শ্রম আইন লঙ্ঘনে ড. ইউনূসের ৬ মাসের কারাদণ্ড, শর্তসাপেক্ষে জামিন

90

দেশে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে করা একটি মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। সোমবার ঢাকার তিন নম্বর শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। আদালত বলেন, মুহাম্মদ ইউনূসসহ অন্যদের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এই সময় অধ্যাপক ইউনূসসহ অন্য অভিযুক্তরা আদালতে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও বহুল আলোচিত এই মামলায় পর্যবেক্ষণে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।

আদালত প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ঢাকা, ১ জানুয়ারী।
আদালত প্রাঙ্গণে বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ঢাকা, ১ জানুয়ারী।

ঢাকাঃ দেশের নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলায় ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছে ঢাকার একটি শ্রম আদালত।

একই সঙ্গে তাদের ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। পরে, আপিলের শর্তে দণ্ডিত সকল ব্যক্তির জামিন মঞ্জুর করে বিচারিক আদালত।

সোমবার (১ জানুয়ারি) ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় ঘোষণা করেন। এর আগে, দুপুর পৌনে দুইটার দিকে ড. ইউনূস আদালতে পৌঁছান।

রাষ্ট্রপক্ষ ও অভিযুক্ত পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষ হয় ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর। এরপর, রায় ঘোষণার জন্য ১ জানুয়ারি দিন ধার্য করে আদালত।

এর আগে, ২০২৩ সালের ৬ জুন ঢাকার শ্রম আদালত-৩ চার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে।

মামলায় অনান্য অভিযুক্ত ব্যক্তি হলেন; গ্রামীণ টেলিকম ট্রাস্টের সিইও আশরাফুল হাসান, ট্রাস্টি নূরজাহান বেগম ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম শাহজাহান।

অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ড. ইউনূসসহ তিন জন, মামলার বিচার কার্যক্রম স্থগিত চেয়ে আবেদন করেন।

এরপর, গত বছরের ২৩ জুলাই চার জনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ গঠনের আদেশ কেন বাতিল করা হবে না; তা জানতে চেয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট।

গত ৩ আগস্ট ড. ইউনূস এবং অন্যদের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে অভিযোগ গঠন নিয়ে প্রশ্ন তুলে রুল নিষ্পত্তি করতে হাইকোর্টকে নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে এই মামলা দায়ের করেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে গিয়ে অধিদপ্তরের পরিদর্শকরা দেখতে পান, ১০১ জন শ্রমিক ও কর্মচারীর চাকরি স্থায়ী হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু তা করা হয়নি।

এ ছাড়া, তাদের জন্য কোনো অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি; আর, আইন অনুযায়ী কোম্পানির মুনাফার পাঁচ শতাংশ শ্রমিকদের দেয়া হয়নি।

এসব অভিযোগের ভিত্তিতে, শ্রম আইনের ৪, ৭, ৮, ১১৭, ২৩৪ ধারায় ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়।

শর্তসাপেক্ষে জামিন

ছয় মাসের কারাদণ্ড পাওয়ার পর, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের তিন শীর্ষ কর্মকর্তাকে শর্তসাপেক্ষ জামিন দিয়েছেন আদালত। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা তাদের জামিন মঞ্জুর করেন।

ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, “আপিলের শর্তে আদালত সবাইকে এক মাসের জামিন দিয়েছে।” রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন ব্যারিস্টার মামুন। তিনি বলেন, “আমরা ন্যায়বিচার পাইনি এবং উচ্চ আদালতে আপিল করবো।”

“প্রফেসর ইউনুস বা কারো জন্য (আইন) ভিন্ন হওয়া উচিত না”- শহিদুল আলম

অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনূসের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় ভয়েস অফ আমেরিকাকে ডঃ শহিদুল আলম বলেন, “আইন সকলের ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। এটা প্রফেসর ইউনুস বা কারো জন্য ভিন্ন হওয়া উচিত না। আমরা যেখানে প্রকাশ্যে দেখছি যে, চারিদিকে এতগুলি অন্যায় হচ্ছে এবং সেটার ক্ষেত্রে কোন কিছুই করা হচ্ছে না। অথচ প্রফেসর ইউনুসের ক্ষেত্রে তড়িঘড়ি করে অল্প সময়ের মধ্যে রায় দিয়ে দেওয়া এবং তাকে এবং সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া এটা খুব সন্দেহজনক।”

তিনি বলেন, “এটাতো বলা হচ্ছে শ্রমিকের অধিকারের জন্য। এইখানে তারা যে বঞ্চিত হচ্ছে সেটা শুনে মনে হয় না কিন্তু এই একই দেশে যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকরা বেঁচে থাকার জন্য তাদের নূন্যতম যে বেতন পাওয়ার কথা সেই বেতনের দাবিতে যখন রাস্তায় নামে তখন তাদের আক্রমণ করা হয়, এরেস্ট করা হয়, খুন করা হয়। এই জায়গায় ন্যায় বিচার হচ্ছে এটা আমার জন্য বিশ্বাস করা খুব কঠিন।”

“তার বিরুদ্ধে মামলা শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে না-দেওয়ার জন্য”- ড. হাছান মাহমুদ

নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার রায় প্রসঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, “পৃথিবীতে অনেক নোবেলজয়ী ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। অনেকে জেলও খেটেছেন। ড. ইউনূসের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাচ্ছি, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে না-দেওয়ার জন্য। তিনি শ্রমিকের পাওনা বুঝিয়ে দেননি, বহু বছর ধরে।”

একই সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রম অধিকার বিষয়ে বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর ভূমিকার সমালোচনাও করেছেন তিনি।

তিনি বলেন, “আশা করি, বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও এ নিয়ে কথা বলবেন। শ্রমিকের অধিকার ও পাওনা বুঝিয়ে না দেওয়ার কারণে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে মামলা হয়েছে।” সোমবার (১ জানুয়ারি) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মত বিনিময়কালে এসব কথা বলেন।

ড. ইউনূসের পক্ষে প্রধানমন্ত্রীকে ১৬০ বিশ্বনেতার খোলা চিঠি

১০০জনের বেশি নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০জন বিশ্বনেতা বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সুরক্ষা ও সুস্থতার বিষয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একটি খোলা চিঠি লেখেন ২০২৩-এর আগস্ট মাসে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি সম্বোধন করা চিঠিতে সই করাদের মধ্যে ছিলেন- যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, হোসে রামোস-হোর্তা, মেরি রবিনসন, মারেড করিগান-ম্যাগুয়াইয়ার, শিরিন এবাদি, ডেনিস মুকওয়েগে, নাদিয়া মুরাদ, মারিয়া রেসা, অস্কার আরিয়াস সানচেজ, জুয়ান ম্যানুয়েল সান্তোস, বান কি-মুন, লরা বোলড্রিনি, পল ডেভিড হিউসন (বোনো) এবং স্যার রিচার্ড ব্রানসন প্রমুখ।

ড. মোহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়াকে “বিচারিক হয়রানি” বলে অভিহিত করে সইকারীরা তার বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম অবিলম্বে স্থগিত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

চিঠিতে লেখা হয়েছিল, “বর্তমান প্রেক্ষাপটে মানবাধিকারের প্রতি যে হুমকি আমাদের উদ্বিগ্ন করে তা হলো―নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা। আমরা উদ্বিগ্ন, সম্প্রতি তাকে টার্গেট করা হয়েছে। এটা ক্রমাগত বিচারিক হয়রানি বলেই আমাদের বিশ্বাস।”

এতে আরও বলা হয়েছিল, “আমরা সসম্মানে অনুরোধ করছি আপনি অবিলম্বে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত করুন, তারপরে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণসহ আপনার দেশের মধ্যে থেকে নিরপেক্ষ বিচারকদের একটি প্যানেল দ্বারা অভিযোগ পর্যালোচনা করা হবে। আমরা নিশ্চিত, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী ও শ্রম আইনের মামলাগুলোর যে কোনও পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করা হলে তিনি খালাস পাবেন।”

ঐ চিঠির প্রেক্ষিতে ২৯ আগস্ট পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, “বাংলাদেশের একটি স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা রয়েছে এবং আদালত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন।”

ড. ইউনূসের পক্ষে যারা চিঠি লিখেছেন তাদের প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “তারা (বিচার) প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।” পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, আদালতের কার্যক্রম স্থগিত করার আহ্বান ‘নজিরবিহীন’।

 

মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার সময় আদালতে যা যা ঘটেছে

গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণা হয় সোমবার বিকেলের দিকে। রাজধানীর বিজয়নগরে শ্রম আদালত ভবনটি অবশ্য এদিন অনেক আগে থেকেই ব্যাপক পুলিশি পাহারায় মুড়ে দেয়া হয়েছিল।এ মামলার আসামি নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বেলা একটা ৪০ মিনিটের দিকে তার আইনজীবীদের সঙ্গে নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে আসেন।

বেলা একটা ৪৩ মিনিটে মুহাম্মদ ইউনূস-সহ এ মামলার চারজন আসামি আদালত কক্ষে ঢোকেন। এ সময় গ্রামীণ চেকের জামা পরা ড. ইউনূস বেশ হাস্যেজ্জ্বল ছিলেন।

আদালত কক্ষে ঢুকে একেবারে বামে বসার সারির দ্বিতীয় বেঞ্চে একসাথে ড. ইউনূস-সহ মোট চারজন আসামি বসেন।

এ সময় তার আইনজীবীরা ছাড়াও আদালতে উপস্থিত ছিলেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান,দৃকের প্রতিষ্ঠাতা শহীদুল আলম, তার স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আখতার।

এ ছাড়াও ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল, ব্রতীর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন মুরশিদ-সহ অনেকেই।

মুহাম্মদ ইউনূস আসার পরপরই তারা তার সাথে কথা বলেন, করমর্দন করেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ব্যারিস্টার সারা হোসেনকে এ সময় অধ্যাপক ইউনূসের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলতে দেখা যায়।

তবে তখনও আদালতের বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয় নি। পুরো আদালত কক্ষ ছিলো এ সময় কানায় কানায় পরিপূর্ণ। আদালত কক্ষে ছিলেন দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা।

আদালতের ঘড়িতে যখন দুপুর দুইটা ১৪ মিনিট, তখন এজলাসে আসেন তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা।রায় ঘোষণার শুরুতেই বিচারক আসামিপক্ষের আগে করা দুইটি আবেদন নামঞ্জুর করেন।

এরপরে তিনি জানান, রায়টি বড় হবে। এ ফোর সাইজে ৮৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়। তিনি বলেন,“পুরো রায় পড়ছি না। যতটুকু পড়া যায় ততটুকুই পড়ছি।”। আইনজীবীদের পরে রায়ের সার্টিফায়েড কপি সংগ্রহ করে নেয়ার জন্য বলেন বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা।

বিচারক এ সময় মামলাটি হওয়ার বিস্তারিত প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি কলকারখানা অধিদপ্তরের পরিদর্শক প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শনে গিয়ে শ্রম আইনের লঙ্ঘন দেখতে পায়। পরে তা সংশোধনের জন্য বিবাদী পক্ষকে ১লা মার্চ চিঠি দেয়া হয়।

কিন্তু বিভিন্ন সংশোধনের পর গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষ থেকে এর জবাবে ৯ই মার্চ যে চিঠি দেয়া হয় কর্তৃপক্ষের মতে তা সন্তোষজনক ছিল না।

পরে কলকারখানা অধিদপ্তর শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ড. ইউনূস-সহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করে। অন্যান্য আসামিরা হলেন, আশরাফুল হাসান, নুরজাহান বেগম, মো. শাহজাহান।

এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো হলো শিক্ষানবীশকাল পার হওয়ার পর চাকরি স্থায়ী করা হয় নি, প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আইনানুযায়ী বাৎসরিক মজুরি-সহ ছুটি দেয়া হয় না ইত্যাদি।

এছাড়া ছুটির নগদায়ন করা হয় না এবং ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থও দেয়া হয় না বলে জানানো হয়। অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে রয়েছে, শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয় নি, লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইনানুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেয়া হয় নি।

আদালত বলেন, এসব অভিযোগে চার্জ গঠনের পর কলকারখানা অধিদপ্তরের দেয়া চারজন সাক্ষীর সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। তাদের জেরা করেছে আসামিপক্ষ। ড. ইউনূসসহ আসামিরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে সাফাই সাক্ষ্য দেননি বলে উল্লেখ করেন শ্রম আদালতের বিচারক।

পরে উভয়পক্ষের আইনজীবীরা শুনানিতে যা বলেছেন তার কিছু কিছু অংশ তুলে ধরেন বিচারক।

এ সময় আদালত বলেন, “আসামিপক্ষের আইনজীবী এ মামলার এক নম্বর আসামি ড. ইউনূস সম্পর্কে বলেছেন, তিনি সারা বিশ্বে শিক্ষা, স্বাস্থ্য সমস্যা সমাধানে কাজ করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মতো রোল মডেল তৈরি করেছেন। দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিশ্বব্যাপী শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।”

বিচারক উল্লেখ করেন, “এখানে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের বিচার হচ্ছে না। ড. ইউনূস যিনি গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান, তার বিচার হচ্ছে”।

এরপর পুরো মামলায় উভয়পক্ষের শুনানি ও যুক্তি উপস্থাপন বিশ্লেষণ করে বলেন, “বিবাদীরা স্বীকার করেছেন ড. ইউনূসসহ আসামিরা পরিচালনা পর্ষদে আছেন। আসামিদের দায়বদ্ধতা ছিল না তা বলা যায় না”

ড. ইউনূস
আদালতে মুহাম্মদ ইউনূস

রায়ে আদালত বলেন, “কলকারখানা অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শকের অনুমতি ব্যতীত কোন চাকুরিবিধি অনুমতি দেয়া যাবে না। গ্রামীণ টেলিকমের নিজস্ব নিয়োগ বিধি করার কোনও সুযোগ নাই।”

এ সময় মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন দাঁড়িয়ে বিচারককে বলেন, “শুনানিতে আরেক ধারায় অলটারনেটিভ আর্গুমেন্ট করেছি। তা রায়ে আসেনি। গ্রামীণ টেলিকম চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। স্থায়ী কোন কার্যক্রম নেই।”

বিচারক ওই আইনজীবীকে বলেন, আপনাদের সব বিষয় রায়ে আসবে। এখানে পূর্ণাঙ্গ পড়ছি না। একটু ধৈর্য ধরে শুনতে আইনজীবীকে অনুরোধ করেন বিচারক।

এ পর্যায়ে আদালত উভয়পক্ষের শুনানি উল্লেখ করে ছুটি সংক্রান্ত অভিযোগ সম্পর্কে রায় পড়েন। তিনি বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী ছুটি নগদায়ন করা হয় না গ্রামীণ টেলিকমে।

তখন আবারো, আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন দাঁড়িয়ে যান। তিনি বলেন, “যেসব বিষয় শুনানিতে বলেছি তা রায়ে আসেনি। আমার বক্তব্য জাজমেন্টে থাকতে হবে। বাদ গেলে হবে না। রায়ের মধ্যেই থাকতে হবে যা বলেছি।”

“আবার যেগুলো ট্রায়ালে সাবমিট করি নাই সেটা কেন এখানে আসবে? মামলা (কোয়াশমেন্ট) বাতিল চেয়ে করা আবেদনে যেসব শুনানি করেছি তা কেন এখানে আসবে? সেটা আসলেতো আদালত জাজমেন্টাল হয়ে যাবে”, মন্তব্য করেন মি. মামুন।

তিনি বলেন, “আদালতের চোখ বন্ধ থাকবে।”

বিচারক আবারো আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে বলেন, “আপনি ধৈর্য সহকারে পুরোটা শুনেন। রায়ে সব পাবেন যা বলেছেন। এখন শুধু সংক্ষিপ্তভাবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু পড়ছি।”

পুরো রায় ঘোষণার সময় অন্তত পাঁচবার আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতের কাজে আপত্তি তোলেন।

রায় পড়ার সময় পুরোটাই ড. ইউনূসহ চারজন আসামিকে মনোযোগ দিয়ে রায় শুনতে দেখা যায়। এর মাঝে একবার মুহাম্মদ ইউনূসকে বেশ কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকতে দেখা যায়।

আসামিদের বিরুদ্ধে আনা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রাষ্ট্রপক্ষ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে পেরেছে বলে রায় ঘোষণা করেন তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা।

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসসহ চাজনর আসামিকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একটি ধারায় ছয় মাসের কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা করে জরিমানা করে সাজা দেয় আদালত।

আরেক ধারায় ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। একইসাথে শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী করা, ছুটি সংক্রান্ত সব বিষয় আগামী ৩০ দিনের মধ্যে সমাধান করতে নির্দেশ দিয়েছে শ্রম আদালত।

সাজা ঘোষণার সাথে সাথেই আসামিদের আইনজীবী জামিন আবেদন করলে তা মঞ্জুর করে আদালত। ফলে এখনি কারাগারে যেতে হবে না ড. ইউনূসকে।

এক মাসের মধ্যে আপিল করার শর্তে পাঁচ হাজার টাকার বন্ডে জামিন আবেদন করা হয়। এই এক মাসের মধ্যে আসামিদের শ্রম আপিলেট ট্রাইব্যুনালে আপিল করতে হবে।

ড. ইউনূস
রায়ের পর বেরিয়ে যাওয়ার সময় মুহাম্মদ ইউনূস

প্রায় এক ঘন্টা ধরে এই রায় ঘোষণা করেন বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা।

রায়ের আগে ও পরে প্রায় দুই ঘন্টার মতো আদালত কক্ষে ছিলেন মুহাম্মদ ইউনূস-সহ চার আসামি। সাজা ঘোষণার পরও তাকে হাসতে দেখা গেছে।

পরে দুপুর তিনটা বিশ মিনিটের দিকে আদালত থেকে বেরিয়ে আইনজীবীদের সাথে নিচে নেমে যান মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে অবস্থানরত সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তিনি।

“যে দোষ আমরা করি নাই, সেই দোষের ওপরে শাস্তি পেলাম। এটা আমাদের কপালে ছিল, জাতির কপালে ছিল, আমরা সেটা বহন করলাম” বলেন মি. ইউনূস।

তার আইনজীবী প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “এটা কোন রায়ই হলো না। এটা নজিরবিহীন ঘটনা। যে অভিযোগে সিভিল মামলা হওয়ার কথা ছিলো। তাতে ফৌজদারি অপরাধে সাজা দেয়া হলো। এর বিরুদ্ধে আপিল করবো।”

কলকারখানা অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান বলেন, “প্রত্যাশিত রায় আমরা পেয়েছি। এখন প্রতিষ্ঠান মালিকরা সতর্ক হবে। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আইন লঙ্ঘন হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

রায়ের পরই আদালত কক্ষে থাকা মানবাধিকারকর্মী ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব আইরিন খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এভাবে আইন ও ন্যায়ের নামে অন্যায় করা হচ্ছে, এটা একটা হাস্যকর ব্যাপার। তিনি একজন নোবেল বিজয়ী, গায়ের জোরে এখানে অন্যায়কে ন্যায় বানিয়ে একটা কোর্টের মধ্যে এনে হাস্যকর ব্যাপার বানানো হয়েছে।”

সাংবাদিকদের সাথে কথা বলার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যখন বিজয়নগরের শ্রম আদালত প্রাঙ্গণ ত্যাগ করছিলেন, তখন বিকেল প্রায় চারটা বেজে গেছে।

 

পূর্বের খবরএবার ব্যবসায়িক মডেলে পরিবর্তন আনার কথা বলছে ইভ্যালি
পরবর্তি খবরনির্বাচনেরর পর নতুন বছরের বড় চ্যালেঞ্জ পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন