কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশিদ আলম খানের দাবি, “দালিলিক ও সাক্ষ্যপ্রমাণে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। ফলে সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে আশা করছি।”
“এ ধরণের মামলার শুনানি তিন-চার মাসের মধ্যে সাধারণত শেষ হয়। কিন্তু আসামিপক্ষ মামলা প্রলম্বিত করার জন্য বার বার বিভিন্ন আবেদন নিয়ে উচ্চ আদালতে যায়। যার সবই খারিজ হয়ে যায়”,জানাচ্ছেন তিনি।
ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন অবশ্য বলছেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শ্রম আইনের মামলা করতে হয় তার কোনও প্রক্রিয়াই এখানে অনুসরণ করা হয় নি।
তিনি দাবি করছেন,”কলকারখানা অধিদপ্তর যে মামলা করেছে এটি কোনও ফৌজদারি মামলা হতে পারে না।”
তিনি আরও বলেন, এখন যদি পরিবেশ উল্টে যায়, তাহলে রায়ের বিষয়টি আলাদা ব্যাপার হবে।এ মামলায় আগামী ১লা জানুয়ারি রায়ের দিন ঠিক করেছে ঢাকার শ্রম আদালত।
আন্তর্জাতিক মহলের চাপ
সেনাবাহিনীর সমর্থনে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হওয়ার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের রাজনৈতিক দল গঠনের গুঞ্জন শুরু হয়।
নোবেল পুরস্কার লাভ করার পাঁচ মাসের মধ্যেই রাজনৈতিক দল গঠনের কার্যক্রম শুরু করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন ড. ইউনূস।
সে সময় দেশের মানুষকে খোলা চিঠিতে ড. ইউনূস প্রয়োজনে রাজনীতিতে আসার কথা জানান। ‘পুরাতন রাজনীতি’ থেকে বেরিয়ে আসতেও আহ্বান জানান মানুষকে।
তখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার জন্য জোরালো চেষ্টা চালাচ্ছিল।
সে সময় ড. ইউনূসের রাজনীতিতে আসার প্রচেষ্টার কড়া সমালোচনা করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এরপর চলতি বছরের আগস্টের শেষের দিকে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মোট ১৮টি মামলা হয়।
কিন্তু এরপর থেকেই এই সব মামলা স্থগিত চেয়ে সরকারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ আসতে থাকে । বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে আগে এসব মামলা করার পরই সরব হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক স্তরে সুপরিচিত ব্যক্তিত্বরা।
প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা অধ্যাপক ইউনূসের প্রশংসা করে ব্যক্তিগত চিঠি দেন। তার একদিন পরেই ড. ইউনূসকে হয়রানি বন্ধে ও মামলা স্থগিত করার দাবিতে বিবৃতি দেন নোবেল জয়ীরা-সহ বিশ্বের ১৬০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে এ চিঠি পাঠানো হয়। আর এ বছরের সেপ্টেম্বরে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ঢাকার শ্রম আদালতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলাটি করা হয়।
এর আগে গত মে মাসে বিশ্বের ৪০ জন রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একই ধরনের খোলা চিঠি দিয়েছিলেন।
খোলা চিঠিতে যাদের নাম ছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন হলেন পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন ও ইরানের নোবেল জয়ী শিরিন এবাদি।
পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “বাংলাদেশের বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন এবং এখানে সবকিছু আইনমতো চলে। এ দেশে বিচারাধীন বিষয়ে আমরা কথা বলি না।”
ওই চিঠির প্রতিবাদে বাংলাদেশে সরকার সমর্থক এবং পেশাজীবী একাধিক সংগঠন বিবৃতি দেয়। গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস গিল্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির মতো সংগঠনও বিবৃতি দেয়।
বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-লিপিতে স্বাক্ষর করতে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কর্মকর্তাদের আহ্বান জানায়।
কিন্তু একজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহমদ ভূঁইয়া স্বাক্ষর করেননি ওই বিবৃতিতে। পরবর্তীতে তাকে বরখাস্ত করা হয়।
মামলায় শুনানিতে যা যা হয়েছে
এ মামলার অভিযোগের মধ্যে প্রধান হলো অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিক কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টনের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের পাঁচ শতাংশ না দেয়া এবং ১০১ জন শ্রমিকের চাকরি স্থায়ী না করা।
এছাড়া গণছুটি না দেয়া, শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল ও অংশগ্রহণ তহবিল গঠন না করাও অন্যতম অভিযোগ এই মামলার।
কলকারখানা ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা এ মামলায় ড. ইউনূস-সহ চারজনকে আসামি করা হয়েছে। কলকারখানা অধিদপ্তরের চারজন এ মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এ মামলায় চারজন আসামির পক্ষে আদালতে লিখিত বক্তব্য দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকম যেসব ব্যবসা পরিচালনা করে, সেসব চুক্তিভিত্তিক। নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে তা নবায়নের মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়।
যেহেতু এ প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চুক্তির ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তাই সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে বলেও জানানো হয়।
ওই বক্তব্যে আরো বলা হয়, মিথ্যা অভিযোগে অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান মামলাটি করেছেন।
ড. ইউনূস এ মামলায় সাফাই সাক্ষ্য দেন নি।
তাঁর আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “মামলা প্রমাণ করার দায়িত্ব কলকারখানা অধিদপ্তরের। তাই সাফাই সাক্ষ্য দেয়ার প্রয়োজন নেই।”
মামলাটি হওয়ার পর আত্মসমর্পণ করে জামিন চান ড. ইউনূস। ৩৬ দিন জামিনে ছিলেন তিনি।
পরে মামলার অভিযোগ আমলে নেয়ার পর তাকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। ৯ দিন শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
আসামিদের বিরুদ্ধে দুই ধারায় শাস্তির আবেদন জানিয়েছে কলকারখানা অধিদপ্তর। সবশেষ রোববার রাত সাড়ে আটটা পর্যন্ত শুনানি হয়। পরে রায়ের দিন ঠিক হয়।
এর একটি ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি ছয় মাস ও জরিমানা ৫ হাজার টাকা।
আরেকটি ধারায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।