দলটির নেতারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, এই কর্মসূচি ঘোষণার আগে বিএনপিসহ সরকার বিরোধী আন্দোলনে থাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। যদিও তাদের গণমিছিল কর্মসূচিতে আর কোন দল সমর্থন দেবে কিনা বা অংশ নিবে কি না সে সম্পর্কে কোন ধারণা পাওয়া যায়নি।
ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র ও যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, এখনকার সংঘাতময় পরিস্থিতিতে দলগুলোর মধ্যে কোন ধরনের সমঝোতা ছাড়া একতরফা তফসিল দিলে পরিস্থিতি আরও সংঘাতপূর্ণ হবে বলে তারা মনে করেন এবং সেটি তারা চান না।
“এ কারণেই আমরা তফসিল ঘোষণার দিন কর্মসূচি দিয়েছি। অন্য দলগুলোর সঙ্গেও কথাবার্তা হচ্ছে,” বলছিলেন মি. রহমান।
তবে বিরোধী দল বিএনপির ভেতরে অবশ্য তফসিল ঘোষণার দিনকে কেন্দ্র করে কী ধরনের কর্মসূচি দেয়া যায় তা নিয়ে আগে থেকেই আলোচনা চলছে। হরতাল ও অবরোধ অব্যাহত রেখে নির্বাচন কমিশন কেন্দ্র করে নতুন কোন কর্মসূচি দেয়া যায় কি না তা পর্যালোচনা করছেন দলের নেতারা।
তফসিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে এভাবে কর্মসূচি ঘোষণা করতে শুরু করলে সেটি নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি বা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নতুন করে কোন চাপ তৈরি করবে কি না সেই প্রশ্নও উঠছে।
তবে নির্বাচন কমিশনের সচিব ও মুখপাত্র মোঃ জাহাংগীর আলম বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে তারা কোন চাপ অনুভব করছেন না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল আগেই জানিয়েছেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ২৯শে জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। সেজন্য দ্রুতই কমিশন বসে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করবে।
সে কারণে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনেকেই ধারণা করছেন যে, এই সপ্তাহের মধ্যেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হতে পারে।
তবে সে দিনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক কর্মসূচি আসতে থাকলে সেটি কমিশনের ওপর আলাদা চাপ তৈরি করবে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলিম।
“নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতা দরকার হয়। সেখানে এ ধরনের কর্মসূচি আসা অব্যাহত থাকলে তো নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন সংক্রান্ত কাজ ঠিকভাবে সম্পন্ন করতে বেশ বেগ পেতে হবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
কর্মসূচি নিয়ে ইসলামী আন্দোলনের ব্যাখ্যা
বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে যেসব ধর্মভিত্তিক দল সক্রিয় আন্দোলন করছে, তার মধ্যে একটি রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন।
গত তেসরা নভেম্বর ঢাকায় দলটির মহাসমাবেশ থেকে চরমোনাই পীর হিসাবে পরিচিত ও ইসলামী আন্দোলনের আমির সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম সরকারকে এক সপ্তাহের সময় বেঁধে দিয়ে বলেছিলেন যে, ‘এর মধ্যে তাদের দাবি না মানলে আন্দোলনরত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে’।
তারই ধারাবাহিকতায় রোববার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে মি. করীম তফসিল ঘোষণার দিন ঢাকায় নির্বাচন কমিশন অভিমুখে গণমিছিল সহ চার দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এছাড়া তফসিল ঘোষণার পরদিন দলটি দেশজুড়ে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচিও দিয়েছে।
এছাড়া তিনি আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচির প্রতি সমর্থন এবং ২০শে নভেম্বর সোমবার ঢাকায় জাতীয় সংলাপে সব দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের কথা জানিয়েছেন।
কিন্তু তিনি মহাসমাবেশে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী এই কর্মসূচি নির্ধারণের আগে বিএনপিসহ আন্দোলনরত দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কি না জানতে চাইলে গাজী আতাউর রহমান বিবিসিকে বলেন, আনুষ্ঠানিক আলোচনার পরিবেশ এখন নেই তাই এসব নিয়ে অনানুষ্ঠানিক কথাবার্তা তারা বিভিন্ন দলের সাথে বলেছেন।
“আমরা সংঘাত এড়াতে কর্মসূচি দিয়েছি, যাতে একতরফা কিছু করা থেকে ইসি বিরত থাকে। আর বিএনপির নেতারা অনেকে কারাগারে কিংবা মামলার আসামী। আলোচনার পরিবেশ নেই। তবে আমাদের সংলাপ হবে ২০শে নভেম্বর। সেখানে সবার সাথে আরও আলোচনার সুযোগ তৈরি হবে,” তিনি বলেন।
যদিও আন্দোলনরত দলগুলোর কর্মসূচি প্রণয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কয়েকজন নেতার সাথে আলাপ করে ধারণা পাওয়া গেছে যে, ইসলামী আন্দোলন যে কর্মসূচি দিয়েছে তফসিলের দিনকে লক্ষ্য করে, তা সম্পর্কে বিএনপি ও জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল আগেই অবহিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরেই আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখা ইসলামী আন্দোলন সম্প্রতি বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।
মূলত এরপর থেকেই বিএনপিসহ আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগের ক্ষেত্র তৈরি হয় বলে দলটির একাধিক নেতা ধারণা দিয়েছেন।
আর এবার ২৮শে অক্টোবরে বিএনপির মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে যোগাযোগ আরও বেড়েছে। ধারণা করা হচ্ছে সামনের দিনগুলোতে কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ আরও বাড়বে।
তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিএনপির সঙ্গে এক মঞ্চে বা প্লাটফর্মে আসা কিংবা যুগপৎ আন্দোলনে যাওয়া – না যাওয়া নিয়ে এখনো নিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
তফসিলকে ঘিরে চাপ ও ইসির বক্তব্য
বিএনপি আগেই ‘একতরফা তফসিল’ ঘোষণা করা থেকে বিরত থাকার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক করেছে। এখন তফসিল ঘোষণাকে সামনে রেখে আন্দোলন কর্মসূচি প্রণয়নে কাজ করছেন দলটির নেতারা।
আবার গত কিছুদিন ধরে বিএনপির কর্মসূচির সাথে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোও একই রকমের কর্মসূচি দিয়ে যাচ্ছে। এখন জামায়াতে ইসলামীও একই ধরনের কর্মসূচি দিচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলনও তাতে সামিল হলে নির্বাচন কমিশনের জন্য কেমন পরিস্থিতি তৈরি হয় তা নিয়ে উদ্বেগ আছে রাজনৈতিক অঙ্গনে।
তবে নির্বাচন কমিশনের সচিব মোঃ জাহাংগীর আলম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে তাদের কিছু বলার নেই।
তিনি বলেন, “কমিশন ও ইসি সচিবালয়ের দায়িত্ব সঠিক সময়ে সঠিকভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি,” বলছিলেন মি. আলম।
কমিশনের বিভিন্ন সূত্র অবশ্য বলছে, সরকারের সঙ্গে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর সমঝোতা না হলে, তফসিল কেন্দ্র করে নানা ধরনের প্রতিবাদ বিক্ষোভ হতে পারে বলেই মনে করছে নির্বাচন কমিশন।
কিন্তু একে কেন্দ্র করে নিরাপত্তাহীনতার মতো কোন পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে ইতোমধ্যে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে কমিশন। সেসব বৈঠকে নানা নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।
সব মিলিয়ে একদিকে বিরোধী দলগুলোর প্রস্তুতি, অন্যদিকে সরকারের তৎপরতায় সহিংস হয়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন তফসিল ঘোষণা করলে সেটি রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলে তা নিয়ে অনেকেই উদ্বিগ্ন।
নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলিম বলছেন, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করা কিংবা সে অনুযায়ী প্রার্থীদের মনোনয়ন জমা দেয়ার মতো বিষয়গুলোর জন্য একটি সুন্দর পরিবেশ থাকা গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতার কোন বিকল্প নেই।
“কিন্তু যেভাবে দলগুলো কর্মসূচির কথা বলছে তাতে করে কমিশনকে কাজগুলো সুন্দরভাবে করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে বলে মনে হচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।