জানা গেছে বিএনপি ও তাদের সমমনারা বাইরের আরো সক্রিয় চাপ আশা করছে। বিশেষ করে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তারা এখনো কথা না বলায় বিএনপির মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করছে। কারণ বিএনপি বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলছে। তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চায়। অন্যদিকে বাইরের চাপ নিয়ে সরকারও অস্বস্তিতে আছে। বিশেষ করে ভিসা নীতি এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সরকারকে বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে। কারণ ভিসা নীতি সরকারি কর্মকর্তা ও কিছু রাজনৈতিক নেতাকে বেশ ভাবাচ্ছে। আর যারা দেশের বাইরে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করেছে তারাও আছেন আতঙ্কে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের কথায় সরকারের অস্বস্তি বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি গত ১০ আগস্ট বলেছেন,” আগামী নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা নতুন কোনো চুক্তি করব বলে মনে হয়না।”
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে আকসা (অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড ক্রস-সার্ভিসিং অ্যাগ্রিমেন্ট)’ ও ‘জিসমিয়া (জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট) নামে দুই চুক্তি সইয়ের ব্যাপারে অনেক দিন ধরেই আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। চলতি মাসেই ঢাকায় এনিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তা সংলাপ হওয়ার কথা রয়েছে। এই দুইটি চুক্তি নির্বাচনের আগে হবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ৫ আগস্ট নয়াপল্টনে এক সমাবেশে বলেন,” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কী বলল বা যুক্তরাজ্য কী বলল অথবা ভারত কী বলল, তা নিয়ে আমাদের মাথা ঘামানোর দরকার নেই। জনগণ পরিষ্কার করে বলছে, সরকার বিদায় হওয়ার আর সময় নেই। এই সরকারকে যেতেই হবে।”
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই দুইটি বক্তব্য থেকেই দুই বড় দলের অস্বস্তি বোঝা যাচ্ছে। কোনো দলই যুক্তরাষ্ট্র ও বিদেশিদের ভূমিকায় তারা যা চায় তা পুরোপুরি পাচ্ছেনা।
তবে তাদের অবস্থান যাই হোক বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে এখন বিদেশিদের ভূমিকাই আলোচনায়। ঢাকায় এখন রয়েছেন দুইজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান। পররাষ্ট্র দপ্তর বলছে তারা কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখতে এসেছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে তাদের মূল এজেন্ডা বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন।
যে দুইজন কংগ্রেসম্যান ঢাকায় এসেছেন তারা হলেন, হাওয়াই থেকে নির্বাচিত ডেমোক্রেটিক পার্টির কংগ্রেস সদস্য এড কেইস ও জর্জিয়া থেকে নির্বাচিত রিপাবলিকান পার্টির কংগ্রেস সদস্য রিচার্ড ম্যাকরমিক। তারা ঢাকায় অবস্থানের সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির সঙ্গে তাদের যে বৈঠক হবে তা নিশ্চিত হওয়া গেছে।
‘অ্যামেরিকার দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান ভোটের আগে বড় চাপ’
তারা রোববার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠকের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘‘তারা নির্বাচন নিয়ে আমাদের সরকারের পরিকল্পনা জানতে চেয়েছেন। নির্বাচনের বিষয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতার পথ আছে কি না সেটাও তারা জানতে চেয়েছেন।’’ “ আর বাংলাদেশ চীনের খপ্পড়ে পড়েছে কি না তা ও তারা জানতে চান,” বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
এদিকে চলতি মাসের শেষের দিকে প্রতিরক্ষা সংলাপে যোগ দিতে আসছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কমান্ডের কৌশলগত পরিকল্পনা ও নীতিবিষয়ক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল টমাস জেমস। আগামী মাসে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতার রূপরেখা চুক্তি (টিকফা) সংক্রান্ত পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে ঢাকায় আসবেন মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী বাণিজ্য প্রতিনিধি ব্রেন্ডন লিঞ্চ। এ ছাড়া অক্টোবরে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সংলাপ আয়োজনের চেষ্টা চলছে। আর আগামী ৮ অক্টোবর ঢাকায় আসার কথা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল।
গত সপ্তাহে ঢাকা সফর করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের বৈশ্বিক দুর্নীতি দমন বিভাগের সমন্বয়ক রিচার্ড নেফিউ। তার সঙ্গে বৈঠকের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন জানিয়েছেন,” নেফিউ একসময় নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করতেন, সে ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞাকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের চিন্তাভাবনা তাদের আছে। ভবিষ্যতে বড় বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, এমনটি তারা ভাবছে। টাকা পাচার দুর্নীতির একটি অংশ। টাকা পাচার নিয়ে আলাপ হয়েছে।”
আর পরে অন্য একটি অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, “দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে আমরা খুব খুশি হব। তবে ওদের (যুক্তরাষ্ট্রের) দেশে আইন আছে কেউ সেখানে টাকা নিয়ে গেলে ওয়ার্ক পারমিট পায়, নাগরিকত্ব পায়। ওদের মতো এমন আরো অনেক দেশ আছে। তবে আমাদের দেশ থেকে কেউ যদি সেখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) টাকা নিয়ে যায়, আর তারা যদি সে টাকা জব্দ করে, আমরা খুব খুশি হব।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল(অব.) শহীদুল হক মনে করেন,” ভিসা নীতি এবং দুর্নীতির ব্যাপারে মার্কিন অবস্থানের ফলাফল নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে ততই স্পষ্ট হবে। ভিসা নীতির ফলাফল মারাত্মক। কার এটা শুধু ব্যক্তি নয়, পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারেও প্রয়োজ্য। এটা হয়তো বাইরে দেখা যাবেনা। কিন্তু এর ফল অনেক সুদূরপ্রসারী। যারা এটা নিয়ে কনসার্ন তারা এটা বুঝতে পারছেন এরইমধ্যে।”
‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির ফলাফল মারাত্মক হতে পারে’
“আর দুর্নীতির ব্যাপারেও মার্কিন অবস্থান প্রভাব ফেলবে। এটা অনেককেই আতঙ্কগ্রস্ত করেছে এরইমধ্যে। এর মধ্যে রাজনীতিবিদ আছেন।রাজনীতির বাইরের লোকও আছে,” বলেন এই কূটনীতিক।
তিনি মনে করেন,” মির্জা ফখরুল এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলছেন তা রাজনৈতিক কথা। তারা এর মধ্য দিয়ে পলিটিক্যাল মাইলেজ নিচ্ছেন। কারণ সবাই চাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের দিকে ঝুঁকে থাকুক।”
তার কথায়,” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশিরা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। এটাই বড় কথা। সেটা কোন পদ্ধতিতে হবে সেটা তাদের বলার কথা নয়।”
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. হুমায়ূন কবীর মনে করেন,” দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান নির্বাচনের আগে সবচেয়ে বড় দৃশ্যমান চাপ হবে। আর ভিসার ব্যাপারে যারা কনসার্ন তাদের খবর হয়ে গেছে। এটা আমরা বাইরে দেখতে পারছিনা।”
তিনি বলেন,” তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। এর মধ্যেই সব আছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা দরকার সরকার সবই করবে বলে তাদের প্রত্যাশা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তারা কথা বলেনি, বলবেও না।”
এই দুইজন কূটনীতিকই মনে করেন, নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিদেশি চাপ আরো বাড়বে, বিশেষ করে মার্কিন চাপ। হুমায়ূন কবীর বলেন,” ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা যুক্তরাষ্ট্রকেই অনুসরণ করবে। শেষ পর্যন্ত ভারতও যুক্তরাষ্ট্রের পলিসির বাইরে যাবে বলে মনে হয়না।”