নিউজ ডেস্কঃ বাংলাদেশের জনপ্রিয় কবি শামসুর রাহমান তাহার ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতায় লিখিয়াছেন, ‘এই নিয়াছে ঐ নিল যা! কান নিয়েছে চিলে,/ চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে’। গুজবের পিছনে ছুটিতে ছুটিতে আমাদের দশাও হইয়াছে তাহাই। এখন চারিদিকে দেখা যায় গুজবের ছড়াছড়ি। মানুষের তিলকে তাল করিবার প্রবণতার কারণে সেই গুজবে লাগে নিত্যনতুন রং ও মাত্রার ছোঁয়া। এক রানির বাচ্চা হইয়াছে; কিন্তু গায়ের রং কালো। রাজা এক জনকে দেখিয়া আসিতে বলিলেন। তাহার পর রাজপ্রাসাদে ছড়াইয়া পড়িল, রাজার কাউয়ার মতো ছেলে হইয়াছে। এই কথা বাহিরে চাউর হইতেই কেহ কেহ বলিতে লাগিলেন, রানি কাউয়া প্রসব করিয়াছেন। এক কান হইতে বহু কানে ছড়াইয়া পড়িতেই দেখা গেল, কেহ কেহ বলিতেছেন, রানির ঝাঁকে ঝাঁকে কাউয়া হইয়াছে। গুজবের ডালপালা এইভাবেই ছড়ায়। এই দেশে পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের কাটা মাথা লাগা, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডির পর হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বাতাসে মিশে অ্যাসিড বৃষ্টি তৈরি ইত্যাদি গুজবের কথা এখনো আমাদের কানে বাজে। তবে শুধু বাংলাদেশে নহে, বিশ্বের সর্বত্রই গুজব ছড়াইতে দেখা যায়। গুজব আকারে রসালো ঘটনা হইলে তো কোনো কথাই নাই। আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা, এশিয়া—কোথায় নাই গুজব? মাইকেল জ্যাকসন বাঁচিয়া রহিয়াছেন, প্যারিসের রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন—এমন গুজব সম্প্রতি খোদ উন্নত দেশেই ছড়াইয়া পড়ে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সময় সবচাইতে বড় গুজব ছিল, চীনের লোকজন বাদুড়ের স্যুপ খায়, সেই কারণেই এই ভাইরাস ছড়াইয়াছে। আর কিছুদিন পূর্বে সোশ্যাল মিডিয়ায় নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মৃত্যুর গুজব ছড়ানো হইলে অনেকে শোক প্রকাশ করিতে শুরু করেন।
সমাজ ও মনোবিজ্ঞানশাস্ত্র মতে, গুজব হইল জনসাধারণ সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়, ঘটনা বা ব্যক্তি লইয়া মুখে মুখে প্রচারিত কোনো বর্ণনা বা গল্প। আমাদের দেশে ‘গল্পগুজব’, ‘গালগল্প’, ‘আষাঢ়ে গল্প’ ইত্যাদি শব্দ হইতেও বোঝা যায়, এখানে গুজবের অস্তিত্ব ভালো মতোই রহিয়াছে। অতীতে যখন প্রযুক্তির ব্যবহার ছিল না, তখন মুখে মুখে গুজব প্রচার হইত; কিন্তু এখন প্রযুক্তির কারণে লিখিতভাবে ও দ্রুত গুজব প্রচারিত হইতেছে। গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত ‘রিউমার সাইকোলজি’ নামক গবেষণা গ্রন্থে বলিয়াছেন, ‘যখন কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির উপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে না কিংবা কী কারণে ঘটনা ঘটিতেছে সেই বিষয়ে কাহারো কোনো সম্যক ধারণা থাকে না, তখনই গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা বাড়িয়া যায়।’ ভুল তথ্য (misinformation), বিভ্রান্তিমূলক তথ্য (misinformation) এবং মেলইনফরমেশনের (mailinformation) কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতি বত্সর বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হইতেছে। মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং এবং অ্যামপ্লিফিকেশন নেটওয়ার্কের মতো নতুন প্রযুক্তি প্রকৃত তথ্যকে বিকৃত করিবার কাজে ব্যবহার করা হইতেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করিয়াও মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্রুত ছড়াইয়া দেওয়া হইতেছে। ২০১৭ হইতে ২০২০ সালের মধ্যে সামাজিক মিডিয়া তথা বিভিন্ন ফেসবুক পেজ, ওয়েবসাইট ও ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে ছড়ানো গুজব বিশ্লেষণ করিয়া দেখা যায়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ৩৪ দশমিক ৩ শতাংশ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ১৬ শতাংশ, অপরাধ ও মানবাধিকার বিষয়ে ১১ শতাংশ এবং ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়ে ১১ শতাংশ গুজব ছড়ানো হইয়াছে।
অতএব, গুজবের পিছনে ছুটিয়া মানুষ যাহাতে তাহার মূল্যবান সময়, অর্থ ও সম্মান না হারান, এই জন্য গুজব প্রতিরোধে আমাদের সচেতন ও সচেষ্ট হইতে হইবে। বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বে ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য মোকাবিলায় প্রচলিত গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করা প্রয়োজন। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইনভুক্ত এই সকল মিডিয়ার বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদান করা জরুরি। আমাদের মনে রাখা দরকার, গণতান্ত্রিক নির্বাচনি পরিবেশকে দুর্বল ও ক্ষতিগ্রস্ত করিতে অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশে গুজবকে ব্যবহার করা হয় শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে। তাই এই ব্যাপারেও সাধু সাবধান! আবেগতাড়িত হইয়া ও কোনো কিছু যাচাই-বাছাই না করিয়া সোশ্যাল মিডিয়ায় লাইক, কমেন্ট ও শেয়ায় করা যাইবে না। মোটকথা, চিলে কান নিয়াছে—এমন গুজবে কান না দিয়া পূর্বে কানে হাত দিতে হইবে। আবারও কবি শামসুর রাহমানের ভাষায় বলিতে হয়, ‘ছুটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে/ কানের খোঁজে মরছি ঘুরে সোনার চিলের পিছে?/ নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;/ কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।’