ঢাকাঃ দেশে নগদ টাকার সংকটে অস্থির আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারও একই পরিণতি বেহাল অবস্থা সাধারণ মানুষের ৩৭ শতাংশ ঋণ করে সংসার চালাতে হচ্ছে। ব্যাংক খাতে চলছে নগদ টাকার সংকট। এতে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারও ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছে। গতকাল এই বাজারে সুদ উঠেছে সাড়ে ১২ শতাংশ পর্যন্ত, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
গত ছয় বছরে (২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত) দেশে দারিদ্র্যের হার ৫ দশমিক ৬ শতাংশ কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে আগের মতো শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে এই হার এখনো বেশি। গ্রামাঞ্চলে ৬ বছরে দারিদ্র্যের হার কমেছে ৫ দশমিক ৯ ও শহরাঞ্চলে ৪ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ১৭তম হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে (এইচআইইএস) প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের ৩৭ শতাংশ মানুষ এখনো ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন।
আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও অর্থ ধারের খরচ সাম্প্রতিককালে বেড়েছে। মূলত খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি, আমানতের ধীর প্রবৃদ্ধি এবং সরকারের ঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংকনির্ভর হয়ে পড়ায় এ খাতে দিন দিন তারল্য সংকট তীব্র হচ্ছে।
এই সংকট সামাল দিতে এক ব্যাংক ছুটছে আরেক ব্যাংকের কাছে। কিন্তু আন্তঃব্যাংকে প্রয়োজনীয় তহবিলের জোগান নেই। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও ব্যাংকগুলোর ধারের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তহবিল সংকট কাটাতে উচ্চ সুদেও আমানত সংগ্রহ করছে অনেক ব্যাংক।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের ঋণের সুদহার বাড়ানোর পথে হাঁটছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর অংশ হিসেবে সম্প্রতি সব ধরনের নীতি সুদহার এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে গ্রাহকপর্যায়ে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সুদের হার আরেক দফা বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ সুদ গুনতে হচ্ছে; আগে যা ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। নীতি সুদহার করিডরের ঊর্ধ্বসীমা স্পেশাল রেপো বা এসএলএফের (স্ট্যান্ডিং লেন্ডিং ফ্যাসিলিটি) সুদহার ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ব্যবস্থায় সংকটে পড়া ব্যাংক উচ্চসুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করে। এ ছাড়া সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলের সুদ ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো হয়েছে। এখন স্মার্ট রেট ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ, ব্যাংকগুলো এর সঙ্গে ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ যুক্ত করতে পারছে। তাতে চলতি ডিসেম্বর মাসে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদ উঠেছে ১১ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক আরও সংকোচনমূলক মুদ্রা সরবরাহের পথে হাঁটছে। এতে বাজারে নগদ অর্থের সংকট আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ের এক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি ধারের সুদ এত বাড়ার কথা নয়। হয়তো সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অর্থ ধার করার ডকুমেন্টস ছিল না। ফলে চড়া সুদে হলেও অন্য ব্যাংক থেকে টাকা ধার করতে বাধ্য হয়েছে। এর অর্থ আন্তঃব্যাংকেও নগদ টাকার সংকট বেড়েছে। ফলে একদিনের ব্যবধানে লেনদেনও কমে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে মোট লেনদেন হয়েছে ৩ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। সর্বোচ্চ ৬ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশের মধ্যে এসব লেনদেন হয়েছে। এদিন ১৪ দিন মেয়াদি ধারের সর্বোচ্চ সুদ ওঠে সাড়ে ১২ শতাংশ। কয়েকটি ব্যাংকের মধ্যে এই সুদে ১৫৭ কোটি টাকার লেনদেন হয়। ৩২ দিন মেয়াদি ধারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১১ দশমিক ৯০ শতাংশ সুদে ৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়।
১৫ দিন মেয়াদি ধারের সুদ ওঠে সাড়ে ১১ শতাংশ, লেনদেন হয় ৫০ কোটি টাকার। ৭ দিন ও ৫ দিন মেয়াদি ধারের সুদ ওঠে ১১ শতাংশ। এ দুটির ক্ষেত্রে লেনদেন হয় যথাক্রমে ৬৫ কোটি ও ৯৮ কোটি টাকা। আর একদিন মেয়াদি কলমানির সর্বোচ্চ সুদ ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ, লেনদেন হয় সর্বোচ্চ ৩ হাজার ১১১ কোটি টাকা। এ ছাড়া গতকাল এই বাজারে ৯১ দিন, ৯২ দিন ও ১৮৩ দিন মেয়াদের জন্যও ধার দেওয়া-নেওয়া হয়। এসব উপকরণের সুদহার ছিল ৬ থেকে সাড়ে ৯ শতাংশ। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রায় ৫ হাজার ৩৯২ কোটি টাকার লেনদেন হয়। এসব লেনদেনের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদ উঠেছিল ১২ শতাংশ। ওইদিন ৯২ দিনের ধারের জন্য এই সুদ ওঠে। এ ছাড়া ওইদিন ৭ দিন, ১৩ ও ১৪ দিন মেয়াদি ধারের সুদহার ছিল ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ, ৬ দিন মেয়াদির সুদ ১১ দশমিক ২৫ শতাংশ, ২ দিন মেয়াদি, ৩০ দিন মেয়াদি ও ৯০ দিন মেয়াদির সুদহার ছিল ১১ শতাংশ এবং ৮ দিন মেয়াদি ও ৯ দিন মেয়াদির সুদহার ছিল ১০ দশমিক ৭৫ শতাংশ। আর একদিন মেয়াদি কলমানির সুদহার ছিল সাড়ে ৯ শতাংশ।
আন্তঃব্যাংকের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেও অর্থ ধার নেওয়ার সুদহার সম্প্রতি বেড়েছে। তার পরও প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রেকর্ড পরিমাণ অর্থ ধার করছে ব্যাংকগুলো। গতকালও বিভিন্ন উপকরণের আওতায় প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মতো ধার দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগের দিন মঙ্গলবার এই ধারের পরিমাণ ছিল ২০ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা। আর গত ২০ ডিসেম্বর ২৪ হাজার ৬১৬ কোটি টাকা স্বল্পমেয়াদি ধার দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা ছিল এযাবৎকালের রেকর্ড। এর আগে গত ২৫ অক্টোবর সর্বোচ্চ ২৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা ধার নেওয়ার রেকর্ড ছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের শেষদিকে কয়েকটি ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের খবর জানাজানি হওয়ার পর ব্যাংক খাতের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট তৈরি হয়। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে টাকা তুলে নিতে থাকেন গ্রাহকরা। আবার সে সময় ব্যাংকগুলোতে নতুন আমানত আসাও কমে যায়। এতে ওই ব্যাংকগুলোতে নগদ টাকার সংকট তৈরি হয়, যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আবার আগের বিতরণ হওয়া ঋণ সময়মতো ফেরত আসছে না। এ ছাড়া আমদানি দায় মেটাতে ডলার কেনার চাপেও নগদ টাকা হাতছাড়া হচ্ছে। এর মধ্যেই বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে বেশি সুদে ঋণ নেওয়া বাড়িয়েছে সরকার। ফলে চলমান নগদ টাকার সংকট আরও বেড়েছে।
ঋণ করে সংসার চালাচ্ছে ৩৭ শতাংশ মানুষ
বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিবিএস ভবনে মূল প্রতিবেদনটি তুলে ধরেন প্রকল্পটির পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ। বিবিএস মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। এ ছাড়া ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিব ড. শাহনাজ আরেফিন, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. মো. কাউছার আহমেদ উপস্থিত ছিলেন।
২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৪ হাজার ৪ শতাধিক পরিবারের ১২ মাসের তথ্যের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। পল্লী অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ ও শহরাঞ্চলে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ, যা ২০১৬ সালে ছিল ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ ও ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
বিবিএস জরিপ বলছে, ২০২২ সালে সর্বোচ্চ দারিদ্র্য হার পাওয়া গেছে বরিশাল বিভাগে। আগে কুড়িগ্রামে সর্বোচ্চ দারিদ্র্য হার থাকলেও এবার সেটি বরিশালে গেছে। জরিপ অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে ২১ দশমিক ১১ শতাংশ ব্যক্তি মাঝারি বা মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। যেখানে ২০২২ সালে পল্লী এলাকায় এ হার ছিল ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং শহর এলাকায় ১৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দেশে ২০২২ সালে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ মানুষ মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, একটি পরিবার মাসে গড় আয় করে সাড়ে ৩২ হাজার টাকা। আয়ের বিপরীতে একটি পরিবারের ব্যয় হয় সাড়ে ৩১ হাজার টাকা। অর্থাৎ একটি পরিবার মাসে এক হাজার টাকার মতো সঞ্চয় করে।
বিবিএস প্রতিবেদনে জানায়, দেশের প্রতিটি খানার (বিবিএসের সংজ্ঞানুযায়ী যে কয়জন ব্যক্তি একই রান্নায় খাওয়াদাওয়া করেন, তাদের একত্রে একটি খানা বা হাউজহোল্ড বলা হয়) গড় আয় বেড়েছে। জরিপ অনুযায়ী খানার মাসিক গড় আয় ৩২ হাজার ৪২২ টাকা। যা ২০১৬ সালের জরিপে ছিল ১৫ হাজার ৯৮৮ টাকা। এ ছাড়া খানার মাসিক ব্যয়ও বেড়েছে। বর্তমানে একটি খানার মাসিক ব্যয় ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, যা ২০১৬ সালে ছিল ১৫ হাজার ৭১৫ টাকা।
জরিপে দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের প্রায় ৩৭ শতাংশ মানুষ ঋণ করে সংসার চালাচ্ছেন। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে একটি পরিবারের গড় ঋণ ৭৩ হাজার ৯৮০ টাকা। ঋণগ্রস্ত পরিবার হিসেবে এই অঙ্ক আরও অনেক বেশি। বিশেষ করে শহরের মানুষকে বেশি ঋণ করতে হচ্ছে।
তথ্য-উপাত্ত নিরীক্ষণে জরিপে দেখা যায় খানায় খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয়ের ধারায় পরিবর্তন হয়েছে। খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২০২২ সালে খাদ্য ব্যয়ের শতকরা হার ৪৫.৮ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় ৫৪.২ শতাংশ। যেখানে ২০১৬ সালে খাদ্যের জন্য ব্যয় ছিল ৪৭.৭ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় ৫২.৩ শতাংশ। ২০২২ সালে চালের দৈনিক মাথাপিছু গড় ভোগের পরিমাণ ছিল ৩২৮.৯ গ্রাম, যা ২০১৬ সালে ছিল ৩৬৭.২ গ্রাম এবং ২০১০ সালে ছিল ৪১৬.০ গ্রাম। এ ছাড়া সবজি ও মাংসের ব্যবহার ধীরে ধীরে বেড়েছে বলে জানায় বিবিএস।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রোটিন গ্রহণের গড় পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জরিপ অনুযায়ী দৈনিক মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ ৭২.৫ গ্রাম, যা ২০১৬ সালে ছিল ৬৩.৮ গ্রাম।