দালালদের কারসাজিতে সরকারি কেন্দ্রে কৃষকেরা ধান বেচতে পারেনা

68
ঢাকাঃ এবার সরকারিভাবে প্রতি মণ বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ২৮০ টাকা(প্রতি কেজি ৩২ টাকা)। কিন্তু প্রকৃত কৃষকেরা সরকারের কাছে ধান বিক্রি করতে পারছেনা বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারি পর্যায়ে ধান কেনার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়েই সিন্ডিকেট সদস্যরা কৃষকদের বঞ্চিত করেন।

দালাল প্রভাবশালীরা সিন্ডিকেট করে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করে মুনাফা লুটছে। আর এতে সহায়তা করছে এক শ্রেণির খাদ্য কর্মকর্তা।

তবে খাদ্য কর্মকর্তারা এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, কৃষকেরা সঠিক মানের ধান নিয়ে আসলে তাদের ধান কেনা হয়। কৃষক বাদে অন্য কারুর কাছ থেকে ধান কেনার কোনো আইন বা সুযোগ নেই।

গত ৮ মে খাদ্যমন্ত্রী সাধনচন্দ্র মজুমদার সরকারিভাবে ধান-চাল কেনার কর্মসূচি উদ্বোধন করে। এবার সরকার ১৭ লাখ টন ধান ও চাল কিনবে। এর মধ্যে ধান কেনা হবে পাঁচ লাখ টন। সেদ্ধ চাল ১১ লাখ টন এবং আতপ চাল এক লাখ টন। ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কেনা হবে।

প্রতি কেজি বোরো ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ধান ৩২ টাকা, সিদ্ধ চাল ৪৫ টাকা এবং আতপ চাল ৪৪ টাকা। একইসঙ্গে ৩৪ টাকা দরে ৫০ হাজার টন গম কেনারও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

কৃষদের জন্য বোরো ধানই মুখ্য। কারণ চাল বিক্রি করেন মালিকেরা। এবার গত বছরের চেয়ে ধানের দাম প্রতি কেজিতে দুই টাকা বেশি ধরা হয়েছে।

 

সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য:

 

টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কৃষক রিপন মিয়া বলেন,” আমাদের প্রতি মন ধান উৎপাদনে এবার খরচ হয়েছে ৭০০-৮০০ টাকা। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বেশি, সারের দাম বেশি ,পানি সেচের খরচ বেড়ে গেছে বিদ্যুতের দাম বাড়ার কারণে। আবার বিদ্যুৎ না থাকায় ঠিক মতো সেচ দিতে না পারায় ধান চিট হয়ে যায়।”

তার কথায়,” সরকারি কেন্দ্রে বিক্রি করতে পারলে লাভ থাকত। কিন্তু আমরা তো সেখানে যেতেই পারিনা। দালালরা ওই কেন্দ্র পর্যন্ত আমাদের যেতেই দেয়না। তাই বাধ্য হয়ে ৮৫০-৯০০ টাকা মণ বিক্রি করছি। কিন্তু এই দামে ধান কিনে তারা সরকারের কাছে বেচে এক হাজার ২৮০ টাকায়।”

তিনি অভিযোগ করেন,” নানা অজুহাতে আমাদের আটকে দেয়া হয়। এরমধ্যে আছে কৃষক কার্ড, ময়েশ্চার(আর্দ্রতা), ধানে চিটা। কেউ কেউ কেন্দ্রে নিতে পারলেও এইসব অজুহাতে ধান ফেরত দেয়া হয়। আমাদের পরিবহন খরচ গচ্চা যায়।”

‘খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের অবৈধ যোগাযোগ আছে’

কুঁড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার কৃষক মো, নাসির উদ্দিন এবার দুই একর জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। ফলনও ভালো পেয়েছেন। তিনি বলেন,” প্রথমে কৃষককে কৃষি কার্ড পেতে হয়, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হয়। এরপর ধান নিয়ে গেলে লটারি করা হয়। লটারিতে যাদের নাম আসে তাদের ধানের আর্দ্রতা পরীক্ষা করা হয়। যদি আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হয় তাহলে ধান নেয় না।”

তিনি তার অভিজ্ঞতার  কথা জানিয়ে বলেন,” গত বছর আমার যে ধান সঠিক আর্দ্রতা নাই বলে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে সেই ধান দালালের কাছে বিক্রি করার পর তাদের কাছ থেকে একই ধান কিন্তু ক্রয় কেন্দ্র নিয়েছে। দালাল ও প্রভাবশালীদের সঙ্গে খাদ্য গুদাম কর্মকর্তাদের একটা অবৈধ যোগাযোগ আছে। তারা মিলে একটা সিন্ডিকেট। এর সঙ্গে গুদামের শ্রমিকেরাও জড়িত। তাদের সরকার আবার কৃষি কার্ড আছে।”

 

প্রতি মণে দালালরা হাতিয়ে নিচ্ছে ৩৫০ টাকা:

 

সরকারি পর্যায়ে ধান কেনার যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ার সুযোগ নিয়েই সিন্ডিকেট সদস্যরা কৃষকদের বঞ্চিত করেন। তারা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান কিনে বেশি দামে বিক্রি করে। এবার প্রতি মনে এ তারা কমপক্ষে ৩০০-৩৫০ টাকা করে হাতিয়ে নিচ্ছে। এই লাভের ভাগ প্রশসন এবং জনপ্রতিনিধিরাও পান বলে অভিযোগ আছে।

নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে হলে কৃষকের -১. কৃষি কার্ড থাকতে হবে ২. ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে এবং ৩. ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হতে পারবেনা।

কিন্তু কৃষকের কাছে তো আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নাই, ফলে সে ধান কেন্দ্রে নিয়ে গিয়ে বিপাকে পড়ে। কারণ তাকে বাড়ি গিয়ে ধান আরো শুকিয়ে আনতে হলে পরিবহন খরচ লাগে। আর কৃষি কার্ড পেতেও আছে জটিলতা। কারণ জমির মালিকানা না থাকলে পাওয়া যায়না। বর্গা চাষীরা তাই কৃষি কার্ড পান না। আর ব্যাংক অ্যাকাউন্টও নেই কারুর কারুর। যদিও ১০ টাকায় অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ আছে।

 

‘কৃষক ছাড়া কারো ধান বিক্রির সুযোগ নেই’

 

এবার হাওড় এলাকায় আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠাইমন উপজেলার কৃষক আরমান হোসেন এবার পাঁচ একর জমিতে বোরো চাষ করেছেন। তার ভাই করেছেন ৩৫ একর জমিতে।

তিনি বলেন,” ভালো ফলন হলেও আমরা সরকারি কেন্দ্রে বিক্রি করতে পারছিনা। বাইরে কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এখানো দালাল আর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের দাপট। তাদের কাছেই আমাদের বিক্রি করতে হচ্ছে। আমরা ৯০০-৯৫০ টাকা মন তাদের কাছে বিক্রি করছি।”

তার কথা,” এবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কেনার কথা থাকলেও কারুর দেখা নাই। বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে দালাল আর ফড়িয়ারা। আমরা তাদের ধান দিয়ে দিচ্ছি।”

কথা বলে জানা গেছে, যাদের সামর্থ আছে তারা সরকারিকেন্দ্রে বিক্রি করতে না পেরে ধান ধরে রাখছেন। বাজার বেশি হলে তখন বিক্রি করবেন।

মিঠাইমন উপজলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহা. এনামুল হক অবশ্য দালাল ও আওয়ামী লীগ নেতাদের দৌরাত্ম্য অস্বীকার করে বলেন,” কৃষক ছাড়া অন্য কারো এখানে ধান বিক্রির সুযোগ নেই। আমরা কৃষক কার্ড দিয়েছি। সেই কার্ড দেখে ধান কিনি। আর ধানের আর্দ্রতা ১৪ শতাংশের বেশি হতে পারবেনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। আমরা সর্বোচ্চ একজনের কাছ থেকে তিন টন ধান কিনি। আমরা গত বছর সাত হাজার কৃষক কার্ড দিয়েছি। এবার আবার আপডেট করছি।”

তার কথায়,” আমরা ধানের দাম কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দিই। ফলে কোনো দালাল বা ফড়িয়ার এখানো কিছু করার সুযোগ নেই।”

কৃষকেরা জিম্মি:

 

কৃষকদের নিয়ে কাজ করা বিশ্লেষকেরা বলছেন, যারা দালাল বা প্রভাবশালী তাদের সবার কৃষক কার্ড আছে। কারণ তারাও কৃষি জমির মালিক। শুধু তাই নয় তারা কৃষকদের কাছ থেকেও কৃষক কার্ড  নিয়ে নেয়। তারা আসলে অর্থের বিনিময়ে সব পক্ষকে ম্যানেজ করে। আবার সামান্য কিছু অর্থ দিয়ে কৃষক কার্ড দখলে রাখে। এশিয়ান ফার্মার্স অ্যাসোসিয়েশনের অপারেশনাল ম্যানেজার আমীরুল ইসলাম বলেন,” আসলে সবখানেই রাজনৈতিক প্রভাব। স্থানীয় যারা আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী আছেন তাদের সঙ্গে দালালরা মিলে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। তারা কৃষকদের কেন্দ্রে যেতে দেয়না। আগেই তাদের ধান নিয়ে নেয় কম দামে। আর কেউ যদি যেতেও পারে আদ্রতাসহ নানা অজুহাতে তার ধান কেনা হয়না। সরকারি খাদ্য গুদামের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দালালদের অসাধু সম্পর্ক আছে।”

তার কথায়, “বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান কেনা বা আর্দ্রতা পরীক্ষা করার কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়না। দেশে মোট কৃষকের  ছয় শতাংশ বড় কৃষক। তারা হয়তোবা কেন্দ্রে গিয়ে ধান বিক্রি করতে পারে। কিন্তু ছোট , ক্ষুদ্র বা বর্গা চাষির পক্ষে সম্ভব হয়না। সরকার ধানের যে বাড়তি দাম দিচ্ছে তা তারা পায়না। পায় দালাল ও প্রভাবশালীরা।  আর ছোট কৃষকরা ধান  ধরেও রাখতে পারেনা। কারণ তাদের অর্থ প্রয়োজন। কৃষকেরা যদি সংগঠিত হতে পারত তাহলে এই অবস্থার অবসান ঘটত।”

 

খাদ্য অধিদপ্তর যা বলছে:

 

খাদ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন,” আসলে দালাল এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা সিন্ডিকেট করে। ফলে  অনেক প্রকৃত কৃষক কেন্দ্র পর্যন্ত যেতে পারেন না। কিন্তু এটা তো আমরা দেখতে পারিনা। এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ। যারা দালাল তাদেরও কৃষি কার্ড আছে। আর দাললরা তো সংঘবদ্ধ।”

খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন এবার আর্দ্রতা মাপার যন্ত্র নিয়ে কৃষকের বাড়ি বাড়ি যাওয়া হবে।  যদি দেখা যায় তা ১৪ ভাগের বেশি হয় তাহলে তাদের ধান শুকিয়ে সঠিক পর্যায়ে এনে তারপর কেনা হবে। যাতে তারা আর্দ্রতার ফাঁদে না পড়েন। এর জবাবে খাদ্য অধিদপ্তরের ধান-চাল সংগ্রহ বিভাগের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন,” এটা আমাদের কাজ নয়।  আমাদের অত জনবল নাই। এটা কৃষি বিভাগের ব্লক সুপারভাইজারদের করার কথা। তারা করছে কিনা আমার জানা নাই।”

‘কৃষকের থেকে ধান কেনায় কোনোরকম বাধার অভিযোগ আসেনি’

কৃষকেরা দালাল ও ফড়েদের দাপটে  সরকারি কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পারছেনা এই অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন,” কেন্দ্রগুলো কৃষকদের ধান কেনার জন্যই। তাদের কাছ থেকেই আমরা ধান কিনছি। তাদের কাছ থেকে ধান কেনায় কোনো বাধা নাই। তারা কোথাও বাধা পেয়ে বা চাপের কারণে কেন্দ্রে গিয়ে ধান বিক্রি করতে পারেননি এরকম কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে নাই।”

তিনি জানান, উপজেলা পর্যায়েই ধান কেনা হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ে অল্প কিছু ক্রয় কেন্দ্র আছে।

বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্থানীয় জাতের ধান

পূর্বের খবরডিবি কার্যালয়ে হেফাজত নেতা মামুনুল হক
পরবর্তি খবরদেশের ডলার সংকটের মধ্যেই ৩০ ব্যাংকের এমডি একযোগে আমেরিকা যাচ্ছেন কেন