দেশে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স কতোটা যৌক্তিক?

133

ঢাকাঃ ‘চতুর্থ শিল্প-বিপ্লব ও বাংলাদেশ’ বইয়ে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস, এমএফএস বা মোবাইল ব্যাংকিং রূপান্তর (ট্রান্সফর্মেশান) নিয়ে দিকনির্দেশনা আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সার্ভিস এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড উভয়েই বইতে বর্ণিত মোবাইল ব্যাংকিং  ট্রান্সফর্মেশানের রূপরেখা সম্পর্কে সম্যক অবগত।

বাণিজ্যিক ব্যাংকের ফিনটেক (ফাইন্যান্সিয়াল টেকনোলজি) এপ্লিকেশনের জন্য আলাদা  ডিজিটাল ব্যাংকের বেদরকারি। বরং ফিনটেকই বাণিজ্যিক ব্যাংকের ডিজিটাল ট্রান্সফর্মেশানের গন্তব্য। উন্নত বিশ্বের ব্যাংকগুলো বহু আগেই হোম ও কার লোন, সঞ্চয় ও বিনিয়োগ, অপরাপর ঋণ, প্রিমিয়াম পেমেন্ট, মর্টগেজ ইত্যাদি ব্যাংকিং পণ্য ও সেবাকে ফিজিক্যাল সেবা থেকে সরিয়ে বিগ-ডেটাভিত্তিক ফিনটেকে রূপান্তর করেছে। সার্বিকভাবে ব্যাংকের সব সেবাই কমবেশি বিগডেটা (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নয়) ভিত্তিক ফিনটেক অ্যাপে ট্রান্সফর্ম হবে, যা ব্যাংকের ওয়েবসাইটে বা মোবাইল অ্যাপে ইন্টিগ্রেটেড হবে। এটাই রোডম্যাপ যেখানে গতানুগতিক ব্যাংকিং সেবার জন্য ব্যাংকে যাওয়া লাগে না, আর্থিক সেবার আবেদন, বিবেচনা এবং অনুমোদন নিষ্পত্তি হয় ডেটা ও পলিসি ভিত্তিতে, ক্রেডিট রেটিং ভিত্তিতে, গ্রহীতার আয় ও ব্যয়, আর্থিক অপরাধ বা ঋণের কিস্তি ফেরতের অতীত রেকর্ড সাপেক্ষে। এ পর্যায়ের পরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যোগে আসছে নতুনতর বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সেবা, কিংবা ব্লক চেইন ভিত্তিক ডকুমেন্ট ও ডিসিশন প্রসেসিং।

 

 

বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সব ‘ক্যাশ ইন’ টাকা যেহেতু ‘ক্যাশ আউট’ হয় না, তাই বইতে প্রস্তাবনা ছিল যে, এসব টাকার ঋণদান, বিনিয়োগ ও মুনাফার ইন্টারফেইস দরকার। মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে পেমেন্ট করা, শপিং, টিকেটিং, আবেদন ফি জমা দেয়া যায়। শুধুমাত্র ঋণদান কিংবা আমানত হিসাবে অর্থ সংগ্রহ করা যায় না, এজন্য দরকার যথাযথ আর্থিক ও কারিগরি রেগুলেশান, কনফ্লিক্টহীন পণ্য ও সেবা পরিকল্পনা, প্রতারণা প্রতিরোধী ব্যবস্থাপনা এবং আর্থিক জালিয়াতি নিষ্পত্তির বিধান।

বইতে প্রান্তিক মানুষের জন্য কোলেটারেলহীন এনআইডি ভিত্তিক একটা ডিজিটাল ক্রেডিট রেটিং করার প্রস্তাবনা ছিল। কাজটা বিদ্যমান ব্যাংকগুলোই পারে, যেখানে এমএফএস ঋণ বিতরণ ও আমানত গ্রহণের বিতরণ অবকাঠামো বা ডিস্ট্রিবিউশান নেটওয়ার্ক হিসেবে কাজ করবে, দরকার এমএফএস ও ব্যাংকগুলোর যৌথ ফ্রেমওয়ার্ক। কিন্তু এজন্য সম্পূর্ণ নতুন ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স আবেদন গ্রহণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে সরকার মাত্র দু-তিনটি এমএফএস’কে সুরক্ষা দিতে ‘কন্টেন্ট ভার্সেস পাইপ লাইনের’ অযৌক্তিক বিতর্ক তুলে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিযোগিতায় গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংকের সঙ্গে ব্যাংকিং কনসোর্টিয়ামের বিনিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেছে, এতে মোবাইল ব্যাংকিং খরুচে থেকে গেছে।

বাংলাদেশে মাথাপিছু ব্যাংক সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কয়েকগুণ। বর্তমানে ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে চেষ্টা করছে প্রায় পাঁচশত প্রতিষ্ঠান, ৫২টি যৌথ আবেদন জমা পড়েছে। এর মধ্যে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, মোবাইলে আর্থিক সেবা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি স্ট্যার্টআপ কোম্পানি, মোবাইল অপারেটর, গ্যাস পাম্প কোম্পানি, ঢেউ শিট উৎপাদনকারী কোম্পানিও রয়েছে, আবার বিদেশি আর্থিক প্রযুক্তি কোম্পানিও আবেদন জমা দিয়েছে। স্মরণ করি যে, দেশের ফার্নিচার কোম্পানিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের লাইসেন্স দেওয়ার অভিজ্ঞতা সুখকর হয়নি।

 

 

দেশের ৫২টা গ্রুপ নতুন ব্যাংকিং লাইসেন্স চায়, এটা ভয়ের ব্যাপার। এদের অনেকেরই অতীত রেকর্ড খারাপ, কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত খেলাপি, পাচারকারী লুটেরাও! বলা হচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংক হবে অ্যাপ ভিত্তিক, কোনো শাখা থাকবে না, শুধু থাকবে একটা হেড অফিস। ইতিমধ্যেই এজেন্ট ব্যাংকিং, নগদ ও বিকাশের স্ক্যামিং, রেমিট্যান্স অ্যাপের স্ক্যামিং, অ্যাপ বেজড ডিজিটাল এমএলএম, ই-কমার্স স্ক্যামিং, গেটওয়েতে টাকা আটকানোর নামে স্ক্যামিং, নিরাপত্তার ওটিপি মেসেজ চুরি, ডিজিটাল ক্রেডেনশিয়াল জালিয়াতি সব কিছুই চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেছে। আর্থিক ও ডিজিটাল খাতের জালিয়াতির কোনো বিচার, শাস্তি কিংবা ফাইন্যান্সিয়াল সেটেলমেন্টের স্বচ্ছতা তীব্রভাবে প্রশ্নযুক্ত। দেশের ডিজিটাল এরিনার নিরাপত্তা দুর্বলতাও নাজুক!

বাংলাদেশে কোনোকিছুর আগে ডিজিটাল শব্দ বসিয়ে আর্থিক জালিয়াতির হাট বসানো হচ্ছে ক্রমাগত। ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, এহসান গ্রুপ, আলেশা মার্টের অ্যাপভিত্তিক ডিজিটাল এমএলএম সেবায় লাখ লাখ গ্রাহক সর্বস্বান্ত হয়েছেন। প্রতারণার পরিমাণ শত কোটিতে নয় বরং হাজার কোটিতে। এর সর্বশেষ এমটিএফই কেলেঙ্কারি যারা বাংলাদেশের গ্রাহকদের ১১ হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছে। এমটিএফইতে ভোটার আইডি, নাম-ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর, ব্যাংক হিসাব নম্বর (পরে শুধু মুঠোফোন নম্বর দিয়েই) এমটিএফই হিসাব খুলে কোনো একটি মোবাইল ব্যাংকিং প্ল্যাটফরম ব্যবহার করে নির্দিষ্ট নগদ, বিকাশ বা রকেট নম্বরে গ্রাহক টাকা পাঠান এমটিএফইতে যা হুন্ডিতে বিদেশে থাকা এমটিএফই’র এজেন্ট বা প্রতিনিধির কাছে চলে যায়। এভাবে বিনিয়োগ চলতে থাকে।

 

 

ওদিকে ফাইন্যান্সে শেয়ার বা ডলার কেনাবেচার পর অর্থ পয়েন্ট হিসেবে এমটিএফইতে থাকা গ্রাহকের ওয়ালেটে জমা হয়। সেখান থেকে অর্থ উত্তোলন করতে হয়। সেই টাকা আবার বিদেশ থেকে নগদ, বিকাশ বা রকেটের মাধ্যমে দেশে গ্রাহকের কাছে চলে আসে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে একসঙ্গে যেহেতু বিদেশ থেকে ৩০ হাজার টাকার বেশি অর্থ পাঠানো যায় না, তাই যারা এই পুঞ্জি স্কিমের বড় খেলোয়াড়, তারা অসংখ্য মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট খুলে কাজটা সারেন। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের লাখো গ্রাহক জানেনই না তাদের নামে হিসাব নম্বর, গরিব মানুষকে কিছু টাকা দিয়ে অজান্তে এসব অ্যাকাউন্ট খোলা হয় (২৪শে আগস্ট ২৩, সমকাল)। একইভাবে অপরাধীরা মোবাইল সিম তোলে, অপরাধীরা অন্যের টিন ব্যবহার করে গাড়ি কিনে! প্রায়ই দেখা যায়, সরকারি বয়স্ক প্রতিবন্ধী ও শিক্ষা উপবৃত্তির ভাতার টাকা জালিয়াতি হয়, এসব ক্ষেত্রে হয় মোবাইল নং পরিবর্তন করা হয় নতুবা ওটিপি’তে পাঠানো কোড সার্ভার থেকে জালিয়াতি হয়। অর্থাৎ ডিজিটালের নামে বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং ও ই-কেওয়াইসি প্রতারণার বাজার খুলে বসেছে। এসব নিয়ন্ত্রণ না করে, মনিটরিং ও শাস্তির কাঠামো ঠিক করে, ডিজিটাল ব্যাংক নতুনতর বিপর্যয় তৈরি করবে।

এসব নিরসন করে, চাইলে মোবাইল ব্যাংকিংকে ট্র্যাডিশনাল ব্যাংকের সঙ্গে কনসোর্টিয়াম করে ডিজিটাল ফিনটেক সেবা দেয়া যায়। শুধুমাত্র এমএফএস সেবাদাতাদের সহযোগে ব্যাংকগুলোর যাদের খেলাপি ঋণের বদনাম কম তাদের ফিনটেক ভিত্তিক মোবাইল ব্যাংকিং ঋণ দান ও আমানত সংগ্রহের অনুমতি দেয়া যায়, পারফরমেন্স ইনডেক্স বা কেপিআই ভিত্তিতে। তথাপি দিনশেষে, প্রত্যেকটা ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাংককেই ফিনটেক ব্যাংক এবং ডিজিটাল ব্যাংক হয়ে উঠতে হবে। মূল রূপান্তর প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে যাকে তাকে ডিজিটাল ব্যাংক খোলার যে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, এটা সঠিক পথে না গেলে অবাক হবো না!  এর আগে ড. আতিয়ার রহমান গভর্নর থাকাকালে তথাকথিত পেমেন্ট ব্যাংক চালুর আলাপ উঠানো হয়েছিল। উনাদের বুঝানো গেছে, এসব আইডিয়াকে বিচ্ছিন্নভাবে এন্টারটেইন না করে বরং সব ব্যাংককেই পেমেন্ট ব্যাংক হিসেবে ট্রান্সফর্ম করাই যুক্তিযুক্ত।

যদি মোবাইল ব্যাংক এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক টাই-আপ হয়ে অ্যাপভিত্তিক তথাপি শাখা নিয়ন্ত্রিত সেবা দেয়, তখন গ্রাহক অভিযোগ ও জালিয়াতির বিচার পেতে পারবেন। ডিজিটাল ব্যাংকের প্রধান অফিসের বাইরে কোনো ব্রাঞ্চ না থাকার কারণে প্রত্যন্ত এলাকার লোকেরা স্ক্যামিং, ঋণ ও আমানত গায়েব ও জালিয়াতির বিচার পাবে না। হাজার হাজার এজেন্ট ব্যাংক গ্রাহক অর্থ জমা দিয়ে এবং রেমিট্যান্স পাঠিয়ে এখন ভুগছেন, তাদের জাল কাগজপত্র দেয়া হয়েছে। ভেরিফিকেশানের ওটিপি মেসেজ নিয়মিত হ্যাক হচ্ছে। এসবের সুরাহা না থাকায় মানুষ নিয়মিত আর্থিক হয়রানিতে পড়েছে।

ফিনটেক অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং দিয়ে ক্ষুদ্র আমানত গ্রহণ ও ঋণ বিতরণ সেবার  নামে ডিজিটাল ব্যাংক মালিকরা নতুন আর্থিক জালিয়াতি ও পাচারের প্লট তৈরি করবে না, এ নিশ্চয়তা নাই। মাত্র ১৫০ কোটি টাকার যৌথ মূলধন এবং একক গ্রুপের মাত্র ৬০ লাখ টাকার অতি নিম্ন মূলধনের শর্তগুলো জালিয়াত ও স্বজনপ্রীতি সহায়ক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘটে যাওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি, লোপাট ও পাচারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় মোটেই। এমএফএসকেন্দ্রিক বহুবিধ জালিয়াতি নিষ্পত্তির কারিগরি এবং ম্যানেজমেন্ট চেইন, লিগ্যাল চেইন, রেগুলেটরি শৃঙ্খলা, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং হ্যাকিং ও স্ক্যামিং সমস্যার প্রতিষ্ঠিত সমাধান অবকাঠামো এস্টাব্লিশড করা ছাড়া ডিজিটাল ফিনটেকের নামে তথাকথিত ডিজিটাল ব্যাংক দেশের সমস্যা বাড়াবে।

বলা হচ্ছে মহাজনী ক্ষুদ্রঋণ থেকে গ্রাহকদের বাঁচাতে ডিজিটাল ব্যাংক দরকার। বাস্তবে ক্ষুদ্র ঋণকেই বরং রেগুলার ব্যাংকিংয়ের বিগ-ডেটা ভিত্তিক ক্রেডিট-রেটিং (ঋণমান) ভিত্তিক নন-ক্যাশ বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করা দরকার, এতে ক্ষুদ্র ঋণের কিস্তি উঠানোর ‘কস্ট  অফ অপারেশন’ কমে সুদের হার কমবে। যেহেতু পাবলিক ডোমেইনে গ্রামীণ গ্রাহকের ঋণ ও আয়ের তথ্য নেই, তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাজনিত ঋণমানের আলাপ একটা হাইপ মাত্র। বাস্তবে এসবের মাধ্যমে ভুল ঋণমানে উল্টো আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বা ঋণ প্রাপ্তি সংকুচিত হবে গরিবের। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা থেকে ঘুষের বিনিময়ে ঋণের তথ্যশালা হাতানোর মতো অপরাধ ঘটতে পারে। সিম ব্যবহারকারীর অসচেতনা কিংবা সামান্য টাকার লোভে ই-কেওয়াইসি ডেটা হাতিয়ে ক্ষুদ্রঋণের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট নিয়ন্ত্রণ করবে প্রতারক চক্র।

ডিজিটাল ব্যাংকের আরেকটা সমস্যা হতে পারে ট্র্যাডিশিনাল ব্যাংক থেকে আমানত প্রবাহ ডাইভার্ট করা। এমনিতেই আর্থিক খাত সমস্যা জর্জরিত এবং ব্যাংক ব্যবস্থার উপর আস্থার সংকট তলানিতে। সংকট ও অনাস্থার কালে ডিজিটাল সিকিউরিটির নিশ্চয়তা না করে ঋণ বিশৃঙ্খলার এসময়ে নতুন ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্স না দেয়াই ভালো!

 

লেখক: ফায়জ আহমদ তৈয়্যব: টেকসই উন্নয়নবিষয়ক গবেষক।

faiz.taiyeb@gmail.com

পূর্বের খবরব্রিকস ব্লকে যুক্ত হল ৬ টি নতুন সদস্য, বাংলাদেশ ব্রিকস থেকে বাদ
পরবর্তি খবরবাংলাদেশের নির্বাচনে ‘ভারত ফ্যাক্টর’ নিয়ে যা বলছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি