বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে উঠেনি। ফলে এ খাতে লুটপাট বেড়েই চলেছে বলে দেশের একাধিক শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ বিবিসিকে তাদের অভিমত জানিয়েছেন। অনাদায়ী ঋণ, খেলাপি ঋণের ফলেই এ খাত ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ওই বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকাঃ বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে গত ১৫ বছরে অন্তত ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ শনিবার এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে।
অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে বের করে নেয়া এ অর্থ দেশের পরবর্তী অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশেরও বেশি।
অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকার ও এই খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, যে যে উপায়ে এ ধরনের বড় অনিয়মগুলো হচ্ছে তা রোধে সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যকর তদারকির অভাব রয়েছে।
কাগজে কলমে ক্ষমতা, নিয়ম-নীতি থাকলেও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের তা প্রয়োগের অভাব রয়েছে বলে তারা মনে করছেন। প্রভাবশালী বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ার কারণে এ সমস্যা আরো প্রকট হয়েছে।
তারা বলছেন, প্রভাবশালী ব্যক্তি বা রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে গিয়ে ব্যাংক খাতকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
তারা আরও পরামর্শ দিচ্ছেন, ‘আইনের চোখে সবাই সমান’ এই নীতি অনুসরণ করে প্রত্যেককে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। সংস্কার আনতে হবে পুরো ব্যাংক খাতে।
পারিবারিক প্রভাবের বলয় থেকে ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলো রক্ষা করতে আইনে পরিবর্তন, রাজনৈতিক দৃঢ়তা ছাড়া এ ধরণের অবস্থা থেকে উত্তরণ করা যাবে না বলেও মনে করেন অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সিপিডির প্রতিবেদনে শুধুমাত্র যেসব অনিয়ম উদঘাটিত হয়েছে সেগুলো এসেছে। কিন্তু যেসব কেলেঙ্কারি বা অনিয়ম প্রকাশিত হয়নি তার প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি।
উদাহরণ হিসেবে বলা হচ্ছে, জালিয়াতির বিভিন্ন ধরন রয়েছে। বেশির ভাগ জালিয়াতি হয় অস্তিত্বহীন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেয়ার ফলে।
আবার টাকা নিয়ে বিদেশে চলে যায়, আর ফেরত আসে না এমন ঘটনাও ঘটছে। অর্থনীতিতে এর প্রভাব অনেক বেশি।
ব্যাংকে বড় ঋণ অনিয়ম
বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে ২০২২ সালে ইসলামী ব্যাংকে। প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার ঋণ অনিয়মে এস আলম গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে সিপিডি-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এ ধরণের ঘটনার ফলে ইসলামী ব্যাংকগুলোর ওপর থেকে সাধারণ মানুষের আস্থা চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, সাধারণ জনগণ তাদের অর্থ তুলে নিয়ে যাচ্ছে এসব ব্যাংক থেকে। আর এই অবস্থা তৈরি হয়েছে জালিয়াতি চক্রের মাধ্যমে ঋণ দেয়ার ফলেই।
সরকার চেষ্টা করছে এসব ব্যাংক চলমান রাখতে। ব্যাংকিং খাতকে সংস্কার করা না হলে সরকারকেও ঋণ দিতে পারবে না এবং ব্যক্তিখাতের উদ্যোক্তাদের ও দেয়া যাবে না। ফলে এ খাতে সংস্কারের বিকল্প নেই।
এ ধরণের জালিয়াতির ফলে নন পারফর্মিং লোনের হার সরকারিভাবে প্রায় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারিভাবে এটাকে এক লাখ ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকা নন পারফর্মিং লোন দেখানো হচ্ছে।
কিন্তু মি. মনসুর জানাচ্ছেন এর প্রকৃত চিত্র এর আড়াই গুণ বেশি, প্রায় ২৫ শতাংশের মতো। এর বড় কারণ হচ্ছে ঋণ আদায় হয় না, কিন্তু পুন:তফসিল করে নেওয়া হয়।
আহসান এইচ মনসুর বলছেন, “যদি এই নন পারফর্মিং লোন আদায় করা না যায় তবে, এ অর্থগুলো পরবর্তীতে অন্য কাউকে ঋণ দেয়া যাচ্ছে না। ফলে ব্যাংকিং খাতের ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
অর্থনীতিবিদরা আরও বলছেন, যেসব অনিয়ম, জালিয়াতি প্রকাশ হয় সেসব ঘটনার অনুসন্ধান না হলে, শাস্তি না হলে এ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে। ব্যাংকের সম্পৃক্ত কর্মকর্তা বা বোর্ডের কেউ জড়িত থাকলেও ব্যবস্থা নিতে হবে।
তাদের অভিজ্ঞতা বলে, ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে যারা রয়েছেন তারা তাদের রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবেই এ ধরণের ঘটনা ঘটান। কারণ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাই পরিচালনা পর্ষদে রয়েছেন।
নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক রাজনৈতিক কারণে অনেক সময় অনেক কিছু করতে পারে না। তাই এ খাতকে সংস্কার করতে হলে এ বেড়াজাল থেকে বের হতে সরকারকে কঠোর মনোভাবের হতে হবে বলেও তারা জানাচ্ছেন।
আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার চাইলে অনেক কিছুই করতে পারে। তবে, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দৃঢ়তা খুব জরুরি। সরকার নিজেই এখন এ খাত থেকে ঋণ নিতে পারছে না।
তিনি বলছেন, “আমাদের আর্থিক খাত ছোট হয়ে যাচ্ছে। তাই সরকারকে কোন ব্যক্তিকে রক্ষা করে নয় বরং নির্মোহভাবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ পুরো আর্থিক খাতে সংস্কার করতে হবে।”
জবাবদিহিতার অভাব
বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে ২০০৮ সালে খেলাপি ঋণ ছিলো ২২ হাজার কোটি টাকা। যা এখন বেড়ে এক লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা হয়েছে।
আবার বিভিন্ন বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭০০-৮০০ কোটি ডলার পাচার হচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “ব্যাংকিং খাত এখন জিম্মি দশায় আছে। এ খাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়েছে।”
“বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্তৃত্ব কমে গেছে। যে ধরণের সুশাসন থাকার কথা তা কাগজে কলমে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তা প্রয়োগ করতে পারছে না”, বলছিলেন তিনি।
ধারাবাহিকভাবে অনিয়ম, ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটলেও এ ধরনের অবস্থার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তাদের হাতেই এ খাত ‘জিম্মি’ বলে মনে করছেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি মনে করেন, শুধু পরিচালনা পর্ষদেই রয়েছেন তারা তা নয়, রাজনীতির সাথে জড়িত বলেও প্রভাব বেশি বিস্তার করতে পারছেন তারা। ব্যাংকের নীতি কাঠামোও এখন তাদের হাতে।
মি. ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, জবাবদিহিতার প্রক্রিয়াটা এক অর্থে রাজনীতির হাতে জিম্মি হয়ে রয়েছে। এমনকি বিচারিক প্রক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্যাংকিং নীতি কাঠামোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
“আইনের চোখে সবাই সমান এমনভাবে এই জবাবদিহিতার পর্যায় তৈরি করতে হবে”, বলছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি
ঋণ অনিয়মের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ঋণ নেয়ার জন্য যে কাগজ দেয়া হচ্ছে বা মর্টগেজ দেয়া হয় তাতে ভুয়া দলিল ব্যবহার করা হয়। এমনকি ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে ঋণ পাওয়ার পর সরিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটে।
স্বাক্ষর নকল করে ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঋণের টাকা তুলে নেয়ার নজিরও রয়েছে। যে ধরনের নথি দেয়া হয় অনেক ক্ষেত্রে যাচাই করা হয় না। ফলে ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে।
আবার পরিচালনা পর্ষদ বা রাজনৈতিক চাপে যেসব বড় বড় অ্যামাউন্টের ঋণ দেয়া হচ্ছে সেগুলো ঋণখেলাপি হচ্ছে। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
অপরাধীরা এসব ক্ষেত্রে পার পেয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত শাস্তি হয়েছে এমন কোন উল্লেখযোগ্য উদাহরণ নেই। অথচ, পরিচালনা পর্ষদসহ ব্যাংক কর্মকর্তা প্রত্যেকেরই ঋণ অনিয়মে বা কেলেঙ্কারিতে ভূমিকা থাকে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বেলন, “বড় বড় বাণিজ্যিক গ্রুপগুলো ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব খাটায়। শুধু তাই নয়, রাজনৈতিক প্রভাবও এক্ষেত্রে খাটানো হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার ও শক্তিশালী করতে হবে। স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে।”
ব্যক্তি মালিকানার ব্যাংকগুলোতে পারিবারিক প্রভাব বিস্তারের কারণে সুশাসন নষ্ট হয় বলে মনে করেন ফাহমিদা খাতুন। আইন বা নিয়ম না মানার যে প্রবণতা তা এ অবস্থাকে আরো কঠিন করে তুলছে বলে তিনি মনে করছেন।
তাই ব্যক্তি মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে সুশাসন অত্যন্ত জরুরি। কারণ এখন দেখা যাচ্ছে এক ব্যাংকের মালিক অন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে । তাই পরিবর্তন আনতে হবে।
ফলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এ ধরনের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়া যাবে না।