সাজানো প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফাঁদে পড়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূলে স্থায়ী বিভক্তি তৈরি করবে বলেও মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে। তাদের ভাষ্য, ভোটের লড়াইয়ে দলীয় কিংবা স্বতন্ত্র প্রার্থী যে-ই জয়ী হোক না কেন নির্বাচনকে ঘিরে তাদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতায় যে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তা নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সামাল দেওয়াও কঠিন হবে। বিগত সময়ের স্থানীয় নির্বাচনের মতো বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির ঘটনা ঘটার মধ্য দিয়ে এবারের সংসদ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
যদিও দলের শীর্ষস্থানীয় একাধিক নেতা এ আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের দাবি, দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা আগেভাগেই সব দিক ভেবে-চিন্তেই স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড়ানোর অনুমতি দিয়েছেন। এ কৌশল এখন বোঝা না গেলেও সময়মতো সবকিছুই স্পষ্ট হবে। ভোটের মাঠের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে দলীয় কৌশলে পরিবর্তন আসতে পারে। আবার সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা থাকলে কোথাও কোথাও চাপ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বসিয়ে দেওয়া হতে পারে বলেও মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ মনে করেন, আসন্ন নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য দলের মনোনয়ন বঞ্চিত নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটের মাঠে রাখার যে কৌশল আওয়ামী লীগ নিয়েছে, তাতে দলটি লাভবানই হবে। কারণ দলটির তৃণমূলের অনেক জনপ্রিয় নেতা, যারা দলীয় মনোনয়ন পাননি, তারা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের সুযোগ পাবেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরিন অবশ্য মনে করছেন, নিজ দলের মধ্যে একাধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় সুবিধার পাশাপাশি কিছু ক্ষতির মুখেও পড়তে হতে পারে আওয়ামী লীগকে। তার ভাষ্য, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখানোর জন্য নিজ দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট করার সুযোগ দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। তারা আসলে দলটির ছায়াপ্রার্থী। আপাতদৃষ্টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিরীহ মনে হলেও ভোটের মাঠের চিত্র ভিন্ন রকম হতে পারে। এতে তৃণমূলে দলের কোন্দল আরও বাড়বে এবং সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
এদিকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনের আগেই ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ নিয়ে সব ধরনের জটিলতা কাটানো সম্ভব হবে আওয়ামী লীগের নীতি-নির্ধারকরা এমন দাবি করলেও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। তারা মনে করেন, ভোটের মাঠে প্রকাশ্য লড়াই শুরু হলে তখন আর তা কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। তখন দলের আস্থাভাজন নেতাদের অনেকে ব্যক্তিস্বার্থে হাইকমান্ডের নির্দেশনাও উপেক্ষা করতে পারেন। আর এমনটি হলে পুরো পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠবে।
তাদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রার্থিতা নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যকার সংঘাত-সহিংসতার ঘটনায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার মনোনয়ন জমা দেওয়ার শেষ দিনে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় নৌকার প্রার্থী এনামুল হক শামীমের সমর্থকদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থী ডাক্তার খালেদ শওকত আলীর সমর্থকদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, ককটেল বিস্ফোরণ ও সংঘর্ষ হয়। এতে দু’পক্ষের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মী আহত হন।
গত ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যায় সাঘাটা উপজেলার জুমারবাড়ি এলাকায় গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ফারজানা রাব্বি বুবলির গাড়ি বহরে হামলা ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ওই স্বতন্ত্র প্রার্থীর অন্তত ২০ সমর্থক আহত হন এবং তাদের কমপক্ষে ৫টি মোটর সাইকেল ভাঙচুর করে নৌকা প্রার্থীর ক্যাডাররা। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে এলাকায় হামলা করা হয়।
গত বুধবার কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী সালাহ উদ্দিন আহমদের সমর্থকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জন আহত হন। এ ঘটনা সাহারবিল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান নবী হোছাইনের নেতৃত্বে হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সালাহ উদ্দিন আহমদ। নবী হোছাইন বর্তমান সংসদ সদস্য ও স্বতন্ত্র প্রার্থী জাফর আলমের অনুসারী।
গত বৃহস্পতিবার পটুয়াখালীর কলাপাড়া পৌর শহরে সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মাহবুবুর রহমান সমর্থিত নেতাকর্মীরা হামলার শিকার হন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-রাঙ্গাবালী) সংসদীয় আসনে মনোনয়নপত্র দাখিল করার কথা ছিল তার। সকাল ১০টার দিকে কলাপাড়া পৌর শহরের গোডাউন ঘাট এলাকায় এ হামলার ঘটনা ঘটে। হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এসএম মনিরুল ইসলাম এবং উপজেলা যুবলীগের সাবেক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক অসীম তালুকদার। তাদের কুপিয়ে জখম করেছে কতিপয় সন্ত্রাসীরা। আহত দু’জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত নেতা সাবেক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও কলাপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মাহবুবুর রহমানের সমর্থক। এ সহিংস ঘটনায় বর্তমান সংসদ সদস্য মো. মহিবুর রহমানকে দায়ী করেছেন মাহবুবুর রহমান।
তবে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলছেন, আওয়ামী লীগের প্রথম সারির নেতারা। দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সব সময়ই দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলেন, চেইন অব কমান্ড ফলো করেন। যদিও এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তারপরও নেতাকর্মীরা আমাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকবে।’
যদিও আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন চিত্র পাওয়া গেছে। জানা গেছে, কোনো কোনো আসনে দলের মনোনীত প্রার্থীরা অনেকটা একা হয়ে পড়েছেন। কোথাও কোথাও স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা একজোট হয়ে দল মনোনীত প্রার্থীকে গো হারা হারানোর চেষ্টা করছেন। এমন জটিল পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র প্রার্থী নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বিষয়টি দলীয় হাইকমান্ড আঁচ করতে পেরেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। ১৭ ডিসেম্বরের পর কৌশলে কিছুটা বদল আসতে পারে বলে অনুমান করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে সেই বদলটা কী, তা এখনো অস্পষ্ট তাদের কাছে।
তবে কেউ কেউ অনুমান করেন, এমন একটা নির্দেশনা আসতে পারে যে দলের পদধারী কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে পারবেন না। এমন নির্দেশনা এলে অন্তত অর্ধেক স্বতন্ত্র প্রার্থী বাদ পড়তে পারেন। তবে সবাই এ নির্দেশনা মানবেন কি না, সেই আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ থেকে পরিকল্পনা ছিল, দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী নিজ পছন্দ অনুযায়ী ডামি প্রার্থী দেবেন। কয়েকটি আসনে সেই অনুযায়ী হলেও অধিকাংশ আসনে এমপির বিরোধীরাই প্রার্থী হয়েছেন। এতে নৌকার প্রার্থী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন। এ কারণে আসন ধরে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে ভোট থেকে সরাতে তৎপর হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে শেষ পর্যন্ত কয়টি এ কর্মকাণ্ড সম্ভব হবে, তা নিয়ে সন্দিহান অনেকেই।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, ‘নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে দলীয় ডামি প্রার্থী দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৯০ শতাংশ আসনেই ডামির বদলে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে গেছে। এখন তাদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু আসনে বিদ্রোহী প্রার্থীদের বসানোর চেষ্টা করা হবে। শেষ পর্যন্ত তা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে, তা সময়ই বলে দেবে।’
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘ইচ্ছেমতো বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার কথা কখনোই বলা হয়নি। অনেকে হয়তো বুঝতে ভুল করেছেন বা ভুল ব্যাখ্যা করেছেন। কৌশলগত বিষয়টি ধীরে ধীরে পরিষ্কার করে দেওয়া হবে এবং ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে যাবে।’
তবে স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া একাধিক প্রার্থী তার এ ব্যক্তব্যের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। তাদের ভাষ্য, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলের নেতাদের অংশ নেওয়ার বিষয়টি হাইকমান্ড থেকে শুরুতেই স্পষ্ট করা হয়েছে। মনোনয়ন জমা দেওয়ার পর তাদের আর সেখান থেকে ফিরে আসার সুযোগ নেই। নির্বাচনে জয়-পরাজয় যেটাই হোক তারা শেষ পর্যন্ত লড়ে যেতে চান। তবে তারা এ ব্যাপারে সরাসরি হাইকমান্ডের নির্দেশনা চ্যালেঞ্জ করবেন কিনা তা কেউ স্পষ্ট করেননি।