দেশ এখন কূটনীতি-অর্থনীতির ভারসাম্যের দড়িখেলায়

82

নিউজ২১ডেস্কঃ বাংলাদেশে নির্বাচনের পর দ্রুত গঠিত মন্ত্রিসভায় অনেক চমক থাকলেও সবচেয়ে বড় চমক অর্থ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। এই চমক পূর্ব-পশ্চিমের টানাপড়েনে পড়া বাংলাদেশকে কতটা আশার আলো দেখাচ্ছে?

টানা চতুর্থবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, ”অন্যান্য কারণ ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের ওপর অনেক দেশের ‘কুদৃষ্টি’ রয়েছে।

বিএনপি ও তাদের সমমনা বিরোধী দলগুলোর বয়কট করা নির্বাচনে ২২২ আসন জিতে টানা চতুর্থ বারের মতো সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এমনকি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিতে আসা ৬১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও বেশিরভাগই বিভিন্ন পর্যায়ের আওয়ামী লীগ নেতা৷ এছাড়া ১১টি আসনে জেতা জাতীয় পার্টিও ২৬টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে।

নতুন সংসদে জনগণের ইচ্ছার কতটা প্রতিফলন হয়েছে, এ নিয়ে রয়েছে সমালোচনা। নির্বাচন কমিশন ৪১ দশমিক আট শতাংশ ভোটার উপস্থিতির কথা বললেও এ নিয়েও বিরোধীরা প্রশ্ন তুলেছেন। নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরপরই বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে আসতে শুরু করে বার্তা। সেই বার্তাতেও রয়েছে স্পষ্ট বিভাজন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এমনকি জাতিসংঘ এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার পক্ষ থেকেও নির্বাচন ও বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে কঠোর বার্তা এসেছে। অন্যদিকে, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, কাতারসহ বেশকিছু দেশ টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচনে জেতায় শুভেচ্ছা জানিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।

নতুন মন্ত্রিপরিষদে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে ড. হাছান মাহমুদকে, যিনি এর আগের সরকারে ছিলেন তথ্যমন্ত্রী, তারও আগের সরকারের শুরুতে ছয় মাসের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পরে বন ও পরিবেশমন্ত্রী ছিলেন । অন্যদিকে বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া আবুল হাসান মাহমুদ আলীও ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, আন্তর্জাতিক মেরুকরণে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় যেতে পারে, পোশাক রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল বাংলাদেশের অর্থনীতি কী ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে পারে?

অর্থ-বাণিজ্য এবং কূটনৈতিক সংকটই নতুন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই দুই খাত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গভীরভাবে পরস্পর সম্পর্কিত।

 

চীনের দিকে ঝুঁকছে বাংলাদেশ?

দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ‘লড়ছে’ ভারত এবং চীন। ভারতের ক্ষেত্রে এর বাইরেও আঞ্চলিক নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। উত্তর-পূর্ব ভারতের বেশ কিছু রাজ্যে চীনের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে সংকট রয়েছে ভারতের। মিয়ানমারে চলমান সামরিক জান্তাবিরোধী লড়াইয়েও চীনের সঙ্গে ভারতের বড় দ্বন্দ্ব রয়েছে।

ভারত মহাসাগরের মালদ্বীপের সঙ্গে এরই মধ্যে ভারতের সম্পর্ক পৌঁছেছে তলানিতে। মালদ্বীপের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জু নির্বাচনে এসেছিলেন ভারত-বিরোধী বক্তব্য দিয়ে। জয়ের পরও ভারতের উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে জানুয়ারিতে গেছেন চীন সফরে, চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে সই করেছেন ২০টি চুক্তি। দুই নেতা ঘোষণা করেছেন, দেশ দুটির দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে উন্নত করা হবে বিস্তৃত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারত্বে।

সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও দূরত্ব বেড়েছে ভারতের, বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে সীমান্ত থাকা নেপাল-ভুটানের। নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল, যিনি প্রচণ্ড নামে পরিচিত, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঘুরে এসেছেন চীন। জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে তাইওয়ান ও তিব্বত ইস্যুতে চীনের প্রতি সমর্থনের কথা জানিয়েছেন প্রচণ্ড। তবে ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রেখে চলা নেপাল চীন প্রস্তাবিত গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভে যোগ দেয়নি, স্বাক্ষর হয়নি চীনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ -বিআরআইতে নেপালের যোগ দেয়ার চুক্তিও।

ভুটান এবং শ্রীলঙ্কাকেও নানা ধরনের আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে কাছে টানার চেষ্টা করছে চীন। শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে চীনা অর্থায়নে বেশ কিছু মেগাপ্রকল্প নিয়ে অর্থনৈতিক বিপত্তিতে পড়েছে, হামবানটোটা বন্দরের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে সেই বন্দর চীনের কাছে ইজারাও দিয়ে দিতে হয়েছে। তারপরও দেশটিতে কমেনি চীনের প্রভাব। আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধে শ্রীলঙ্কার পাশে ভারতের মতো চীনও দাঁড়িয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়েও চলছে আলোচনা।

গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগকে ‘ভারতবান্ধব’ হিসাবে অনেকে আখ্যা দিলেও ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ তত্ত্ব, সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন, তিস্তা বাঁধসহ নানা দ্বিপাক্ষিক ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে তৈরি হয়েছে দূরত্ব। প্রায়ই পেয়াঁজ ও অন্যান্য নিত্য়প্রয়োজনীয় দ্রব্যের রপ্তানি হুট করে বন্ধ করায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিও সরকারকে প্রায়ই দেশের মধ্যে অস্বস্তিতে ফেলে। করোনা মহামারির সময় চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও কোভিশিল্ড টিকা রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারত এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে পড়তে হয় ব্যাপক সমালোচনার মুখে। তখন দ্রুততার সঙ্গে চীনের কাছ থেকে সিনোভ্যাক টিকা এনে পরিস্থিত সামাল দেয় বাংলাদেশ সরকার।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে দেশটির বিনিয়োগ এখন প্রায় দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রায় ৭০০ চীনা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ২০১৬ সালে যোগ দিয়েছে বিআরআইয়ে। বাংলাদেশের কাছে দুটি সাবমেরিন বিক্রি করেছে চীন, সেগুলো রাখার জন্য কুতুবদিয়ায় চীনা অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে একটি বন্দর।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ তার তিন পাশে সীমান্ত থাকা প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে চীনের দিকে অনেকটাই ঝুঁকে গেছে বলে মনে করেন উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেন কুগেলমান। তিনি বলেন, ”সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিংয়ের সাথে (বাংলাদেশের) অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে চীন বাংলাদেশের প্রথম সাবমেরিন ঘাঁটিতে অর্থায়ন করছে।”

একে অবশ্য বাংলাদেশের ভারসাম্যের কূটনীতির একটি সাফল্য হিসাবে দেখেন তিনি। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ”বড় শক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার সুফল ঘরে তুলছে বাংলাদেশ, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তুলছে এবং একে অপরের সঙ্গে লড়াইয়ে থাকা একাধিক বৃহৎ শক্তি ঢাকাকে নানা ধরনের সহযোগিতা দেয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে আরো প্রভাব অর্জনের চেষ্টা করছে- এর কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পাচ্ছে।”

তিস্তা: চিকেনস নেক-এ গলার কাঁটা

মালদ্বীপের মুকুনুধুতে ভারত সীমান্তের গা ঘেঁষে একটি মহাসাগর পর্যবেক্ষণ স্টেশন তৈরি করেছে চীন। গোয়েন্দাদের বরাতে দেশটির গণমাধ্যমে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, সেখানো গোপনে একটি সাবমেরিন ঘাঁটিও তৈরি করতে চায় চীন। ভারত মহাসাগরের পাশাপাশি বঙ্গোপসাগরেও চীনা সাবমেরিনের জন্য আরেকটি ঘাঁটি দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে ভারতের নীতিনির্ধারকদের কপালেও।

তবে সাগরের চেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদীর জল। ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানিবন্টন চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পরও ২০১১ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তিতে চুক্তিটি আটকে আছে। টানা দেড় যুগ ক্ষমতায় থেকেও এই জট ছাড়াতে না পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের গলার কাঁটা হয়েই রয়েছে তিস্তা।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালে তিস্তা নদী সমন্বিত ব্যবস্থাপনা মহাপ্রকল্পের প্রস্তাব তৈরি করে বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়।  চীন ৮ হাজার ২শ কোটি টাকা ঋণ দিতেও রাজি হয়।

প্রস্তাবিত প্রকল্পের আওতায় কৃত্রিম জলাধার তৈরি করে পানি ধরে রেখে সারাবছর সেচ কাজে ব্যবহার করা হবে। ১১৫ কিলোমিটার নদীর পুরো অববাহিকা গভীর খনন ও দুই পাড়ে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হবে। নদীর দুই পাড়ে মেরিন ড্রাইভ তৈরি করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সড়ক যোগাযোগের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। এর ফলে প্রায় পৌনে ২০০ বর্গ কিলোমিটার জমি উদ্ধার করা সম্ভব হবে, যেখানে একাধিক শিল্প এলাকা ও স্যাটেলাইট শহর গড়ে তোলা হবে।

কিন্তু ভারতের অনানুষ্ঠানিক আপত্তিতে এখনও পর্যন্ত এ নিয়ে এগোয়নি বাংলাদেশ সরকার। যে এলাকা জুড়ে এই মহাপ্রকল্প গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে, সেখান থাকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে ভারতের শিলিগুড়ি করিডোর, যাকে অনেকেই ভারতের ‘চিকেনস নেক’ নামে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ভারতের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর সঙ্গে দক্ষিণের সড়কপথে যোগাযোগের মাধ্যম এই করিডোর। ডোকলাম পাসসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্তবিরোধ রয়েছে। ফলে শিলিগুড়ি করিডোরের এত কাছে চীনের উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কিত ভারত।

ভারতের এই শঙ্কা এবং বাংলাদেশের এ নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কথা অজানা নয় চীনেরও। ২০২২ সালে তৎকালীন চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং এ নিয়ে প্রকাশ্যেই নিজের মত জানান। তিনি বলেছিলেন, ”আমার হয়তো এটা বলা উচিত নয়, কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে উদ্বিগ্ন যে বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীতে… বাইরের কোনো চাপে তার অবস্থান পরিবর্তন করবে কিনা, আমি নিশ্চিত নই।”

তিনি  আরো বলেন, ”চীন যদি প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং পরে প্রকল্পের বিষয়ে ‘চীনা ঋণের ফাঁদ বা ভূ-রাজনৈতিক সংবেদনশীলতা’ উল্লেখ করে কারো পরামর্শে বাংলাদেশ যদি সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, তাহলে একটা বাজে পরিস্থিতি তৈরি হবে।”

তবে বর্তমান রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন গত বছরের ২১ ডিসেম্বর এক সেমিনারে বলেন, ”আসন্ন নির্বাচন শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করছি। তিস্তা নদীর উন্নয়নে চীন কাজ করতে আগ্রহী। আশা করছি যে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তিস্তা প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পারবো।”

একই বছরের আগস্টে রংপুরে এক মহাসমাবেশে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন। শেখ হাসিনার সঙ্গে মঞ্চে উপস্থিত অন্য অনেকের মধ্যে নবনিযুক্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও ছিলেন।

বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। তিনি মনে করেন, ভারতের সদিচ্ছার অভাবই তিস্তাকে ঘিরে এই সংকটের জন্য দায়ী এবং এ কারণে দুই দেশের সম্পর্কেও ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ”খসড়া হয়ে যাওয়ার পর একটা চুক্তি হয়ে যাবে, হয়ে যাবে বলার পর একটা চুক্তিকে ডিপ ফ্রিজে রেখে দেয়া হয়েছে। কোনো কথাই নেই এটা নিয়ে। এটার প্রভাব পড়ে। একটা নদীতে পানি কম আছে আমরা জানি, প্রয়োজন অনেক বেশি। কিন্তু সেটা যে ভাগাভাগি করা যাবেই না একেবারে, এটা মেনে নেয়া যায় না।”

তিনি বলেন, ”তিস্তা প্রকল্প নিয়ে যদি চীন বেশি এগোয়, তাতে ভারতের আপত্তি থাকারই কথা। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইস্যুতে যে ত্রিদেশীয় (ভারত, চীন এবং রাশিয়া) সমর্থন, সেটা বজায় রাখাটা একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় কিনা, এটাও চিন্তার বিষয়।”

ব্রহ্মপুত্র নদ নিয়ে ত্রিমাত্রিক সংকট

পশ্চিমে নির্ভরতা, পশ্চিমে দ্বন্দ্ব

বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ৷ এর মধ্যে রানা প্লাজা ধসের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা (জিএসপি) না পেলেও জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকার কারণে ইউরোপের বাজারে এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে রপ্তানি বাড়িয়েছে বাংলাদেশ৷ তবে জিএসপি সুবিধাপ্রাপ্ত দেশগুলোর শ্রম অধিকার, মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতার মতো ইস্যুগুলোকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ গত বছরের শেষদিকে প্রকাশিত সবশেষ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্রাসেলস৷ মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের ভয়াবহ লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জিএসপি সুবিধা তুলে দেয়া হতে পারে বলেও সতর্ক করা হয়েছে৷ অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র গত বছরের শেষদিকে শ্রম অধিকার লঙ্ঘনকারী দেশগুলোর উপর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞাসহ নানা ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে, যা নিয়ে উদ্বেগ আছে বাংলাদেশের অনেক রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদের মধ্যে৷

বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে  বিবৃতি দিয়েছে তাতে কি এই আশঙ্কা আরো বাড়তে পারে? বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মূখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অবশ্য এখনই ততটা শঙ্কার কারণ দেখছেন না৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘মানবাধিকার, শ্রম অধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইদানীংকার যে বিবৃতি বা মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে শ্রমনীতি ঘোষণা করেছে, সেগুলো অ্যাকশনে যাবে কিনা বা কতদূর যাবে তা এখনও পরিষ্কার নয়৷ নির্বাচনের পরে তাদের যে বক্তব্য আমরা শুনেছি, সেখানে তারা হতাশার কথা বলেছেন, নির্বাচন যেভাবে হয়েছে তা নিয়ে৷ কিন্তু এর ভিত্তিতে বাণিজ্যিক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে এমন ইঙ্গিত কোথাও দেয়া হয়নি৷”

তবে শ্রম অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কাছ থেকে চাপ আগের মতো অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ৷ ডিডাব্লিউকে তিনি বলেন, ‘‘মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের যেসব কথা বলা হচ্ছে, সেগুলো তো নতুন কথা নয়৷ আমার যেটা মনে হয়েছে, তারা বলেছে, এই বিষয়ে আগামী দিনে কাজ করবে বাংলাদেশ সরকারের সাথে৷ আমার মনে হয় না এখনই কিছু ঘটবে৷ অদূর ভবিষ্যতে কোনো পলিসির পরিবর্তন ঘটবে বলে আমার মনে হয় না৷ আলাপ-আলোচনা হবে হয়ত৷ বাংলাদেশ সরকারও জানিয়েছে, তারা মধ্যম মেয়াদে এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে৷”

জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে ২০২৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক উত্তরণ ঘটার কথা রয়েছে৷ নিয়ম অনুযায়ী এর তিন বছর পর ইউরোপের বাজারে বিদ্যমান শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ৷ তবে তা অব্যাহত থাকতে পারে যদি বাংলাদেশ জিএসপি প্লাস নামের ইউরোপের আরেকটি ব্যবস্থার জন্য বিবেচিত হয়৷ এজন্যও বাংলাদেশকে শ্রম, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতার কিছু শর্ত পূরণ ও মানদণ্ড অর্জন করতে হবে৷ শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব না হলে সরকারের প্রতি বিকল্প পরামর্শ ড. জাহিদ হোসেনের৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘এলডিসিভিত্তিক যেই সুবিধাগুলো ভিন্ন পথে গিয়েও পুনর্বহাল করা যেতে পারে৷ যেমন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বা কোনো অর্থনৈতিক জোটে ঢুকতে পারলে ঐ জোটের বাজারগুলো বাংলাদেশ সহজে ধরতে পারবে৷”

ভারসাম্যের দড়িখেলায় উৎরাবে বাংলাদেশ?

চীন এবং ভারত এই অঞ্চলে পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে দুই দেশই সরকারকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে তারা ‘মুক্ত ও অবাধ’ বলে মনে করে না।

নির্বাচনের আগে থেকেই মানবাধিকার ইস্যুতে ভিসা নিষেধাজ্ঞা থেকে শুরু করে নতুন শ্রমনীতিসহ নানা ধরনের চাপ এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। নানা পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে নির্বাচনকে, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি কেন্দ্র করে আসতে পারে আরো নিষেধাজ্ঞা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নানা পর্যায়ের নেতা-কর্মী যুক্তরাষ্ট্রের চাপকে ‘তোয়াক্কা’ না করার কথা বলে এসেছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং নবনির্বাচিত সরকারের সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৩ জানুয়ারি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘এই সরকার যাতে ক্ষমতায় থাকতে না পারে, সে জন্য তারা (বিরোধী দল) তাদের বিদেশি বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে আছে। তবে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কোনো নিষেধাজ্ঞা বা ভিসা নীতি নিয়ে মাথা ঘামান না।”

নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদও দায়িত্ব নেয়ার আগে তথ্যমন্ত্রী থাকা অবস্থায় একই ধরনের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। মন্ত্রিসভায় নতুন দায়িত্ব পাওয়ার দুদিন আগে (৯ জানুয়ারি) বলেছেন,  ”বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আমরা সব সময় দেখে এসেছি, চীন, রাশিয়া যা বলে, যুক্তরাষ্ট্র তার উল্টোটা বলে।”

অবশ্য পশ্চিমাদের ওপর রপ্তানি নির্ভরতার প্রসঙ্গটিও উঠে এসেছে তার বক্তব্যে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর (১২ জানুয়ারি) বলেছেন, ”…চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবো এবং দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবো, পূর্ব-পশ্চিম সবার সাথে সম্পর্কের আরও উন্নয়ন ঘটাবো।”

মাইকেল কুগেলমানও মনে করেন, অর্থনৈতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে পশ্চিমের মুখোমুখি দাঁড় করানো এই মুহূর্তে বাস্তব নয়। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ”এটা সত্য যে, নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের ওপর পশ্চিমা চাপ ঢাকা ও পশ্চিমের সম্পর্কের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু হাসিনা এবং তার সরকার জানে যে, তারা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেও পশ্চিমারা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এটি বাংলাদেশের রপ্তানিপণ্য়ের শীর্ষ গন্তব্য, মানবিক সহায়তার একটি বড় উৎস এবং এটি এমন একটি অঞ্চল যা বাংলাদেশকে কৌশলগত ভূমিকার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে- যা ভবিষ্যতে নিরাপত্তা সহায়তার সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করে।”

বাংলাদেশ অতীতের মতো ভবিষ্যতেও বিবদমান ভূ-রাজনৈতিক পরিসরে বিবদমান পক্ষগুলোর মধ্যে সফলভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারবে বলেও মনে করেন তিনি। বলেন, ”এটি (বাংলাদেশ) এমন একটি দেশ, যেটি ভারতের মতোই, তাদের কাছে (পশ্চিমা দেশ) নতি স্বীকার না করে প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার একটি শক্তিশালী ক্ষমতা দেখিয়েছে। শেখ হাসিনা উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের সঙ্গে, ভারত ও চীনের সঙ্গে, পশ্চিম ও অ-পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় বিশেষভাবে পারদর্শীতা দেখিয়েছেন।”

তবেসেই ভারসাম্য কিভাবে রক্ষা করা হবে, সেটিই এখন প্রশ্ন। বিশেষ করে, টানা চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলাদেশের ব্যাপারে ‘আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ চলছে বলে ইঙ্গিত দেন। ১৩ জানুয়ারি নিজের নির্বাচনি এলাকা গোপালগঞ্জ ৩ আসনের আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের সঙ্গে নির্বাচন-পরবর্তী শুভেচ্ছা ও মতবিনিময় সভায় শেখ হাসিনা ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এখনও ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি’ উল্লেখ করে বলেন, ”এই ষড়যন্ত্র দুই ভাগে বিভক্ত। এক হচ্ছে খুনি বা অপরাধী, যুদ্ধাপরাধী; যাদের বিচার নিশ্চিত করা হয়েছে, তারা ষড়যন্ত্র করছে। আরেকটি আন্তর্জাতিক স্তরের।”

শেখ হাসিনা বলেছেন, অন্যান্য কারণ ছাড়াও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের ওপর অনেক দেশের ‘কুদৃষ্টি’ রয়েছে।

পূর্বের খবরআওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর আতঙ্কে ভুগছেঃ বিএনপি
পরবর্তি খবরফ্রান্সে এম সি ইনস্টিটিউটের স্থায়ী ভবন উদ্বোধন