নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮ দলের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২২২, জাতীয় পার্টি ১১, জাসদ ১, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি ১, বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি ১ এবং স্বতন্ত্র পেয়েছে ৬২টি আসন। বাকি ২৩ দলের বেশির ভাগই জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত দলের সংখ্যা ৪৪। তার মানে এবার সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে ৫টি দল।
এবারের নির্বাচনে এমন ভরাডুবির পর সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, ‘৭ জানুয়ারির নির্বাচন সরকারের নিয়ন্ত্রণে হয়েছে। সরকার যেখানে নিরপেক্ষ করতে চেয়েছে, সেখানে নিরপেক্ষ হয়েছে। সরকার যেখানে যাকে জেতাতে চেয়েছে, সেটিই করেছে। এটা নিয়েই আমরা সব সময় আতঙ্কিত ছিলাম।’
নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে কাদের বলেন, ‘আমার বিশ্বাস, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। আমাদের লোককে মেরে-কেটে বের করে দেওয়া হয়েছে। কোনো ধরনের প্রোটেকশন পাইনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, ইলেকশন কমিশন, রিটার্নিং অফিসার কোনোখান থেকে সুযোগ পাইনি সুষ্ঠুভাবে ভোট করার।আমরা অসহায় হয়ে গেছি।বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা একটা নতুন ধরনের ডাইমেনশন দেখা গেল।’
তবে, নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এই নির্বাচনে ৪১ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পড়েছে বলেও কমিশন জানিয়েছে।
১৯৯১ সালে প্রথম গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরে আসে নির্বাচন। এরপর থেকে আটটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যার মধ্যে পাঁচটি সংসদে নেতৃত্ব দেয় আওয়ামী লীগ ও তিনটি সংসদের নেতৃত্ব দেয় বিএনপি।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় ৭৫টি দল। যাদের মধ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে ১২টি দল। সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিএনপি। তারা ১৪০ আসনে জয় লাভ করে। আওয়ামী লীগ ৮৮, জামায়াতে ইসলামী ১৮, জাতীয় পার্টি ৩৫, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ ৫, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ৫, ইসলামী ঐক্যজোট, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মুজাফফর), গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (সিরাজ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি একটি করে আসন পায়, স্বতন্ত্র থেকে দুজন নির্বাচিত হয়। ওই নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ।
১৯৯১ সালের সংবাদপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। নির্বাচনী প্রচারণার সময় শেখ হাসিনা বগুড়ায় এক জনসভায় বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ বেশি কথা বলে না, সেমি-ফাইনাল বা ফাইনাল গেমের হুমকিও দেয় না। আওয়ামী লীগ যা করতে পারে কেবল সেটাই বলে।’
খুলনায় এক নির্বাচনী সমাবেশে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘দেশে-বিদেশে রব উঠিয়াছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাইবে।’ সেই সময় ইত্তেফাক পত্রিকার খবরে বলা হয়েছিল খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগকে টার্গেট করে বলেন, ‘আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা, অন্যদের হাতে গোলামির জিঞ্জির।’
ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। তবে সেই সংসদ বেশি দিন টেকেনি। কারণ সে নির্বাচন আওয়ামী লীগসহ অনেকেই বয়কট করে। একতরফা সেই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই নগণ্য। নির্বাচনে পর তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার বিচারপতি একেএম সাদেক বলেছিলেন, ‘কত শতাংশ মানুষ ভোট দিয়েছে সেটি বড় কথা নয়। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেটাই আসল কথা।’
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালে জুনে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া সেই নির্বাচনে ৮১টি দল। যাদের মধ্যে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে ছয়টি দল। আওয়ামী লীগ ১৪৬টি আসনে জয় পায়। বিএনপি ১১৬, জাপা ৩২, জামায়াতে ইসলামী ৩, ইসলামী ঐক্যজোট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (রব) একটি করে আসন পায় এবং স্বতন্ত্র থেকে একজন নির্বাচিত হয়।
সরকার গঠন করার জন্য কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। এর মাধ্যমে ২১ বছর পরে ক্ষমতার ফেরে দলটি।
তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবু হেনা বলেন, নির্বাচনে ৭৩ শতাংশ ভোট পড়েছে এবং নির্বাচনে কারচুপির কোনো সুযোগ ছিল না।
অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২০০১ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হওয়া সেই নির্বাচনে ৫৪টি দল অংশ নেয়। সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে আটটি দল। তাদের মধ্যে বিএনপি পায় ১৯৩টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। আওয়ামী লীগ ৬২, জামায়াতে ইসলামী ১৪, জাপা ১৪, বিজেপি ৪, ইসলামী ঐক্যজোট ২, জেপি (মঞ্জু), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ একটি করে আসন পায়। স্বতন্ত্র থেকে ছয়জন নির্বাচিত হয়।
২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘স্থূল কারচুপি করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। জনগণ নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে, আমার মেনে নেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।’
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় ২০০৮ সালে। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভূমিধস জয় পায়। ৩৯ দল এই নির্বাচনে অংশ নেয়। সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে আটটি দল। আওয়ামী লীগ ২৩০ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিএনপি ৩০, জাপা ২৭, জাসদ ৩, ওয়ার্কার্স পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী ২, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি ও বিজেপি একটি করে আসন পায় এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী একটি আসন পান।
নির্বাচন কমিশনের হিসেব অনুযায়ী ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে ৮৬.২৯ শতাংশ ভোট পড়েছে। বিপুল ভোটার অংশ নিয়েছিল সেই ভোটে কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, সে জন্য ভোটকেন্দ্রগুলোতে কোনো রাজনৈতিক প্রভাব চোখে পড়েনি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচন বিএনপি বয়কট করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ ১৫৩ আসনে জয় লাভ করে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ওই নির্বাচনে সাতটি দল অংশ নিয়েছিল। সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে সাতটি দলই।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পায় ২৩৪ আসন, জাতীয় পার্টি ৩৪, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি ৬, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ৫, জাতীয় পার্টি (মঞ্জু) ২, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ২, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ১টি এবং স্বতন্ত্র ১৫টি আসনে জয় লাভ করে।
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২৮টি দল অংশ নেয়। সংসদে প্রতিনিধিত্ব করে নয়টি দল। আওয়ামী লীগ ২৫৮ আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিএনপি ৬, জাপা ২২, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩, গণফোরাম, জাসদ, বিকল্পধারা বাংলাদেশ দুটি করে, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, জেপি একটি করে ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসন পায়।
১৯৯১ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৯টি নির্বাচনে। এসব নির্বাচনের মধ্যে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদে প্রতিনিধিত্ব সবচেয়ে কম। মাত্র পাঁচটি রাজনৈতিক দল প্রতিনিধিত্ব করবে। এছাড়া এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র রেকর্ড পরিমাণ জয় লাভ করেছে। ৬২টি আসনে স্বতন্ত্র জয় পেয়েছে। আগের আটটি সংসদে মোট ২৮ জন স্বতন্ত্র জয়ী হয়েছিল। বিগত আটটি সংসদে যতগুলো স্বতন্ত্র জয়ী হয়েছিল এবার এক সংসদ নির্বাচনে দ্বিগুণেরও বেশি।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে বিরোধী দল কে হবে—সে বিষয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘রেজাল্ট অফিশিয়ালি ঘোষণার পর বিরোধী দল কারা সে বিষয়ে জানা যাবে। অলরেডি বিরোধী দল জাতীয় পার্টির তো অনেকেই জিতেছেন, ১৪ দলেরও দুজনের মতো জিতেছেন।’