হাসপাতালে ঠাঁই মিলছে না রোগীর৷ আইসিইউ-এর জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে যাচ্ছেন রোগীর স্বজনেরা৷ স্বজন হারিয়ে আহাজারিই শুধু সঙ্গী হয়েছে তাদের৷
মশক বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ নদী কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সঠিক পথে কাজ না করলে কীভাবে থামবে এই মৃত্যুর মিছিল? দেখেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামকে দিয়ে উত্তর সিটি কর্পোরেশন একটা জালিয়াতির ওষুধ কার্যক্রমের উদ্বোধন করিয়েছে৷ অথচ মন্ত্রীকে এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেলার কারণে মন্ত্রণালয় থেকে কোনো তদন্ত কমিটি করা হল না৷ যারা এই অসৎ কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত তাদের দিয়েই করা হয়েছে তদন্ত কমিটি৷
‘‘আবার দেখেন, ১০০টা ফগার মেশিন কেনা হবে, এর দাম সর্বোচ্চ দুই কোটি টাকা হবে৷ এর জন্য ছয় জন কর্মকর্তা জার্মানি ঘুরে এলেন৷ এভাবে তারা জনগণকে জিম্মি করে নিজেরা অর্থ উপার্জন করছেন৷ এখন ডেঙ্গুতে মৃত্যু বাড়ছে, ফলে সরকারও বাজেট বাড়াচ্ছে৷ তারা এটাই চায়৷ বেশি বাজেটের টাকা দিয়ে কেনাকাটার নামে নিজেরা সুবিধা নিয়ে নিচ্ছে৷ কালো তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ওষুধই ছিটানো হচ্ছে৷ এগুলো দেখার কেউ নেই৷ তাহলে কীভাবে থামবে এই মৃত্যু?”
‘অর্ধেকই মারা গেছেন হাসপাতালে আসার দুই দিনের মধ্যে’
মশার উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করতে ২০২১ সালে ড্রোন ব্যবহার শুরু করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন৷ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) চালু করে ‘ব্যাঙ থেরাপি’ অর্থাৎ ব্যাঙ দিয়ে মশা নিধন কার্যক্রম৷ এ ছাড়া মশা নিধনে জলাশয়ে নোভালরুন ট্যাবলেট, গাপ্পি মাছ ও হাঁস ছাড়ার ঘটনাও দেখেছেন নগরবাসী৷
গত জানুয়ারিতে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যায় যুক্তরাষ্ট্রে৷ ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের কমার্শিয়াল ল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (সিএলডিপি) আমন্ত্রণে ফ্লোরিডার মায়ামিতে যান তারা৷ সেখানে অভিজ্ঞতা নেয়ার পর গত ২০ জানুয়ারি মায়ামি থেকে মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘এতদিন ভুল পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা হয়েছে৷ সে কারণে মশার লার্ভা ধ্বংস হয়নি বরং বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে৷ মায়ামির ল্যাবরেটরিতে মশার প্রজাতি নির্ণয় করে বাসিলাস টুরিংজেনেসিস ইসরাইলেনসিস (বিটিআই) দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করা হয়৷ মায়ামির সঙ্গে বাংলাদেশের আবহাওয়ার মিল রয়েছে৷ তাই বিটিআই দিয়ে ঢাকায় মশা নিধন করা হবে৷”
এরপর শুরু হয় বিটিআই আমদানি কার্যক্রম৷ গত জুলাইয়ে সিঙ্গাপুর থেকে বিটিআই আমদানির ঘোষণা দেয় ডিএনসিসি৷ দ্রুতই পাঁচ টন বিটিআই আসে চট্টগ্রাম বন্দরে৷ আমদানি ও সরবরাহকারী দায়িত্বে ছিল ‘মার্শাল এগ্রোভেট লিমিটেড’৷ যদিও ভেজাল ওষুধ সরবরাহের অপরাধে এক সময় প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছিল ডিএনসিসি৷
‘উত্তর সিটি কর্পোরেশন জালিয়াতির ওষুধ কার্যক্রম চালু করেছে’
ঠিক যখন মাঠ পর্যায়ে প্রয়োগ শুরুর কথা, তখনই ধরা পড়ে সিঙ্গাপুর থেকে নয়, ওই বিটিআই এসেছে চীন থেকে৷ মার্শাল এগ্রো জালিয়াতি করে ডিএনসিসির কাছে গছিয়ে দিয়েছে পণ্যটি৷ অপরদিকে, ‘বেস্ট কেমিক্যালস’ জানায়, মার্শাল এগ্রোভেট বা ডিএনসিসিকে তারা বিটিআই সরবরাহ করেনি৷ ভেজাল ওষুধের ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয় পাঁচ সদস্যের কমিটি৷ ওই কমিটির রিপোর্ট এখনও জমা হয়নি৷ কমিটির প্রধান ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী একেএ শরিফ উদ্দিন চলে গেছেন পোল্যান্ড৷ সেখান থেকে রাস্তার বাতি কিনবেন তিনি৷
জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী সেলিম রেজা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মশক নিধনে বিটিআই আমদানি একটি ভালো উদ্যোগ ছিল৷ কিন্তু আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কাছে আমরা প্রতারণার শিকার হয়েছি৷ প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় কালো তালিকাভুক্ত করে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে৷ তা ছাড়া টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ছিল কিনা, সে বিষয়ে টেন্ডার কমিটি একটি রিপোর্ট দিয়েছে৷ আমরা বিশেষজ্ঞ দিয়ে সেটি যাচাই করে দেখব৷ তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে৷ তবে আমাদের মশক নিধনের স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে৷ জনগনকে সচেতন করতে নানা ধরনের কর্মসূচি চলছে৷”
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, মশা নিধনে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ থেকে আরও ভয়াবহ হবে৷ বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে৷
পরিস্থিতি কেন নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, এমন প্রশ্নের জবাবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বেনজীর আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই মৃত্যুর দুটি দিক আছে৷ একটি ভাইরাস এবং অপরটি মশা৷ প্রথমত এই ভাইরাসের অন্তত পাঁচটি ভ্যারিয়েন্ট আছে৷ কেউ যদি একবার কোন একটি ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হন, তাহলে তার শরীরে শুধু ওই ভ্যারিয়েন্টের ইউমিনিটি তৈরি হয়৷ কিন্তু অন্য ভাইরাসে আক্রান্ত হলে অবস্থা আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে৷”
তিনি আরো বলেন, ‘‘এক গবেষণায় দেখা গেছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের মধ্যে অর্ধেকই মারা গেছেন হাসপাতালে আসার দুই দিনের মধ্যে৷ অর্থাৎ দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে৷ এখন এই বিষয়ে যে গবেষণা দরকার সেটা তো নেই৷ দ্বিতীয়ত, এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু হচ্ছে৷ সেই মশা মারার কার্যক্রম তো আমরা দেখছি না৷ সিটি কর্পোরেশন মশা মারছে ফগার মেশিন দিয়ে৷ এই ফগার মেশিন কারা চালাচ্ছে? যাদের একটুও টেকনিক্যাল জ্ঞান নেই৷ কোন বিশেষজ্ঞও তাদের গাইড করছে না৷ তাহলে কীভাবে হবে?”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরেটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের মশা মারার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে৷ কিন্তু মশা মারার সঠিক পদ্ধতি ও ব্যবস্থাপনা এখনো গ্রহণ করা হয়নি৷ বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি পদ্ধতি প্রয়োগ করে ধাপে ধাপে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে৷ কারণ এখনই হাসপাতালগুলোতে রোগী বাড়ছে৷ এই অবস্থা চলতে থাকলে সামনে বিপদ৷ তাই রোগী যাতে আর না বাড়ে সেজন্য পদক্ষেপ নিতে হবে৷ মশার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটার সমাধান সম্ভব না৷ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার পর অন্য রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে৷ যে কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে৷”
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. মো. গোলাম সারোয়ার ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শত্রুর সঙ্গে তো আপনি ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে লড়াই করতে পারবেন না৷ আবার এই লড়াইয়ের জন্য আপনার পর্যাপ্ত সামরিক জ্ঞান থাকতে হবে৷ তা না হলে আপনার গুলি শত্রুর গায়ে না লেগে নিজের গায়েও লাগতে পারে৷ আমরা তো শত্রু চিনি৷ এডিস মশা৷ কিন্তু দেশে মশা মারার সঠিক ব্যবস্থাপনা তো নেই৷ ওষুধের প্রয়োগ, সঠিক সময় ও প্রশিক্ষিত জনবল- এই তিনটি ব্যবস্থা বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি ব্যবস্থাপনায় থাকতে হবে৷ কিন্তু আমরা কী সেটা করতে পারছি? ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে৷”
গত শনিবার রাজধানীর উত্তরায় এক অনুষ্ঠান শেষে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘‘ডিএনসিসি সফল নাকি ব্যর্থ, সেই বিচার জনগণ করুক৷ সিটি কর্পোরেশন যে সক্রিয় রয়েছে, জনগণ তা দেখছেন৷ আমরা বসে নেই, মশক নিধনে নিয়মিত বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যাচ্ছি৷ জনগণকে সম্পৃক্ত করছি, সচেতনতা বাড়াচ্ছি৷ মাইকিং করে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে৷ ডিএনসিসির ওয়েবসাইটে সবার ঢাকা অ্যাপস ও ফেসবুক পেজে এলাকাভিত্তিক মশক কর্মীর তালিকা দেয়া আছে৷ সবাই সরাসরি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন৷”