ঢাকাঃ সারাদেশে গণগ্রেফতার নিয়ে ইইউ’র উদ্বেগে মার্কিন দূতাবাসের সমর্থন বিএনপির বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘অগ্নিসন্ত্রাস প্রচারণা’ বিশ্বাস করছে না বিদেশিরা। ‘জঙ্গী’ শব্দটি এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেমন খায় না; তেমনি ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ শব্দটিও তারা গ্রহণ করছে না। বাংলাদেশে জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলছে। ২৮ অক্টোবরের সমাবেশ এবং হরতাল-অবরোধকে কেন্দ্র করে সহিংস ঘটনা ঘটছে। প্রতিদিন যানবাহনে অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটছে। অগ্নিসংযোগের ঘটনাগুলোয় আন্দোলনরত বিএনপির ওপর দায় চাপাচ্ছে ক্ষমতাসীন সরকার এবং আইনশৃংখলা বাহিনী। কোনো এলাকায় আগুন দিয়ে বাস পোড়ানোর ঘটনা ঘটলেই তার দায় আন্দোলনরত বিএনপির ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সরকারও আইনশৃংখলা বাহিনীর মতোই সরকারের সুবিধাভোগী মিডিয়াগুলোও বিএনপির ওপর দায় চাপিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মহল গণমাধ্যমের প্রচারণা বিশ্বাস করছে না এবং সরকারের বক্তব্য আমলে নিচ্ছে না। ২৮ অক্টোবরের সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের এক বিবৃতিতে, ঘটনার সঙ্গে ক্ষমতাসীনরাও জড়িত সন্দেহ করেছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের এক বিবৃতিতে সংস্থাটির মুখপাত্র লিজ থ্রোসেল বলেছেন, ‘অভিযোগ রয়েছে, ২৮ অক্টোবর বিরোধী দলের বিক্ষোভকারীরা প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারকের বাসভবনে হামলা চালায় এবং অন্তত ৩০ জন সাংবাদিককে মোটরসাইকেলে আরোহণকারী মুখোশধারীরা লাঞ্ছিত করে, যারা ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক বলে ধারণা করা হয়।’
জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন কর্মসূচি অবরোধে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। অবরোধের ডাক দিয়ে গ্রেফতার এড়াতে বিএনপির নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। আর ক্ষমতাসীন দলের কর্মী সমর্থকরা আইনশৃংখলা বাহিনীর সামনেই লাঠি, লগি-বৈঠা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় টহল দিচ্ছে। মহানগরের মোড়ে মোড়ে পাহারা বসিয়েছে। এই পরিস্থিতির পরও কোনো যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটলে সে দায় বিএনপির ওপর চাপানো হচ্ছে। আর সরকারের তল্পিবাহক গণমাধ্যমগুলো বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সে খবর ফলাও করে প্রচার করছে। গতকাল আইনশৃংখলা বাহিনী থেকে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হয়েছে যানবাহনে আগুন দেয়া দুর্বৃত্তকে ধরিয়ে দিলে ২০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে।
বাস্তবতা হচ্ছে, সরকারের এমন প্রচারণা আন্তর্জাতিক মহল আমলে নিচ্ছে না। কারণ তারা নিজেরাই বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার চিত্র পর্যবেক্ষণ করছেন। গত ৫ নভেম্বর ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রবিষয়ক ও সিকিউরিটি পলিসি প্রধান এবং ইউরোপীয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোরেল বাংলাদেশে হাজার হাজার বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি সেই সাথে সবপক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার পাশাপাশি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উপায় খুঁজে বের করার তাগিদও দিয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (আগের টুইটার) জোসেফ বোরেল লিখেছেন-
‘বাংলাদেশে আট হাজারেরও বেশি বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করায় (আমি) উদ্বিগ্ন। সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। আমরা সব পক্ষকে সহিংসতা থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করি। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার জন্য সহায়ক, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজে বের করাটা গুরুত্বপূর্ণ।’
বিরোধী দলের (বিএনপি) নেতাকর্মীদের গ্রেফতার নিয়ে জোসেফ বোরেলের উদ্বেগের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস। বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসের অফিসিয়াল এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে বোরেলের টুইট শেয়ার করে লেখা হয়, আমরাও এর সঙ্গে একমত।
সরকারের মন্ত্রী-এমপি, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী এবং আইনশৃংখলা বাহিনী বাসে আগুন দেয়ার জন্য বিএনপিকে দায়ী করলেও নিরপেক্ষ তদন্তের আগে প্রকৃত সত্য জানা সত্যিই কঠিন। অবরোধ ডেকেই গ্রেফতার এড়াতে বিএনপির নেতারা কার্যতঃ আত্মগোপনে থাকেন। রাজপথে দেখা যায় অবরোধ ঠেকাতে হকিস্টিক, লাঠি, রামদা, লগি-বৈঠা হাতে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের মহড়া দিতে। অবরোধের দিন এ চিত্র সাধারণ ঘটনা। আর আইনশৃংখলা বাহিনীর কঠোর নজরদারি চলছে। পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব, বিজিবি এবং ৬০ হাজার আনসার বাহিনীকে নামানো হয়েছে। এ মধ্যে বিএনপির নেতাকর্মীদের পিকেটিং কর দুস্কর। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেখা যায়, কাকরাইলে পুলিশের বাসে এবং মালিবাগে ফ্লাইওভারে একটি বাসে আগুন দেয়ার পর বাসের ড্রাইভার এবং হেলপার স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আইনশৃংখলা বাহিনীর পোশাক পরেই বাসে আগুন দেয়া হয়েছে’। ‘পুলিশের পাশ দিয়ে গিয়ে আগুন দেয়া হয়েছে’। ‘আগুন দিয়ে পুলিশের সঙ্গে ঘোরাঘুরি করছে’। ফলে বাসে আগুন লাগানোর ঘটনার পরপরই সরকার এবং আইনশৃংখলা বাহিনী বিএনপিকে দায়ী করলেও আন্তর্জাতিক মহল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব সচিত্র খবর ও তথ্য নিজেরাই সংগ্রহ করেন। ফলে আগুনসন্ত্রাসের দায় কার তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
শুধু ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস নয়, ইইউ’র পররাষ্ট্রবিষয়ক ও সিকিউরিটি পলিসি প্রধান এবং ইউরোপীয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোরেলের বক্তব্য সমর্থন করে ট্যাগ দিয়েছে কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সিভিকাস: ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর সিটিজেন পার্টিসিপেশন, কমিটি টু প্রজেক্ট জার্নালিস্ট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর হিউম্যান রাইটস, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার, গ্লোবাল প্রেস মিডিয়া, প্রেস ফ্রিডমসহ অর্ধশত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও প্রভাবশালী গণমাধ্যম। ইইউ পররাষ্ট্রবিষয়ক ও সিকিউরিটি পলিসি প্রধান এবং ইউরোপীয়ান কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্টের উদ্বেগকে সমর্থন করে মো. জাহিদ লিখেছেন, ‘এভাবে উদ্বেগ হলে কাজ হবে না পদক্ষেপ নিতে হবে’। মো. নায়েম নামের একজন লিখেছেন, ‘আন্তর্জাতিক মহলকে উদ্বেগের বদলে কার্যকর কোন পদক্ষেপ নিতে হবে’। নূর আবসার নামের একজন লিখেছেন, ‘মানুষ আর আশ্বাস শুনতে চায় না; ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় কঠোর পদক্ষে দেখতে চায়’। মোফাজ্জল নামের একজন লিখেছেন, ‘২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোট দিতে পারিনি, এবার ভোট দিতে চাই’। ইউটিউবার ডা. জাহিদ উর রহমান বলেছেন, বিএনপির বিরুদ্ধে সরকারের অগ্নিসন্ত্রাসের অভিযোগ আন্তর্জাতিক মহল আমলে নিচ্ছে না। কারণ জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল নিজেদের মতো করে বাংলাদেশের চলমান সহিংসতা দেখছে। ফলে তারা সরকারের মিথ্যা বক্তব্য বিশ্বাস করছে না। অথচ সরকার এক সময়ের ‘জঙ্গীবাদ’ খাওয়ানোর মতো বিদেশিদের বিএনপির বিরুদ্ধে ‘অগ্নিসন্ত্রাস’ শব্দটি খাওয়ানোর অপচেষ্টা করছে।