ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ পুরোপুরি বন্ধ, কবে শুরু জানে না কর্তৃপক্ষ

49

ঢাকাঃ এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ বেশিরভাগ জায়গায় বন্ধ ছিল। কিছু কর্মী নিয়ে শুধু হাতিরঝিল এলাকায় কাজ চলছিল। তবে অর্থসংকটে দুই মাস ধরে সেখানকার কাজও বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থাৎ প্রকল্পের কাজ এখন পুরোপুরি বন্ধ দ্রুতগতির এ উড়ালসড়কের।

এ দিকে কবে নাগাদ কাজ আবার শুরু হবে, তা বলতে পারছে না বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে পারেনি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ‘ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড’। উপরন্তু শেয়ার হস্তান্তর নিয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে নিজেদের মধ্যে সমস্যা জিইয়ে রেখেছে এফডিইইর অধীন অংশীদার ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলো।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে চলে যাওয়ার পর গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে রাজধানীর যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখতে ব্যয়বহুল প্রকল্পটিকে দ্রুত শেষ করার ওপর জোর দিচ্ছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

প্রকল্প পরিচালকের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, ভূমি সমস্যার সমাধান করার পরও মগবাজার-মালিবাগ, খিলগাঁও ও হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ ও কমলাপুর এলাকায় নির্মাণকাজের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের বিলম্ব অগ্রহণযোগ্য। দ্রুত কোনো অগ্রগতি না হলে চুক্তির শর্ত অনুসারে বিবিএ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।

গত ২ এপ্রিল কাওলা, মগবাজার, কমলাপুরের টিটিপাড়া, কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে ওয়ার্ক স্টেশন বা স্টক ইয়ার্ড ঘুরে দেখেন প্রথম আলোর এই প্রতিবেদক। সে সময় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কাওলা স্টক ইয়ার্ড ফেব্রুয়ারি এবং বাকি স্থানগুলোতে মার্চ মাস থেকে কাজ বন্ধ রয়েছে।

এর পর গত ২ জুলাই সরেজমিনে মগবাজার-মালিবাগ ও হাতিরঝিল ওয়ার্ক স্টেশন ঘুরে শুধু হাতিরঝিলে সীমিত জনবল নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। সবশেষ ১৮ সেপ্টেম্বর হাতিরঝিলে গিয়ে দেখা যায় সেখানেও কাজ বন্ধ রয়েছে।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) বড় এ প্রকল্পে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ডের একটি ও চীনভিত্তিক দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ এবং নির্মাণকাজের মাধ্যমে অংশীদার। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো ইতালিয়ান থাই (ইতালথাই) ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি, চীনের শেনডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনো হাইড্রো করপোরেশন।

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য এফডিইই লিমিটেড নামের কোম্পানি গঠন করে ইতালথাই। এতে অংশীদার তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার যথাক্রমে ৫১, ৩৪ ও ১৫ শতাংশ। বিবিএ হচ্ছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহক প্রতিষ্ঠান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার স্থানান্তরে আদালতের যে স্থিতাবস্থা জারি ছিল, তা গত ১ সেপ্টেম্বর খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার স্থানান্তরে আর কোনো বাধা নেই। তাই শেয়ার হস্তান্তর নিয়ে দ্বন্দ্বের বিষয়টিকে অজুহাত করে কাজ বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত একাধিক ব্যক্তির মতে, এর আগে বিবিএর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে আদালতের কার্যক্রম চলমান থাকাকে অজুহাত বানিয়ে কাজ শুরু করার বিষয়ে এফডিইইকে চাপ দেওয়া থেকে বিরত থেকেছেন। এমনকি, আদালতে কোনো পক্ষ হিসেবেও লড়েনি বিবিএ।

হাতিরঝিলে গার্ডার তৈরির প্রস্তুতি চলছে। এ কারণে এখন কাজ বন্ধ রয়েছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে ইতালথাইয়ের সালিস নোটিশের ওপর শুনানি হবে। সে সময় পর্যন্ত বিবিএ অপেক্ষা করছে।

এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার, প্রকল্প পরিচালক

বিবিএর চিঠিতে তাগাদা

 

১ সেপ্টেম্বর আদালতের রায়ের পর নির্ধারিত সময় আগামী বছরের (২০২৫ সাল) জুনের মধ্যে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগাদা দিয়ে এফডিইইকে ১২ সেপ্টেম্বর চিঠি পাঠিয়েছে বিবিএ।

প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতারের সই করা চিঠিতে বলা হয়েছে, গত আট মাস ধরে ন্যূনতম জনবল নিয়ে সাইট পর্যায়ে কাজ চলতে দেখা গেছে। শেয়ারধারী ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমস্যা থাকায় গত তিন মাস ধরে কোনো কার্যক্রমই এক রকম নেই। ভূমি সমস্যার সমাধান করার পরও মগবাজার–মালিবাগ, খিলগাঁও ও হাতিরঝিল, পান্থকুঞ্জ ও কমলাপুর এলাকায় নির্মাণকাজের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের বিলম্ব অগ্রহণযোগ্য। দ্রুত কোনো অগ্রগতি না হলে চুক্তির শর্ত অনুসারে বিবিএ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।

চিঠিতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে এফডিইইকে দ্রুত ও যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলা হয় এবং সময় আর বাড়ানো হবে না বলে জানানো হয়। সবশেষে চিঠিটিকে ‘অত্যন্ত জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ’ হিসেবে বিবেচনা করতেও বলা হয়েছে।

 

কাওলা ইয়ার্ডে গত ২ এপ্রিল গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না
কাওলা ইয়ার্ডে গত ২ এপ্রিল গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে নাছবি: নাজনীন আখতার

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পের জন্য এফডিইইর চুক্তি হয়েছিল চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না এক্সিম ব্যাংক এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার (আইসিবিসি) সঙ্গে। তবে সময়মতো সুদ পরিশোধ করতে পারেনি ইতালথাই। ঋণের শর্ত অনুসারে সুদ পরিশোধ করতে ব্যর্থ হওয়া প্রতিষ্ঠান তার শেয়ারের অংশ অন্য প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করতে পারবে। ওই সময় চীনা দুটি প্রতিষ্ঠান শেয়ার নিতে চাইলে ইতালথাই রাজি হয়নি। এ অবস্থায় গত ১৭ জানুয়ারি ব্যাংক দুটি ঋণের অর্থ ছাড় বন্ধ করে দেয়। তখন সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে সালিস নোটিশ পাঠায় ইতালথাই। একই সময়ে হাইকোর্টে শেয়ার হস্তান্তরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির আবেদন করে। ১২ মে ইতালথাইয়ের শেয়ার স্থানান্তরের ওপর স্থিতাবস্থা তুলে দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে আপিল হলে আপিল বিভাগ আবার শেয়ার হস্তান্তরের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। সবশেষ ১ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ স্থগিতাদেশ খারিজ করে দেন।

গত ৩ এপ্রিল প্রথম আলোর ই–মেইলের জবাবে এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ভাসকন খান্নাভা জানিয়েছিলেন, স্বল্প সময়ের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করে তাঁরা ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ করবেন।

পরে ১ জুলাই আরেকটি ই–মেইলের জবাবে এফডিইই শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব ও অর্থসংকটে বেশিরভাগ জায়গায় কাজ বন্ধ থাকার কথা স্বীকার করে এবং জানায় যে অর্থ জোগাড় করে আগস্টে নির্মাণকাজ আবার শুরু করতে পারবে। ওই ই–মেইলে আরও বলা হয়, ইতালথাইয়ের সঙ্গে চীনা ঋণদাতা ও অংশীদারদের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই তারা এফডিইইর শেয়ার স্থানান্তর চায়।

এরপর ১৭ সেপ্টেম্বর আরেকটি ই–মেইল করা হলে কোনো জবাব দেননি এমডি। প্রথম আলোর ই–মেইলে চারটি প্রশ্ন করা হয়েছিল। এগুলো হলো—নির্মাণকাজ কখন শুরু হবে, কাজ শুরুর জন্য প্রতিষ্ঠান ঋণ পেয়েছে কি না, সুপ্রিম কোর্ট শেয়ার স্থানান্তরের ওপর স্থগিতাদেশ তুলে নেওয়ায় অন্য দুই অংশীদারির কাছে শেয়ার স্থানান্তর করা হবে কি না এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে দেনা পরিশোধে এফডিইই কী করছে।

এফডিইইর দেনার হিসাব থেকে দেখা গেছে, রড, তার, সিমেন্টসহ নানা মালামাল কেনা, কর্মীদের বেতন–ভাতা পরিশোধ, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিল (এফডিইইর তিন অংশীদার প্রকল্পে ঠিকাদার হিসেবেও কাজ করে) ইত্যাদি বাবদ ১ হাজার কোটি টাকার বেশি দেনা রয়েছে।

প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য

 

প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাতিরঝিলে গার্ডার তৈরির প্রস্ততি চলছে। এ কারণে এখন কাজ বন্ধ রয়েছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে সিঙ্গাপুর ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারে ইতালথাইয়ের সালিস নোটিশের ওপর শুনানি হবে। সে সময় পর্যন্ত বিবিএ অপেক্ষা করছে।’

তবে কি অক্টোবরে কাজ শুরু হবে, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘সেটা এখন বলা যাচ্ছে না। আদালত শেয়ারের ওপর স্থিতাবস্থা রাখার আবেদন খারিজ করে দেওয়ার পর এফডিইইকে কাজ শুরুর বিষয়ে চিঠি দিয়েছে বিবিএ। বিবিএ আর সময় বাড়াবে না।’ এফডিইইর ঋণ না পাওয়া ও দেনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা তাদের বিষয়। ওটা বিবিএর দেখার বিষয় না।’

 

 

হাতিরঝিল এলাকায় সীমিত জনবল দিয়ে কাজ চলছিল। সে কাজও এখন বন্ধ
হাতিরঝিল এলাকায় সীমিত জনবল দিয়ে কাজ চলছিল। সে কাজও এখন বন্ধছবি: নাজনীন আখতার

প্রকল্পের চুক্তি অনুসারে, এক্সপ্রেসওয়ের মূল কাঠামো নির্মাণব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ (ভিজিএফ) নামে পরিচিত। অর্থসংকটে কাজ আটকে থাকায় সরকার এখন ভিজিএফ দেবে কি না, জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘কাজ আরেকটু এগোলে ভিজিএফ দেওয়ার বিষয়টি ভাবা হবে।’

ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। ২০০৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি। গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত এবং পরে ২০ মার্চ কারওয়ান বাজার (এফডিসি) এক্সপ্রেসওয়ের অংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
কাওলা থেকে শুরু হয়ে কুড়িল, বনানী, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর, সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকায় গিয়ে শেষ হবে এ প্রকল্প।

 

 এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বেশির ভাগ জায়গায় কাজ বন্ধ

 

বিমানবন্দরের কাছের কাওলা ইয়ার্ডে গত মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে নাছবি: নাজনীন আখতার

ঋণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ জায়গায় ঢাকা দ্রুতগতির উড়ালসড়কের (ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে গেছে।

গত মঙ্গলবার নির্মাণকাজের পাঁচটি জায়গা (ওয়ার্ক স্টেশন-স্টকইয়ার্ড) ঘুরে দেখা গেছে, হাতিরঝিল ছাড়া আর কোথাও কাজ চলছে না। হাতিরঝিলেও সীমিতসংখ্যক জনবল নিয়ে কাজ চলছে। বাকি চারটি জায়গায় (কাওলা, মগবাজার, মালিবাগ ও কমলাপুর) অল্পসংখ্যক নিরাপত্তাকর্মী, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রিসহ কিছু কর্মী রাখা হয়েছে।

কর্মীদের ভাষ্য, কোথাও এক মাস ধরে কাজ বন্ধ, কোথাও দুই মাস।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই মাসে অন্তত ৮০ শতাংশ কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠিয়েছে এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান।

অর্থসংকটে বেশির ভাগ জায়গায় কাজ বন্ধ থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছে নির্মাণ ও পরিচালনা প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে (এফডিইই) কোম্পানি লিমিটেড। প্রথম আলোর এক ই–মেইলের জবাবে ৩ এপ্রিল এফডিইইর পক্ষ থেকে বলা হয়, কাজ চালু রাখার জন্য ঋণ পেতে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কোম্পানির কাজ চলছে।

অবশ্য প্রকল্পের পরিচালক এ এইচ এম সাখাওয়াত আখতার হাতিরঝিলের প্রসঙ্গ টেনে প্রথম আলোকে বলেন, কাজ বন্ধ নেই। কাজ চলছে। তবে ঋণ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রকল্পের কাজ শেষ করতে এক বছর বেশি সময় লাগতে পারে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে কাওলা থেকে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর হয়ে যাত্রাবাড়ীর কাছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে শেষ হবে এই উড়ালসড়ক। পুরো উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারির (পিপিপি) বড় এই প্রকল্পে বাংলাদেশ ছাড়াও থাইল্যান্ডের একটি ও চীনের দুটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ এবং নির্মাণকাজের মাধ্যমে অংশীদার। প্রতিষ্ঠান তিনটি হলো থাইল্যান্ডভিত্তিক ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানি লিমিটেড, চীনের শ্যানডং ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেশন গ্রুপ ও সিনোহাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড।

এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ও পরিচালনার জন্য এফডিইই কোম্পানি লিমিটেড নামের কোম্পানি গঠন করে ইতালিয়ান-থাই ডেভেলপমেন্ট। কোম্পানির অংশীদার তিন প্রতিষ্ঠানের শেয়ার যথাক্রমে ৫১, ৩৪ ও ১৫ শতাংশ। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ হলো এক্সপ্রেসওয়ের নির্বাহক প্রতিষ্ঠান।

প্রকল্পের মূল নির্মাণকাজে ব্যয় ধরা হয় ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। চুক্তি অনুসারে, মূল কাঠামো নির্মাণব্যয়ের ৭৩ শতাংশ জোগান দেবে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান। আর ২৭ শতাংশ দেবে বাংলাদেশ সরকার, যা ভায়াবিলিটি গ্যাপ ফান্ডিং (ভিজিএফ) নামে পরিচিত।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণ বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব থেকেও প্রকল্পের নির্মাণকাজ ব্যাহত হচ্ছে।

এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাই নাগরিক ভাস্কন খান্নাভা গত ১৭ ফেব্রুয়ারি তাঁর কার্যালয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, চলতি বছরের ৩০ মার্চের মধ্যে নির্মাণকাজ শেষ হবে না জেনে গত ১৭ জানুয়ারি ঋণ আটকে দিয়েছে চীনের দুটি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান চায়না এক্সিম ব্যাংক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না (আইসিবিসি)।

 

মগবাজার ইয়ার্ডে মাসখানেক ধরে কাজ বন্ধ আছে বলে জানান কর্মীরা
মগবাজার ইয়ার্ডে মাসখানেক ধরে কাজ বন্ধ আছে বলে জানান কর্মীরা

চীনের ব্যাংক দুটি সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ চুক্তি করেছিল বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ঋণকে কেন্দ্র করে তিনটি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে শেয়ার নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকার বিষয়টিও তখন স্বীকার করেছিলেন খান্নাভা।

২০০৯ সালে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১১ সালে নির্মাণের চুক্তি হয়। নির্মাণকাল ধরা ছিল সাড়ে তিন বছর। তবে সময়মতো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়নি। আনুষ্ঠানিক নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালের ১ জানুয়ারি।

গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর কাওলা থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার দূরত্ব অংশ উদ্বোধন করা হয়। পরদিন ৩ সেপ্টেম্বর এই অংশে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। গত ২০ মার্চ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) গেট-সংলগ্ন র‍্যাম্প যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রকল্পে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কোটি টাকা।

 

কোথাও দুই মাস, কোথাও এক মাস কাজ বন্ধ

 

গত মঙ্গলবার বিমানবন্দরের কাছের কাওলা ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পরিমল নামের এক নিরাপত্তাকর্মী বসে আছেন। সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না। আগে এখানে এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের (স্তম্ভ) ওপর বসানোর জন্য গার্ডার বানানো হতো।

কাওলায় রেললাইনের এক প্রান্তে গিয়ে দেখা গেল, ইয়ার্ডে সারি সারি করে ক্রেন রাখা। আশপাশের লোকজন জানালেন, ইয়ার্ডে কাজ এখন বন্ধ। নিরাপত্তাকর্মী পরিমলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুই মাস ধরে কাজ বন্ধ আছে।

মগবাজার ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ৮-১০ কর্মী আছেন। ওসমান, পাখি, শামীম নামের তিনজন কর্মী জানান, তাঁরা এক শর ওপর কর্মী ছিলেন। বাকিরা ছুটিতে আছেন। মাসখানেক ধরে কাজ বন্ধ রয়েছে।

এলাকাটির ইসলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের মালিক চান মিয়া ও মুদিদোকানি মো. আবুল কাশেম বললেন, এক মাসের বেশি সময় ধরে এখানে কোনো কাজ দেখছেন না তাঁরা।

মালিবাগ থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভার পর্যন্ত দেখা যায়, টিনের বেড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে কোনো কাজ চলছে না। কোনো নিরাপত্তাকর্মীকেও সেখানে দেখা যায়নি।

কমলাপুরের টিটিপাড়া ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, অল্প কিছু কর্মী ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বড় ফাঁকা জায়গায় মালামালের স্তূপ। ঢালাই তৈরির জন্য বড় প্ল্যান্ট বসানো। সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না।

এই ইয়ার্ডে আগে গার্ডার তৈরি করা হতো। কথা বলতে চাইলে ইয়ার্ডের বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি সেলিম রেজা এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, এক মাস ধরে কাজ বন্ধ আছে। কর্মীরা ছুটিতে আছেন। এখন গার্ডার তৈরি হচ্ছে না।

এক প্রশ্নের জবাবে সেলিম বলেন, এখানে দুই শতাধিক কর্মী ছিলেন। এখন ১০ জনের মতো আছেন।

কমলাপুরের টিটিপাড়া ইয়ার্ড-সংলগ্ন লাল-সবুজ বাস পরিবহন কোম্পানির লাইনম্যান মো. মোবারক বলেন, এক মাস ধরে এখানে কোনো কাজ হতে দেখেননি তিনি।

কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছের ওয়ার্কস্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, কোনো কাজ চলছে না। লোকজন ফটক দিয়ে ঢুকে রেলওয়ে কলোনি ও স্টেশনের দিকে যাতায়াত করছেন।

হাতিরঝিল এলাকায় সীমিত জনবল দিয়ে কাজ চলছে
হাতিরঝিল এলাকায় সীমিত জনবল দিয়ে কাজ চলছে

পরে শাহরিয়ার নামে একজন বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি বেরিয়ে এসে বলেন, নিরাপত্তাকর্মী আশপাশেই আছেন। এক মাস ধরে এখানে কাজ বন্ধ।

তবে হাতিরঝিল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কর্মীরা কাজ করছেন। এক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তেজগাঁও ওয়ার্ক স্টেশন বন্ধ করে সেখানের কর্মীদের দিয়ে হাতিরঝিলে কাজ করা হচ্ছে।

মেহেদি হাসান নামের ওই কর্মী বলেন, তিনি আগে তেজগাঁও ওয়ার্ক স্টেশনে কাজ করতেন। তাঁরা ৭০ জনের মতো ছিলেন। সেখান থেকে ৪০ জনকে হাতিরঝিলের কাজে লাগিয়ে বাকিদের ছুটি দেওয়া হয়েছে। সকাল ছয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত হাতিরঝিলে কাজ চলে। তিনি রডের খাঁচা বানানোর কাজ করেন।

ছুটি দেওয়া প্রসঙ্গে বেশ কয়েকজন কর্মী বলেন, বলা হয়েছে, কোম্পানির অবস্থা ভালো না। পরে কাজ শুরু হলে আবার ডাকা হবে।

ছুটি পাওয়া কর্মীদের একজন মো. ইব্রাহিম (৩০) প্রথম আলোকে বলেন, তিনি ১০ মাস কাজ করেছিলেন। গত ২১ মার্চ তাঁকে ছুটি দেওয়া হয়। শুরুতে তেজগাঁও ওয়ার্ক স্টেশনে রড বাঁধাই করার কাজ করতেন তিনি। তখন মাসে ১৮ হাজার টাকার বেশি বেতন পেতেন। ওভারটাইমসহ মাসে আসত ২৬-২৭ হাজার টাকা। পাঁচ মাস পর তাঁকে একই বেতনে মগবাজারে সিগন্যালম্যান করা হয়। পরে কম বেতনে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ পান তিনি।

কাজ বন্ধ নিয়ে যা বলছে কর্তৃপক্ষ

 

 এক ই–মেইলের জবাবে এফডিইইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক খান্নাভা বলেন, ‘কাজের গতি কমে গেছে, আপনি ঠিকই লক্ষ করেছেন। প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্বল্পমেয়াদে অন্তর্বর্তী ঋণ এবং প্রকল্পের জন্য ঋণ পেতে আমরা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছি। অর্থসংক্রান্ত কাজ এখন ধীরে চলছে। কারণ, মধ্যপ্রাচ্য ও বাংলাদেশে এখন রমজান। আর শরৎ উৎসব ও ইস্টার সানডের কারণে হংকংয়ের বাজার এই সপ্তাহ পর্যন্ত বন্ধ। আগামী সপ্তাহে এই কাজে গতি আসবে।’

ফেব্রুয়ারিতে খান্নাভার কার্যালয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি ই–মেইলে লিখেছেন, ‘স্বল্প মেয়াদের ঋণ দিয়ে নির্মাণকাজ চালিয়ে রাখতে পারব আমরা। ধীরগতি থাকলেও প্রকল্প ঋণের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাওয়া যাবে, যা আপনাকে আগেও বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এ বছরের জুন মাসের মধ্যে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করার আশা করা যায়।’

কমলাপুরের টিটিপাড়া ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না
কমলাপুরের টিটিপাড়া ইয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কোনো কাজ হচ্ছে না
পূর্বের খবরগণ-অভ্যুত্থানে গঠিত সরকার অবশ্যই জনগণের সরকার: তারেক রহমান
পরবর্তি খবরArmy chief meets chief adviser Dr Yunus