সারাদেশে সব ওসি ও ইউএনওদের ঢালাও বদলির কারণ কী এবং কী লাভ হবে? দেশের সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) এবং সব থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে(ওসি) বদলি করেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। তাদের কথায়,” যদি নির্বাচনকালীন সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন চায় তাহলেই কেবল সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।” আর “একপাক্ষিক নির্বাচনে” এই বদলি লোক দেখানো বলেও তারা মনে করেন। তাদের কথায়, রাঘব বোয়াল হলেন জেলা প্রশাসক(ডিসি) এবং জেলা পুলিশ সুপররা(এসপি)। তারাই মাঠের পুলিশ ও প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করেন। তারা তো থাকছেন। তাই শেষ সময়ে ইউএনও আর ওসিদের বদলি করা সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।
শুরুতে যেসব ইউএনওদের বর্তমান কর্মস্থলে চাকুরীর মেয়াদ এক বছর হয়ে গেছে তাদের এবং যেসব ওসির বর্তমানে কর্মস্থলে চাকুরী ছয় মাসের বেশি হয়েছে তাদের বদলির প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে অনুমোদন করে আগামী মঙ্গলবারের মধ্যে কমিশনকে জানাতে বলা হয়েছে।
দেশে মোট উপজেলা ৪৯৫টি। থানা আছে ৬৫২টি। নির্বাচন কমিশন ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব উপজেলার ইউএনও এবং সব থানার ওসিকে বদলির সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে ইউএনওরা রিটার্নি অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। আর ওসিরা আইন-শৃঙ্খলার মূল দায়িত্বে থাকেন।
কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে নির্বাচন কমিশনাররা যে তথ্য পেয়েছেন তার ভিত্তিতেই ইউএনও ও ওসিদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।
এর ফলে নতুন এলাকায় গিয়ে কর্মকর্তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবেন বলে আশা করছে কমিশন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, কমিশনের নির্দেশনা মতো তারা কাজ শুরু করেছেন এবং কমিশনের নির্দেশ বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
যদিও নির্বাচন বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষকরা বলছেন কমিশন নিজের ক্ষমতা বোঝানোর জন্য এমন আদেশ দিয়েছে। বিদ্যমান বাস্তবতায় এসব বদলির খুব একটা গুরুত্ব নেই বলেই মনে করেন তারা।
বেসরকারি পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিপপের চেয়ারম্যান ও বিশ্লেষক প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বিবিসিকে বলছেন, ঢালাও বদলির এ সিদ্ধান্ত লোক দেখানো, কারণ তার মতে ‘এসব ডিসি, ইউএনও ও ওসিদের নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকার পোস্টিং ও পদায়ন করেছিলো’।
“এখন তাদের এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় দেয়ার আলাদা কোন গুরুত্ব নেই। কারণ তারা সরকারি দলের অনুগত হিসেবেই পোস্টিং ও পদায়ন পেয়েছেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
প্রসঙ্গত, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে গত পনেরই নভেম্বর। আর নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে আঠারই ডিসেম্বর থেকে। সাতই জানুয়ারি এ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। নির্বাচনটি বিএনপিসহ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত দলগুলো বর্জন করছে।
কমিশনের আদেশে কী আছে
নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে ত্রিশে নভেম্বর দুটি চিঠি পাঠানো হয় সরকারের জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, “..আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের নিমিত্ত সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে পর্যায়ক্রমে বদলি করার জন্য মাননীয় নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। এলক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে যে সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের বর্তমান কর্মস্থল এক বছরের অধিক চাকুরীকাল সম্পন্ন হয়েছে তাদেরকে অন্য জেলায় বদলির প্রস্তাব আগামী ০৫/১২/২০২৩ তারিখের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে প্রেরণ করতে হবে”।
পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, “.. আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের নিমিত্ত সকল থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পর্যায়ক্রমে বদলি করার জন্য মাননীয় নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। এলক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে যে সকল ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বর্তমান কর্মস্থল ছয় মাসের অধিক চাকুরীকাল সম্পন্ন হয়েছে তাদেরকে অন্য জেলায়/ অন্যত্র বদলির প্রস্তাব আগামী ০৫/১২/২০২৩ তারিখের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে প্রেরণ করা প্রয়োজন”।
এত বদলির কারণ কী এবং কী লাভ হবে
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় বদলি করা হলেও এতে আদৌ কোন লাভ হবে কি-না তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে।
কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ অবশ্য বলছেন, “অবশ্যই লাভ আছে। একজন হয়তো এক জায়গায় বেশ কিছুদিন আছেন। তার যদি সেখানে কোন নেক্সাস থাকে সেটি নতুন এলাকায় কাজ করবে না। তাদের ঘিরেও কেউ নিজ স্বার্থ রক্ষার চিন্তা করতে পারবে না”।
তিনি জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনাররা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে এসেছেন এবং তাদের কাছে যেসব তথ্য এসেছে তার ভিত্তিতে সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে ২৯শে নভেম্বর কমিশন এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তবে ‘সামগ্রিক বিষয়’ আর ‘তথ্য’ বলতে ওই সব কর্মকর্তাদের বিষয়ে নেতিবাচক কোন তথ্য বোঝানো হচ্ছে কি না জানতে চাইলে মি. দেবনাথ শুধু বলেন, “কমিশন সবকিছুই বিবেচনা করেছে”।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ডিসিদের বিষয়েও ‘কোন অভিযোগ এলে’ বা কমিশন প্রয়োজন মনে করলে একই ধরনের সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
অভিযোগ থাকলে এক জায়গার কর্মকর্তাকে আরেক জায়গায় নিয়ে কী লাভ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন অভিযোগ যাচাই বাছাই করেই কমিশন প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।
যদিও কমিশনের একটি সূত্র বলছে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের শুরুতেই বদলির একটি নীতিগত চিন্তা কমিশনের আগে থেকেই ছিলো।
মূলত ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনের সময় মাঠ পর্যায়ে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিলো। সেই সময় তাদের ওপর কমিশনের কতটা কর্তৃত্ব ছিলো তা নিয়েও সমালোচনা হয়েছিলো।
এবারের নির্বাচনকে সামনে রেখে গত বছরের শেষ দিকে যে কর্মপরিকল্পনা বর্তমান কমিশন প্রকাশ করেছিলো, তাতেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছিলো তাতে শুরুর দিকেই মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালনের প্রসঙ্গটি এসেছিলো।
যদিও গত রোববারই প্রধান নির্বাচন কমিশনার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে প্রশাসনের রদবদলের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এছাড়া মাঠ প্রশাসনে বড় রদবদল করতে গেলে বিশৃঙ্খলা হবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন একজন কমিশনার।
‘একটি কসমেটিক চেঞ্জ’
বাংলাদেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে সবচেয়ে আলোচিত বদলির ঘটনাটি ঘটেছিলো ২০০১ সালে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতি লতিফুর রহমান শপথ নেবার পরপরই কয়েকজন সচিব ও ডিসিকে বদলি করে শোরগোল তৈরি করেছিলেন।
এর আগে ও পরে ঢালাওভাবে মাঠ প্রশাসনে এবারের মতো বদলির উদাহরণ নেই বললেই চলে। কিন্তু তারপরেও এ বদলিকে খুব একটা গুরুত্ব দিতে রাজী নন নির্বাচন বিশ্লেষক আব্দুল আলীম।
তার মতে ডিসিদের নিয়োগ রাজনৈতিক বিবেচনা ও নির্দেশনায় হয় বলেই হয়তো লতিফুর রহমান দায়িত্ব নিয়েই সেখানে হাত দিয়েছিলেন।
“কিন্তু এবারের মতো ঢালাও বদলি আর হয়েছে বলে জানিনা। যদিও নির্বাচনে মূল ভূমিকা ডিসিদের। তারাই মূল দায়িত্ব পালন করেন। সে হিসেবে ওসি-ইউএনও’র বদলির খুব একটা গুরুত্ব নেই। কারণ একই লোক এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছেন মাত্র,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি.আলীম।
যদিও জানিপপের চেয়ারম্যান ও বিশ্লেষক প্রফেসর নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর মতে পুরো বিষয়টিই নির্বাচন কমিশনের লোক দেখানো সিদ্ধান্ত।
“এটি একটি কসমেটিক চেঞ্জ। কমিশন প্রমাণ করতে চেয়েছে যে তারা নখদন্তহীন নয়। কিন্তু এটি একেবারেই লোক দেখানো কারা ডিসি, ইউএনও ও ওসি পদে যারা পদায়িত হয়ে আছেন তারা রাজনৈতিক বিবেচনাতেই পোস্টিং ও পদায়ন পেয়েছেন। নির্বাচনকে সামনে রেখেই সরকার তাদের নিয়োগ দিয়েছিলো।ফলে এ বদলি অর্থহীন ও গুরুত্বহীন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তার মতে আওয়ামী লীগ গত দেড় দশক ক্ষমতায় থাকায় প্রশাসনে দল নিরপেক্ষ কর্মকর্তা নেই এবং সে কারণে তিনি মনে করেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট যারাই আছেন তারা সরকারেরই অনুগত।
“এসব কর্মকর্তাদের বদলি করলেন কি- করলেন না, নির্বাচনে তার কোন প্রভাব ফেলবে না। কারণ তারা সব জায়গাই একই কাজই করবেন,” বলছিলেন মি. কলিমউল্লাহ।
তবে অশোক কুমার দেবনাথ শনিবার নির্বাচন কমিশনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার লক্ষ্যেই ইউএনও ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের পর্যায়ক্রমে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন।