদেশে নির্বাচনের মরশুম এলেই সেখানে ভারতের ভূমিকা নিয়ে তর্কবিতর্ক বাড়ে – আর তখনই সোশ্যাল মিডিয়াতে দিল্লির বিরুদ্ধে নিন্দেমন্দর ঝড় বয়ে যায়।
এই সব ক্ষোভ ও অসেন্তাষের কারণগুলো কতটা সঙ্গত তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, বাংলাদেশে জনসংখ্যারই বা ঠিক কত শতাংশ ভারতের বিরোধিতায় সরব সে প্রশ্নও উঠতে পারে – কিন্তু ভারতের বিরুদ্ধে, বা আরও নির্দিষ্ট করে বললে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের বাতাবরণ যে একটা তৈরি হয়ে গেছে তা নিয়ে সংশয় নেই।
এখন প্রশ্ন হল, ভারত সরকারের নীতি-নির্ধারকরা তাদের ঘরের পাশে ‘বন্ধু’ দেশে এই সমালোচনার স্রোতকে কী দৃষ্টিতে দেখেন?
হতে পারে দিল্লি সব জেনেবুঝেও এই ক্ষোভ-বিক্ষোভগুলো ‘অ্যাড্রেস’ করার জন্য বিশেষ কিছুই করতে পারে না। কিংবা তারা বিষয়টা পুরোপুরি উপেক্ষা করার নীতি নিয়ে চলে, সেটাও বোধহয় খুবই সম্ভব।
হয়তো দিল্লি মনে করে যতক্ষণ বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভারত সরকারের ঘনিষ্ঠতা বা সুসম্পর্ক আছে এবং সে দেশে ভারতের স্বার্থগুলো ভালভাবে রক্ষিত হচ্ছে ততক্ষণ এদিকে নজর দেওয়ার কোনও প্রয়োজনই নেই।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জটিল ম্যাট্রিক্সে এই রসায়নটা আসলে ঠিক কী, তা জানতেই বিবিসি বাংলা কথা বলেছে দিল্লির কূটনৈতিক মহলের শীর্ষ কর্মকর্তা, সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বিশ্লেষকদের সঙ্গে।
জানার চেষ্টা করেছে ঢাকার কূটনৈতিক মহল এক্ষেত্রে দিল্লির মনোভাবটা কীভাবে ব্যাখ্যা করেন, সেটাও।
‘ভারত মোটেও উদ্বিগ্ন নয়’
ভারতের সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদ সৌমেন রায় দীর্ঘদিন ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে স্টাডি করেছেন, অবসর নেওয়ার পরও এখনো বাংলাদেশে তাঁর নিয়মিত যাতায়াত আছে।
বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে একটা শ্রেণী যে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ, সেটা তিনি মোটেই অস্বীকার করেন না।
“কিন্তু এরা সে দেশের কতজন? কতজন ফেসবুকে এসে ভারতকে গালমন্দ করছেন? আমি বিশ্বাস করি এর বাইরেও বাংলাদেশে একটা ‘সাইলেন্ট মেজরিটি’ বা নীরব সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ আছেন যারা ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে মর্যাদা দেন এবং ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চান”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সৌমেন রায়।
যেভাবে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি চিকিৎসা থেকে পর্যটন, নানা প্রয়োজনে ভারতে আসছেন এবং সেই সংখ্যাটা ক্রমশই বাড়ছে – সেটাকে ওই ‘গুডউইলে’র প্রতিফলন বলেই মনে করেন তিনি।
“তাই বলে কি সেখানে ভারত বিদ্বেষ নেই? আছে। কিছু লোক ভারতের বিরুদ্ধে রোজ গলাও ফাটাচ্ছেন, অনেকে সেটাকে আবার ফুলিয়ে-ফাঁপিয়েও পেশ করছেন।”
“তবে আমার ধারণা ভারত এটা নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নয়। এগুলোর দিকে সতর্ক নজর রাখা হয় ঠিকই, কিন্তু এই আ্যান্টি-ইন্ডিয়া ‘বোগি’কে ভারত কিন্তু আদৌ বিশেষ গুরুত্ব দেয় না”, জানাচ্ছেন সাবেক ওই ভারতীয় রাষ্ট্রদূত।
শেখ মুজিবের হত্যাকান্ড থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদ – এই দু’দশকেরও বেশি লম্বা সময়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা স্থবিরতা এসেছিল, সে কথাও তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন।
সৌমেন রায়ের কথায়, “আজকের বাংলাদেশে তরুণ প্রজন্ম, যাদের অনেকেরই জন্ম সে সময়ে বা তার পরে, তাদের অনেকে হয়তো দু’দেশের সম্পর্কের মাত্রাটা ঠিক উপলব্ধি করতে পারেন না। উপরন্তু ভারতের বিরুদ্ধে তাদের উসকানি দেওয়ার শক্তিরও অভাব নেই।”
অবিকল একই কথার প্রতিধ্বনি করে ঢাকায় ভারতের সাবেক হাই কমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীও বলছিলেন, “এই যে ভারত বিরোধিতার কথা আপনি বলছেন, এটা কিন্তু মোটেও স্বত:স্ফূর্ত নয়।”
“কেউ নিজে থেকে এটা করছে না, বরং আমি তো বলব এটার বেশিটাই ইঞ্জিনিয়ার্ড – মানে বানানো।”
‘পাকিস্তান বা আমেরিকার মদতপুষ্ট’ একটা শ্রেণীই যে এই বিদ্বেষ ছড়ানোর কারিগর, তা নিয়েও মি চক্রবর্তীর মনে কোনও সংশয় নেই।
তাহলে কি দিল্লি মনে করে ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আসলেই কারও কোনও অসন্তোষ নেই? সবটাই কারসাজি করে তৈরি করা?
“না আমি তা বলছি না। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে একাত্তরের যুদ্ধেও সেখানে একটা বড় অংশ পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। তাদের উত্তরসূরীরাই নিশ্চয় সেই মানসিকতা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন”, বলছিলেন পিনাকরঞ্জন চক্রবর্তী।
তবে সোশ্যাল মিডিয়াতে যারা ভারতকে নিত্য গালমন্দ করছেন, তাদের ব্যাপারে সব দেখেশুনেও ভারত চুপচাপ হাত গুটিয়ে বসে আছে – এমনটা তিনি মনে করেন না।
“এটুকু বলতে পারি, আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়াতে কাউকে ট্রেস করা মোটেও কঠিন নয়। ভারতকে গালিগালাজ করে বাংলাদেশি যারা আবার সেই ভারতেরই ভিসার আবেদন করছেন তাদেরকেও নিশ্চয় আমাদের মিশনগুলো চিহ্নিত করে রাখছে।”, রীতিমতো জোর দিয়ে জানাচ্ছেন সাবেক এই জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক।
হাসিনা ‘পারফেক্ট’ নন, তবু …
বাংলাদেশে একটা শ্রেণীর মধ্যে ভারতের বিরুদ্ধে যে একরাশ অভিযোগ – তার মধ্যে সম্ভবত এক নম্বর হল, ভারতের সমর্থন ও সহযোগিতাতেই সে দেশে একটি ‘অগণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত’ সরকার এতদিন ধরে ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে পেরেছে।
ভারত নিজেকে বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র বলে দাবি করলেও কেন নিজের ঘরের পাশে সুস্থ গণতন্ত্রর চর্চা নিয়ে এত উদাসীন – এটা নিয়েও বাংলাদেশিরা অনেকেই নিয়মিত উষ্মা প্রকাশ করে থাকেন।
দিল্লিতে সিনিয়র ডিপ্লোম্যাটিক সংবাদদাতা জ্যোতি মালহোত্রা কিন্তু মনে করেন, “ভারত খুব ভালভাবেই জানে শেখ হাসিনা মোটেও পারফেক্ট বা নিখুঁত নন – কিন্তু ক্ষমতায় টিঁকে থাকতে তিনি যদি কোনও অগণতান্ত্রিক পন্থার আশ্রয়ও নেন, ভারত সেটা দেখেও না-দেখার ভান করবে।”
বিবিসি বাংলাকে মিস মালহোত্রা আরও বলছিলেন, “শেখ হাসিনা যে অনেক সময় প্রয়োজনের চেয়েও কঠোর হাতে দেশে শাসন করেন, মুক্ত সংবাদমাধ্যমের রাশ টেনে ধরেন, নির্বাচন কমিশনকে তার দলীয় লাইন মানতে বাধ্য করেন বা বিরোধী বিএনপি-কে ভাঙার চেষ্টা করেন – এগুলোর কোনওটাই ভারতের অজানা নয়।”
কিন্তু তারপরও এই সব ইস্যুতে ভারত কখনোই শেখ হাসিনাকে বিন্দুমাত্র চাপ দেয়নি, ঠিক যে কাজটা এখন আমেরিকা করছে।
এই সপ্তাহেই ভারতের একটি জাতীয় স্তরের সাময়িকীতে জ্যোতি মালহোত্রা তার এক নিবন্ধে এর কারণটাও ব্যাখ্যা করেছেন।
তিনি লিখেছেন, “ভারত এটা স্বীকার করে যে তাদের জন্য বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কোনও বিকল্প নেই। তিনি ভোটে হেরে গেলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে – এবং তাদের পিছু পিছুই আসবে ইসলামী মৌলবাদী শক্তি জামায়াতে ইসলামী। আর জামাত কোনওভাবে আবার ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করলেই তাদের মদতদাতা পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষই বকলমে চালকের আসনে বসবে।”
ফলে শেখ হাসিনা যেভাবেই ক্ষমতা আঁকড়ে থাকুন না কেন – তার সমালোচনায় কর্ণপাত করার কোনও অবকাশই ভারতের নেই, এটাই জ্যোতি মালহোত্রার যুক্তি।
এই কারণেই শেখ হাসিনাকে জিতিয়ে আনার জন্য বাংলাদেশে যারা ভারতকে দুষছেন, তাদের বক্তব্যকে ভারত কোনও আমলই দিচ্ছে না। বা বলা যেতে পারে, দিতে পারছে না।
সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সৌমেন রায় আবার এ প্রসঙ্গে আর একটি ভিন্ন যুক্তি দিচ্ছেন।
“ভারতে যেমন এই মুহুর্তে প্রধানমন্ত্রী পদে নরেন্দ্র মোদীর বিকল্প কোনও নাম নেই, তেমনি ভারত মনে করে বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার হাত থেকে নেতৃত্বের ভার নেওয়ার মতো যোগ্য কোনও মুখ উঠে আসেনি।”
”হ্যাঁ, এটাও ঠিক তাঁর ক্যাবিনেটে এমন অনেকেই আছেন যাদের বলা যেতে পারে দুর্নীতির ‘পোস্টার বয়’, আর দিল্লিও সেটা খুব ভালই জানে – কিন্তু তারপরও আসলে তাদের কিছু করার নেই।”
“ফলে শেখ হাসিনাকেই দিল্লি সমর্থন করবে, তাতে কে কী বলল দেখার দরকার নেই”, বিবিসিকে বলছিলেন মি রায়।
ভূরাজনীতিতে ‘কৃতজ্ঞতা’ আবার কী!
সোশ্যাল মিডিয়াতে এই বাংলাদেশ বনাম ভারত দ্বন্দ্বে আম ভারতীয়দের একটা বড় অংশের অভিযোগ হল, জাতি হিসেবে বাংলাদেশিরা ‘অকৃতজ্ঞ’ – কারণ একাত্তরে তাদের স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠায় ভারতের অবদানকে আজ তারা ভুলেই গেছে।
উল্টোদিকে এই বিতর্কে অনেক বাংলাদেশি পাল্টা যুক্তি দিয়ে থাকেন, একাত্তরের যুদ্ধে ভারত জড়িয়েছিল তাদের নিজেদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থসিদ্ধি করতেই – বাংলাদেশের প্রতি কোনও বিশেষ দরদ থেকে নয়।
তা ছাড়া সেই বাহান্ন বছর আগেকার তথাকথিত ‘কৃতজ্ঞতা’র দায় বাংলাদেশ আর কতদিন বয়ে বেড়াবে, এই বিতর্কে সে প্রশ্নও ঘুরেফিরেই ওঠে।
বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ম তৌহিদ হোসেনও মানেন, দুদেশের সম্পর্কে এই ‘কৃতজ্ঞতা ফ্যাক্টরে’র একটা ছায়াপাত থাকেই।
“আমার একটি বইতেও আমি লিখেছি জিওপলিটিক্সে এই ‘কৃতজ্ঞতা’র বোঝাই বোধহয় সবচেয়ে ভারী হয়। আর দুটো দেশের সম্পর্ক এরকম একটা ভারী বোঝাকে কতদিন আর টানতে পারে?” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকার এই সাবেক শীর্ষ কূটনীতিবিদ।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দরকার, এ কথা অবশ্য তিনিও মানেন। সেই সঙ্গেই স্বীকার করেন, অতীতে দুই দেশের তরফেই বেশ কিছু ‘ভুলচুক’ অবশ্যই হয়েছে – যার জন্য সীমান্তের দু’পারের মানুষের মধ্যেও সম্পর্ক কিছুটা বিষিয়ে গেছে।
তবে ভারতকে সমর্থনের প্রশ্নে বাংলাদেশে যে একটা বিভক্তি বরাবরই ছিল, তা স্বীকার করতেও মি হোসনের দ্বিধা নেই।
“এটা কিন্তু নতুন কিছু নয়। ’৭৪ সালে যখন আমরা ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র, তখনও দেখতাম ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হলে এস এম হল দু’ভাগ হয়ে যেত – একদল ভারতকে সমর্থন করলেও অন্যরা কিন্তু পাকিস্তানের জন্যই গলা ফাটাত।”
“তখন তো আর ফেসবুক নেই, বাংলাদেশের ক্রিকেট দলও নেই – কিন্তু তখনও এখানে ভারত, পাকিস্তান দু’দলেরই গোঁড়া সাপোর্টার ছিল”, বলছিলেন তৌহিদ হোসেন।
কিন্তু বাংলাদেশের ভারত-বিরোধী সমালোচনাকে দিল্লি কী চোখে দেখে বলে তাঁর পর্যবেক্ষণ?
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সরাসরি জবাব দেন, “ভারতের সরকারের ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশে মানুষের মাঝে ক্ষোভ আছে, তার কারণগুলোও চিহ্নিত করা কঠিন নয়। আর ভারত সেটা জানে না, এ কথাও আমি বিশ্বাস করি না।”
“কিন্তু তারপরও এগুলো নিয়ে কিছু করা হয় না কারণ রাজনীতিতে সবাই শর্ট টার্ম বেনিফিট বা স্বল্পকালীন ফায়দাটাই দেখে!”
“একটা কথা আছে না, রাজনীতিবিদদের দূরদৃষ্টি বড়জোর এক নির্বাচন থেকে আর একটা পর্যন্ত? এখানেও পরিস্থিতিটা তা-ই বলেই মানুষের এই সব ক্ষোভ-বিক্ষোভ আমলে নেওয়া হয় না”, বলছিলেন তিনি।
এই রাজনৈতিক স্বার্থটাই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বলে আর সব ফ্যাক্টর সেখানে তুচ্ছ হয়ে যায় – এটাই তৌহিদ হোসেনের অভিমত।
দিল্লিতে পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী আবার দাবি করছেন, “ভূরাজনীতিতে আসলে কৃতজ্ঞতা বলে কিছু হয়ই না। ফলে ভারত সেটা আশাও করে না!”
তিনি ভারতের পুরনো উদাহরণ দিয়েই বলছিলেন, “শীতল যুদ্ধের সময় ভারত রাশিয়া শিবিরের দিকে ঝুঁকে থাকলেও আমেরিকা কিন্তু আমাদের পিএল-৪৮০ গম পাঠাত। আমরা তখন খাদ্যে স্বনির্ভর নই, ফলে ওই গমের রুটি দিয়েই অনেক ভারতীয়র পেট ভরতো।”
কিন্তু সেই গম পাঠানোর জন্য ভারতীয়রা কোনও দিনই আমেরিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ধার ধারেনি।
“বরং উল্টে তখন বলা হত প্রেসিডেন্ট নিক্সন কি এমনি এমনি গম পাঠাচ্ছেন না কি? ভারতে না-পাঠালে গুদামে পচে নষ্ট হবে, তাই পাঠাচ্ছেন!”
একইভাবে বাংলাদেশেও যদি কেউ বলেন পাকিস্তান ভাঙার লক্ষ্য নিয়ে ভারত নিজের স্বার্থেই একাত্তরের যুদ্ধে জড়িয়েছিল, তার কথাকেও ফেলে দেওয়া কঠিন।
আসলে ‘কৃতজ্ঞতা’ নামক বস্তুটা ভূরাজনীতিতে থাকুক বা না-থাকুক – ভারত ও বাংলাদেশের মানুষে-মানুষে সম্পর্কে একটা স্পর্শকাতর উপাদান হিসেবে কিন্তু আজও রয়ে গেছে।
‘যৌথ পরিবার সিনড্রোম’
নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রথম মেয়াদে ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বাংলাদেশ সংক্রান্ত আ্যাফেয়ার্স দেখার দায়িত্বে ছিলেন বিজেপি নেতা ও সাবেক সাংবাদিক এম জে আকবর।
সে সময় দুদেশের মধ্যে কোনও একটা বিষয়ে তিক্ততা সৃষ্টি হলে সীমান্তের দু’পারেই ফেসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ গালিগালাজে ভেসে যাচ্ছিল।
তখন সে প্রসঙ্গে মি আকবর বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, “আসলে ভারতের যে কোনও পদক্ষেপকেই বাংলাদেশে কিছুটা সন্দেহ আর অবিশ্বাসের চোখে দেখা হবে এটা আমরা জানি। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই আমাদের চলতে হবে।”
পরিস্থিতিটা ব্যাখ্যা করার জন্য তিনি টেনে এনেছিলেন যৌথ পরিবারের তুলনা।
“ধরুন, একটা যৌথ পরিবারের বড় ভাইয়ের রোজগার, প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশি – তুলনায় ছোট ভাইদের উপার্জন বা দাপট অনেক কম।”
“তো সেখানে বড় ভাইয়ের প্রতিটা মুভকেই কিন্তু অন্যরা সন্দেহের চোখে দেখবে। তিনি একটা শরিকি বাগান সংস্কার করতে গেলেও ছোট ভাইরা ভাববে জমিটা বাগিয়ে নেওয়াই কি ওনার উদ্দেশ্য? এটা কিন্তু একরকম অবধারিত”, বলেছিলেন এম জে আকবর।
তাঁর বক্তব্য ছিল, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের অবস্থান আসলে সেই পরিবারের বড় ভাইয়ের মতো। আকারে, জনসংখ্যায়, অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তিতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের আসলে কোনও তুলনাই চলে না।
ফলে ভারতের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ বা বাংলাদেশে পদে পদে প্রশ্নও ওঠে – যেগুলোকে ভারত মোটের ওপর উপেক্ষা করেই চলে।
আজও যখন সোশ্যাল মিডিয়াতে বাংলাদেশের অনেকে ভারতকে আক্রমণে ভাসিয়ে দেন, সরকারের তরফে কখনোই সেগুলোতে প্রতিক্রিয়া জানানো হয় না।
পাশাপাশি বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেনও কিন্তু মনে করেন, “আকবরের এই যৌথ পরিবারের কথাটা আংশিক সত্য!”
“দুটো প্রতিবেশী দেশের মধ্যে একজন তুলনায় দুর্বল হলে তাদের মধ্যে সন্দেহ বাসা বাঁধবেই, এটা অস্বীকার করব না। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়।”
“কিন্তু আমার যেটা মাথায় ঢোকে না তা হল দুর্বলতর দেশ হিসেবে আমাদের না-হয় হীনমন্যতা বা কমপ্লেক্স তৈরি হতে পারে, কিন্তু অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে ভারতও কেন কমপ্লেক্সে ভুগবে?”, বিবিসিকে বলছিলেন মি হোসেন।
আমেরিকা তার ‘দুর্বল’ প্রতিবেশী মেক্সিকোকে যে ‘বদান্যতা’ দেখাতে পারে – ভারত কিন্তু এই অঞ্চলে ছোট ছোট প্রতিবেশীদের তার ছিটেফোঁটাও দেখায় না, সেটাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন তিনি।
আসলে দক্ষিণ এশিয়াতে ভারতের এই ‘দাদাগিরি’ বা অধিপত্যবাদী মানসিকতাই যাবতীয় সমস্যার মূলে, বাংলাদেশে সাধারণ মানুষ থেকে সুশীল সমাজের প্রতিনিধি – অনেকেই সে কথা বিশ্বাস করেন।
উল্টোদিকে ভারত নানা কারেণ গত অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই সব সমালোচনায় কান দেওয়ার কোনও প্রয়োজন বোধ করেনি – আর সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানেই চলেছে।
বিবিসি নিউজ বাংলা