নিউজ২১ডেস্কঃ সারাদেশের স্কুলে ভর্তি, ব্যাংকে হিসাব খোলা, পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র করা, বিদেশে ভর্তি- এমন ১৮টি জরুরি কাজের প্রয়োজনে জন্মসনদ আবশ্যিক। সরকার এটি বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু সেই সনদের জন্য পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সেসব ভোগান্তি পেরিয়ে সনদপ্রাপ্তি অনেকটা দুরূহ হয়ে পড়েছে।
অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নভেম্বর মাসেই শিক্ষাবর্ষ শেষ হওয়ার পাশাপাশি নতুন শিক্ষাবর্ষে ভর্তির কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। এ সময় স্কুল পরিবর্তনের বিষয়েও ব্যস্ত থাকেন অভিভাবকরা। এক্ষেত্রে সন্তানের জন্মসনদ অত্যাবশকীয়। কিন্তু পদে পদে ভোগান্তি আর সময়ক্ষেপণের কারণে জন্মসনদপ্রাপ্তি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন তারা। অতিজরুরি এই সেবার প্রাপ্তি আরও সহজ করার দাবি তাদের। প্রযুক্তির এই যুগে অনলাইনেই এসব কাজ সম্পাদনের প্রত্যাশা করছেন তারা।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. আতিকুর রহমান। তিনি কানাডার ভিসার জন্য আবেদন করতে গিয়ে জন্মসনদের কারণে বিড়ম্বনায় পড়েছেন। তার কাছে যে জন্মসনদ রয়েছে, সেটি অনলাইনে করা নয়। তাই নিজ জেলা রাজবাড়ীতে যান তিনি। জেলার মিজানপুর ইউনিয়নে তিন মাস আগে জন্মসনদের জন্য আবেদন জমা দেন। গত ৮ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি জন্মসনদ হাতে পাননি। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, অফিসের কাজে ঢাকায় থাকি। তাই সেখানে গিয়ে খোঁজ নিতে পারি না। বাড়িতে বড় ভাইয়ের মাধ্যমে খোঁজ নিই। ইউনিয়ন অফিসে গেলে বলে সার্ভার নাই। সার্ভার না থাকায় অনেক কাজ জমে গেছে। মাঝে মাঝে সার্ভার এলেও ঠিকমতো কাজ করা যায় না।
জন্মসনদ নিয়ে জটিলতা সম্পর্কে উপ-রেজিস্ট্রার জেনারেল (যুগ্ম সচিব) ড. আবু নছর মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আমাদের সময়কে বলেন, পিক-আওয়ারে সার্ভার লোড নিতে পারে না। তাই মাঝে মাঝে সমস্যা দেখা দেয়। সার্ভারটা যখন বুঝিয়ে দেওয়া হয় তখন ৫০ শতাংশ প্রস্তুত ছিল। এই অবস্থাতেই কাজ চলছে। যখন যেখানে সমস্যা হয়, আমরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিই।
মা-বাবার জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, জন্মনিবন্ধনটা গ্লোবাল ম্যান্ডেট। মা-বাবার জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে সমন্বয় করে নিবন্ধন করলে ইউনিক আইডি তৈরি হবে। বিশে^র বিভিন্ন দেশে জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক। তাই ২০০০ সালের পরে যেসব সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের জন্মসনদ পেতে হলে মা-বাবার অনলাইন জন্মসনদ লাগবে।
বাচ্চার স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে বিপাকে পড়েন খিয়াম আহমেদ। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, জরুরি প্রয়োজনে আমার বাচ্চার পাসপোর্ট করাতে হবে। যাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তাদের জন্য জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। এ জন্য আমি যেখানে থাকি মিরপুর ২-এর ১৭নং ওয়ার্ডে যাই। সেখানে আমার মেয়ের জন্মনিবন্ধন করাতে গিয়ে চরম বিপদের সম্মুখীন হই। ওয়ার্ড অফিস থেকে বলা হয়, বাচ্চার জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার অনলাইন জন্মনিবন্ধন লাগবে। আমার জন্ম যেহেতু খুলনায়, তাই সেখানে খোঁজ নিই। কিন্তু বর্তমানে সেখানে আমাদের পরিবারের কেউ থাকেন না। তাই আমার জন্মস্থানে জন্মনিবন্ধন করাতে পারিনি। কারণ খুলনা সিটি করপোরেশন থেকে বলা হয় স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণপত্র লাগবে।
তিনি বলেন, খুলনা থেকে না করাতে পেরে আবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৭নং ওয়ার্ডে খোঁজ নিই। সেখান থেকেও বলা হয়, স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণপত্র লাগবে। তাই বাধ্য হয়ে আমার নিকটাত্মীয়ের ঠিকানা ব্যবহার করি। এখন প্রসেস চলছে।
সরকারি এই সেবা আরও সহজতর করা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই ভুক্তভোগী। তিনি বলেন, জন্মনিবন্ধন সেবাটি অতিপ্রয়োজনীয়। তাই অনলাইনেই কাজটি সহজতর করা দরকার। এখানে প্রয়োজনে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সেবামূল্য নিতে পারত। এত জরুরি একটি কাজে যেভাবে পদে পদে ভোগান্তি সইতে হয়, তাতে সময়মতো জন্মসনদ হাতে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সেবা সহজতর করা হয়েছে বলে দাবি করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সেলিম রেজা আমাদের সময়কে বলেন, আমরা এখন প্রতিটি ওয়ার্ডে প্রতিদিন এই সেবা দিচ্ছি। ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ওয়ার্ড সচিবের মাধ্যমে এ সেবা দেওয়া হয়। তবে মাঝে মাঝে সার্ভার ডাউন থাকার অভিযোগ পাই। এটি আমাদের হাতে নেই। ২০০০ সালের পর জন্মানো শিশুর মা-বাবার জন্মসনদ বাধ্যতামূলক। এটি জাতীয়ভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত। এখানে সিটি করপোরেশনের কিছু করার নেই।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. ফজলে শামসুল কবির আমাদের সময়কে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিজস্ব সার্ভারে কাজ করে। এখন প্রতিদিন শত শত জন্মসনদ দেওয়া হচ্ছে। কোথাও কোনো জটিলতা নেই। আইন মেনে নিজস্ব সার্ভারে সেবাটি দেওয়া হচ্ছে। এখন আর কোনো জটিলতা নেই।
এদিকে সেবামূল্য কে পাবে- সেই জটিলতায় দীর্ঘ তিন মাস জন্ম ও মৃত্যুসনদ বিতরণ বন্ধ রেখেছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মধ্যস্থতায় টাকা ভাগাভাগির জটিলতার অবসান ঘটে। এরপর গত ৪ অক্টোবর থেকে পুনরায় জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে দক্ষিণ সিটি। অন্যদিকে উত্তর সিটি করপোরেশন আগে আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে সেবাটি দিত। এখন প্রতিটি ওয়ার্ডে ভাগ করে দিয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ডে গিয়ে সার্ভার জটিলতায় আটকে যাচ্ছেন অনেকেই।