নিউজ২১ডেস্কঃ একাদশ সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি দ্বাদশ সংসদে পেয়েছে মাত্র ১১টি আসন। যা জাপার রাজনৈতিক ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এটি ১৯৯১ সালে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের পতনে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের পর সবচেয়ে খারাপ ফলাফল। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ২২১ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৫টিতে জয় পেয়েছিল জাপা। ২০০৮ সালে মহাজোট সরকারের মিত্র হিসেবে ৯ম সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয় জাপা। পরবর্তীতে ১৪ ও ১৮ ও সবশেষ রবিবার অনুষ্ঠিত নির্বাচনেও শাসকদল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করার মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নেয় দলটি। ক্ষমতার আশপাশে থাকতে গিয়ে সুবিধাবাদের যে রাজনীতি করছে এতে ধীরে ধীরে দলটি রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছে। এবারের নির্বাচনে জাপা যে ফলাফল করেছে তাতে অনেকেই একে জাপার কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে দেখছেন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে গত ১ বছর ধরে নানা নাটকীয়তা করেছে জাপা। নির্বাচনে অংশ নেওয়া নিয়ে তারা দিনের পর দিন ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে। এমনকি এক পর্যায়ে তারা রাজপথের বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। কিন্ত হঠাৎ করে গত আগস্টে ভারত সফরে যান জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের। জি এম কাদেরের কিছুদিন আগে ভারত সফর করে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদল। এরপর থেকে তিনি আওয়ামী লীগের সমালোচনা বন্ধ করে দেন এবং গণমাধ্যম থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখেন। নানা নাটকীয়তা ও অনিশ্চয়তা তৈরি করে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পেয়ে ২৬৫ আসনে নির্বাচনে অংশ নেয় জাপা।
জাপার এই ভরাডুবির পেছনে দলের বিভক্তি ও সাংগঠনিক দুর্বলতাই দায়ী। এরশাদের অনুপস্থিতে যোগ্য নেতৃত্ব না থাকা ও তৃণমূলের সঙ্গে নেতাদের যোগাযোগ না থাকার মূল্য চুকাতে হয়েছে আসন হারিয়ে। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পরও জাপার দুই প্রধান নেতা জি এম কাদের ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ দ্বন্দ্বে জড়ান। ফলে রওশন ও তার অনুসারীরা নির্বাচনে অংশ নেননি। জাপা নেতারা মনে করেন রওশন থাকলে সরকার জাপাকে আরও কিছু আসনে ছাড় দিত। নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পর জাপা থেকে প্রার্থীদের যে আর্থিক সহযোগিতা দেওয়ার কথা ছিল তাও দেওয়া হয়নি। ফলে প্রার্থীরা প্রচার-প্রচারণা চালাতে পারেনি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাপার ২৬ আসনে সমঝোতা করার বিষয়টি জাপায় অসস্তি তৈরি করে, এর ফলে জাপা নেতারা ভয় পেয়ে যান বাকি আসনে সুষ্ঠু ভোট হবে না এবং জাপার পরাজয় নিশ্চিত। এমনকি জাপার ছাড় পাওয়া প্রার্থীরা পোস্টার বানান আওয়ামী লীগ সমর্থিত লিখে, যা নিয়ে বাকি নেতারা প্রকাশ্যে ক্ষোভ জানান।
জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভ রায় বলেন, জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের নিজে নিজের দলকে কোরবানি দিয়েছেন। মুষ্ঠিমেয় কয়েকজনকে সুবিধা দিতে গিয়ে দলকে ডোবানো হয়েছে। ৩০০ আসনে অংশ নেওয়ার কথা বলে ফরম বিক্রি করে পরে ২৬ জন কেন সমঝোতা করলেন। ৯১ সালে এর চেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকার পরেও জাপা ভালো ফলাফল করেছিল। এবারও সেই প্রত্যাশা ছিল। জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিব এই ভরাডুবির জন্য দায়ী।
নির্বাচনের প্রচার-প্রচারণা শুরু হওয়ার পর জাপা চেয়ারম্যান ও মহাসচিব দলের কোনো প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। জাপার প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো নেতা প্রার্থীর পক্ষে জনসভা করেননি। জাপা চেয়ারম্যানকে উত্তরাঞ্চলের প্রার্থীরা বারবার অনুরোধ করলেও তিনি রংপুর ৪ ও ৬ আসন ছাড়া আর কোনো আসনে প্রচারণা কিংবা জনসভা করেননি। লালমনিরহাট ৩ এবং রংপুর ১ আসনে প্রতি নির্বাচনে জাপা থেকে প্রার্থী পরিবর্তন করা হয় ফলে ভোটাররা বিরক্ত ছিলেন। যার প্রভাব ভোটে পড়ে। জাপা থেকে যেসব এলাকায় সংসদ সদস্য ছিলেন সেসব এলাকায় উন্নয়ন কম হওয়ায় স্থানীয় জনগণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। জনগণের মনে ধারণা জন্মেছে সরকারি দলের এমপি থাকলে উন্নয়ন বেশী হয়। যেসব নেতারা গত ৩ মেয়াদে সংসদে ছিলেন তারা দলের উন্নয়ন ও প্রচারে কোনো ভূমিকা রাখেননি, তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।
চট্টগ্রাম-১৫ আসনের জাপা প্রার্থী মোহাম্মদ ছালেম বলেন, ১ সপ্তাহ ধরে চেয়ারম্যান ও মহাসচিবকে ফোন দিয়ে পাইনি। তারা ফোন রিসিভ করেন না, কোনো ধরনের যোগাযোগ প্রার্থীদের সঙ্গে রাখেননি। এই খারাপ ফলাফলের জন্য দলের শীর্ষ নেতৃত্ব দায়ী।
জাপা কো চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ দেশ রূপান্তরকে বলেন, নির্বাচন নিয়ে জাপার প্রস্তুতি ভালো ছিল না। নির্বাচনের আগে নির্বাচনে অংশ নেওয়া না নেওয়া নিয়ে যে দ্বিধা ছিল তা দলের খারাপ ফলাফলকে ত্বরান্বিত করেছে। দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে যাওয়ার পর এই চেয়ে ভালো ফলাফল সম্ভব ছিল না। ফলে এই ফলাফলকে আমি কাঙ্ক্ষিত মনে করব।
সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায় দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের ভোট প্রায় ৪০ শতাংশ এবং জাপার ভোট মাত্র ৫ শতাংশের কম। ফলে আওয়ামী লীগ কিংবা তার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের সঙ্গে যে ভোটের ব্যবধান তাতে আওয়ামী লীগের পূর্ণ সমর্থন ছাড়া জাপার পক্ষে কোনো আসন জয়ই সম্ভব ছিল না।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত ৩ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় থাকতে গিয়ে জাপার কোনো বিকাশ ঘটেনি। তারা দল না হয়ে একটা সুবিধাবাধী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়। জাপার নেতারা সরকারের সঙ্গে থেকেও বিরোধী দলের আসনে বসা নিয়েও মানুষ বিরক্ত ছিলেন। জাপা সংসদে থেকেও জনগণের পক্ষে কোনো কার্যকর ভূমিকা না রাখা ভোটারদের ক্ষুব্ধ করে রেখেছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গবেষণা সেল ও থিংক থ্যাঙ্ক হিসেবে পরিচিত বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শক থাকলেও জাপার কোনো গবেষণা সেল নেই, উচ্চ শিক্ষিত নেতাকর্মী নেই এমনকি বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত এমন কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীও জাপার নেই। ফলে দিনে দিনে দল হিসেবে তারা ঝুঁকিতে পড়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শামীম রেজা মনে করেন, সুবিধাবাদের রাজনীতি করতে গিয়ে জাপা রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। জাপা যে ফলাফল করেছে তাতে তাদের পক্ষে এর চেয়ে ভালো ফলাফল কঠিন ছিল। আওয়ামী লীগ ছাড় না দিলে হয়তো বা আরও খারাপ ফলাফল করতে হতো জাপাকে।
আওয়ামী লীগ যে ২৬টি আসনে জাপাকে ছাড় দিয়েছিল তার ১১টিতে জিতেছেন জাপার প্রার্থীরা। তবে ছাড়ের বাইরে একটি আসনেও জিততে পারেননি দলটির কোনো প্রার্থী। আওয়ামী লীগের ছাড় না পাওয়া ২৩৯ আসনের মধ্যে সব কটিতেই ভরাডুবি হয়েছে। এই ২৩৯টির মধ্যে প্রায় ২২০ আসনে জামানত হারিয়েছে জাপা। গত নির্বাচনেও জাপা ১৪৬টি আসনে জামানত হারিয়েছিল।
এক সময় রংপুর বিভাগের ৩৩টি আসনে জাতীয় পার্টির একক আধিপত্য ছিল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীরা এসব আসনে জাপার সঙ্গে লড়াইয়ে টিকতে পারতেন না। এই ৩৩টি আসন দখলে থাকার কারণে রাজনীতিতে জাপার গুরুত্ব ছিল প্রধান দুই দলের কাছে। ৯১ ও ৯৬ সালে জেলে থাকার পরও রংপুরের ৫টি করে আসনে অংশ নিয়ে সবকটিতেই জয় পেয়েছিলেন দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। এমনকি একাদশ নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশ নেওয়ার পরও জাপা উত্তরাঞ্চলে ৭টি আসনে জয় লাভ করেছিল। এবার আওয়ামী লীগ যে ২৬টি আসন ছেড়ে দেয় তার মধ্যে ৯টিই ছিল উত্তরাঞ্চলে। কিন্ত সেখানে রংপুর ৩ জি এম কাদের, কুড়িগ্রাম-১ এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান, ঠাকুরগাঁও-৩ হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ছাড়া বাকী কেউ জিততে পারেননি। সমঝোতার বাইরে থাকা ২৪ আসনের একটিতেও জয় লাভ করতে পারেননি জাপা প্রার্থীরা। এর মধ্যে ১০টিরও বেশী আসনে জামানাত হারিয়েছেন তারা। কেবল রংপুর জেলার ৬টি আসনের মধ্যে ৩টি আসনেই জামানত হারইয়েছেন জাপা প্রার্থীরা।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে রংপুর বিভাগের ৩৩ আসনের মধ্যে জাপা ১৭টি, ৯৬ এ ২১টি, ২০০১ এ ১৪টি, ০৮ এ ১৩টি, ১৪ ও ১৮ তে সমান ৭টি করে আসন পেয়েছিল জাপা।
রংপুরের দুর্গ হারানোর কারণ হিসেবে যেসব কারণ উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে এরশাদের মৃত্যুর পর থেকে জাপার প্রতি মানুষের যে আবেগ ছিল তা নষ্ট হয়ে গেছে। এরশাদের মৃত্যুর পর অন্য জি এম কাদের কিংবা অন্য কেউ মানুষের মন জয় করতে পারেননি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট করার কারণে জাপা আসন ছেড়ে দেওয়ায় সেসব আসনে জাপা দুর্বল হওয়ায়। গত ৫ বছরে উত্তরাঞ্চলে জাপা কোনো সম্মেলন কিংবা জনসভা করেনি। দলের কোনো সাংগঠনিক কাঠামো নেই। সরকারে থাকায় সুযোগ সুবিধা নিতে জাপার স্থানীয় শক্তিশালী নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন। প্রতিটা আসনে দলীয় নেতাকর্মীরা বিভক্ত থাকলেও তা মীমাংসা না করা।
সিলেটের পর রংপুর ও ময়মনসিংহ বিভাগে জাপার জনপ্রিয়তা ও ভালো ভোট ব্যাংক থাকলেও এই দুই বিভাগের কিশোরগঞ্জ ৩ আসনে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু ছাড়া আর কেউ জিততে পারেননি। ঢাকা ও রংপুর ছাড়া দেশের আর কোথাও জাপার কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই ফলে এসব এলাকার জাপা নেতারা এখন আর জাপার রাজনীতিতে সক্রিয় নয়। তারা অন্য দলে মিশে যাচ্ছেন। এর বাইরে জাপার ছাত্র রাজনীতি, যুব রাজনীতি কিংবা পেশাজীবীদের রাজনীতি নেই। কেবল জাপা সুবিধাবাদের রাজনীতি নিয়ে দলের বিকাশ সম্ভব নয়।