এই সামান্য মূল্যহ্রাসের সুবিধাও সাধারণ ক্রেতা একটুও পাবে কিনা সন্দেহ৷ তবে খুচরা বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি। বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি আব্দুল হান্নান বলেন ,” আমরা এরচেয়ে বেশি এখন কমাতে পারবো না। আমরা বেশি দামে ধান কিনে চাল করেছি। এটা বিক্রি করতে আরো ছয়-সাত দিন সময় লাগবে। তারপর দেখা যাক আর কমানো যায় কিনা।”
এ বিষয়ে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তার তিনটি মোবাইল ফোনই বন্ধ পাওয়া গেছে।
‘খাদ্যমন্ত্রী কি চারদিন অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ করে দিলেন?’
‘‘২০১৮ সালের নির্বাচনের পর বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার প্রথম খাদ্যমন্ত্রী হন। তার শপথ নেয়ার দিনই হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যায় কেজিতে পাঁচ-ছয় টাকা। তখন তিনি তার কাছের চাল ব্যবসায়ী ও মিলারদের ডেকে বললেন, চালের দাম কমাতে হবে। ব্যবসায়ীরা নানা অভিনয় করে পরে দুই টাকা কমানোর কথা বললো। দুই টাকা কেজিতে কমে গেল-”এমন দাবি করে বাংলাদেশ অটো রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভপতি খোরশেদ আলম খান বলেন, “এর ভিতরেও রহস্য আছে। তিনি আবারো খাদ্যমন্ত্রী হলেন। আবারো চালের দাম বেড়ে গেল। তিনি চারদিনের মধ্যে চালের দাম কমানোর কথা বলে ব্যবসায়ীদের কি আরো চারদিন অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ করে দিলেন? চালের দাম তো আরো সাত দিন আগে বেড়েছে। তাহলে কি তার কথায় চালের দাম বাড়ে-কমে?”
তিনি দাবি করেন,” উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলার কয়েকজন চাল ব্যবসায়ী ও মিল মালিক চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন। তাদের মধ্যে নওগাঁ ও দিনাজপুরের দুইজন ব্যবসায়ী মূল নিয়ন্ত্রক। তাদের ‘সোজা’ করলেই চালের বাজার ঠিক হয়ে যাবে। আসলে চালের দাম বাড়িয়ে ব্যবসায়ীদের কয়েকদিন অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এখন কমালেও কোনো ক্ষতি নেই। তাদের যা মুনাফা করার, তা তারা করে নিয়েছেন।”
বাংলাদেশ অটো রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশনের সভপতি মনে করেন, “এই ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ার কোনো কারণ ছিল না। আসলে কতিপয় ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো মুনাফা করার সুযোগ করে দেয়া হলো। তারা আরো চারদিন অতিরিক্তি মুনাফা করে চালের দাম আবার আগের জায়গায় নিয়ে যাবে।”
তিনি বলেন, “দিনাজপুরে এক ব্যবসায়ী আছে তার ১০০ চালের গুদাম আছে। তার কাছে আপনি দুই বছর আগের ধানও পাবেন। ওই এলাকার যত ছোট মিল আছে সব তার ভাড়া নেয়া। নওগাঁয় এরকম আরো একজন ব্যবসায়ী আছে। তারাই মূলত বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন।”
তাদের একজন নওগাঁ জেলা চাল কল মালিক সমিতির সভাপতি ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম বলেন, ” মন্ত্রী মহোদয় যখন বলেছেন তখন চালের দাম কমে যাবে। বস্তা (৫০ কেজি) প্রতি ২৮০ টাকা দাম কমে যাবে। চিন্তার কোনো কারণ নেই।”
তার কথা,” ধান কম ছিল তাই সিদ্ধ চালও কম হয়েছে। তাই একটু দাম বেড়েছে। এখন কমে যাবে। কমতে শুরু করেছে।” কিন্তু ধানের সরবরাহ না থাকলে কমবে কীভাবে জানতে চাইলে তিনি কোনো কারণ না বলে শুধু বলেন, “কমে যাবে, কমে যাবে।”
সেই দুই ব্যবসায়ীর আরেকজন দিনাজপুরের জহুরা অটো রাইস এজেন্সি, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাল ব্যবসায়ী। এর মালিক আব্দুল হান্নান বাংলাদেশ অটো মেজর হাসকিং মিল মালিক সমিতির সহ-সভাপতি। তিনি বুধবার খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ছিলেন। অনেকের মতে, তিনি বাংলাদেশের চাল ব্যবসার নিয়ন্ত্রক। তিনি বলেন, “বৈঠকের পর আমাকে মন্ত্রী মহোদয় এবং সচিব স্যার আলাদাভাবে ডেকেছিলেন। আমাকে চালের দাম কমানোর জন্য চাপ দেন। আমি বলেছি, চাপ দিয়ে কমালে উল্টা রিঅ্যাকশন হতে পারে। আমরা যা সাধ্যের মধ্যে, তাই কমিয়েছি। যেটার দাম বস্তা (৫০ কেজি) দুই হাজার ৩৩০ টাকা ছিল সেটা দুই হাজার ৩০০ করেছি। যেটা দুই হাজার ২৩০ টাকা ছিল সেটা দুই হাজার ২০০ টাকা করেছি। কেজিতে ৬০ পয়সা কমিয়েছি। তবে খুচরা ভোক্তা পর্যায়ে এর প্রভাব পড়তে সময় লাগবে।”
তার কথা, “আপাতত এর বেশি কমানো সম্ভব নয়। কারণ, আমরা বেশি দামে ধান কিনেছি। সেটার চাল বিক্রি করতে আরো ছয়-সাত দিন সময় লাগবে। তারপরে ধানের দাম কম হলে চালের দাম কমবে। ধানের ফলন ভালো হলেও অনেকে নির্বাচনের কারণে ধান বিক্রি করেনি। কী না কী হয় তাই ভেবে। তাই আমাদের বেশি দামে কিনতে হয়েছে।”
বাজার এখনো চড়া
নির্বাচনের পর থেকেই চালের দাম বাড়তে থাকে। ঢাকার বাজারে এক সপ্তাহ আগে যে মোটা চালের কেজি ৫০-৫২ টাকা ছিল, তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৫৪-৫৫ টাকায়। মাঝারি মানের চালের কেজি ৫৫ থেকে ৫৮ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা। আর মিনিকেট ও নাজিরশাইলের মতো সরু চাল ৬২ থেকে ৭৫ টাকা থেকে বেড়ে ৬৮ থেকে ৮০ টাকা হয়েছে। কিছু বিশেষ ধরনের সরু চাল অবশ্য বিক্রি হচ্ছে আরো বেশি দামে। গড়ে কেজিতে চালের দাম বেড়েছে ছয় টাকা।
কারওয়ান বাজারের বরিশাল রাইছ এজেন্সির আল হাসিব বলেন, “চালের দামের ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। মিলাররা দাম বাড়ালে দাম বাড়ে। তারা দাম কমালে দাম কমে। খাদ্যমন্ত্রী চালের দাম চারদিনের মধ্যে কমানোর কথা বলেছেন। কিন্তু আজ (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত কমেনি। আমরা মিলারদের কাছ থেকে নতুন চাল আর কিনছি না। পুরোনো চালই বিক্রি করছি। তারা যখন কম দামে চাল দিতে শুরু করবেন, তখন কিনবো। মনে হয় দুই-একদিনের মধ্যে কমবে।”
তার কথা, “মিলাররা চাইলে দাম কমাতে পারে। আমাদের জানা মতে, চালের কোনো ঘাটতি নেই। এখন চালের ভরা মৌসুম।”
মেসার্স হাজী ইসমাইল এন্ড সন্সের মো. জসিম উদ্দিনও একই কথা বলেন। তার কথা,” কোজিতে ৬০ পয়সা কমানোর কথা বলা হলেও আমরা মিলারদের কাছ থেকে কম দামে এখনো পাচ্ছি না। তাই চালও কিনছি না। আর মাত্র ৬০ পয়সা কমালে খুচরা পর্যায়ে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না।”
কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাক)-এর সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, “এটা পুরোনো পদ্ধতি। কেজিতে ছয় টাকা বাড়িয়ে এখন তারা মাত্র ৬০ পয়সা কমাচ্ছে। তারা এভাবেই মুনাফা লুটপাট করে। এই খাদ্যমন্ত্রী এর আগেও পাঁচ বছর খাদ্যমন্ত্রী ছিলেন। তখনো তিনি কিছু করতে পারেননি। এখনো পারবেন না। কারণ, তিনি নিজেও চাল ব্যবসায়ী ছিলেন। চাল ব্যবসায়ীদের পুরোনো কলিগ তিনি। ব্যবসায়ীরা জানে, মন্ত্রী তাদের পক্ষেই কাজ করবেন।”
” এই দুই সপ্তাগে ব্যবসায়ীরা কয়েশ’ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফা করে নেবে। তাদের সেই সুযোগ করে দেয়া হলো,” বলেন তিনি।
দেশে এই মুহূর্তে চালের মোট মজুত কত সে ব্যাপাারে সঠিক তথ্য না থাকলেও খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, চালের পর্যাপ্ত মজুত আছে। আর সরকারের কাছে মজুত আছে ১৪ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন।
মুদ্রানীতি ও মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার যে ছয় মাসের মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে তার মূল উদ্দেশ্য হলো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। তারা মূল্যস্ফীতি সাত ভাগে নামিয়ে আনতে চায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) মূল্যস্ফীতির সর্বশেষ যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায় গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯.৪১ শতাংশ হয়েছে । এটা গত সাত মাসে সর্বনিম্ন। এই সময়ে খাদ্য পণ্যেও মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে, তবে অন্যান্য পণ্যে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে।
গত অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৩ শতাংশ, নভেম্বরে কমে হয় ৯.৪৯ শতাংশ। গত এপ্রিলে এটি ছিল ৯.২৪ শতাংশ, কিন্তু মে মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৯৪ শতাংশ। বিবিএসের তথ্যমতে, ডিসেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমে হয়েছে ৯.৫৮ শতাংশ, আগের মাসে যা ছিল ১০.৭৬ শতাংশ।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ইকোনমিক মডেলিং ( সানেম)-এর নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হান বলেন, “মুদ্রানীতিতে সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি বাড়ানোর কৌশল নেয়া হয়েছে। এটা খুব বেশি কার্যকর হবে বলে মনে হয় না। কারণ, এর আগেও ধাপে ধাপে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে। তা কাজে আসেনি। মুদ্রানীতির অন্যান্য যে পলিসি তা মূল্যস্ফীত কমানোর জন্য কার্যকর নয়।”
তার কথা, “এখানে মুদ্রানীতি, রাজস্ব নীতি এবং সামগ্রিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করা দরকার। বাজারে যে অনিয়ম আছে তা দূর করা দরকার। এখানে সমন্বয় দরকার। বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে হবে না। এই যে চালের দাম অব্যাহতভাবে বাড়ছে, অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে, এর যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এখানে বাজার ব্যস্থাপনার ঘাটতি আছে। চালের দাম অনেক বাড়িয়ে সামান্য কমানো হবে এটা তো হতে পারে না। তাই এই অবস্থা রেখে মুদ্রানীতি দিয়ে মূল্যষ্ফীতি কমানো যাবে বলে মনে হয় না। বাজারের জন্য যে বডিগুলো আছে, টুলস আছে, সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।”
তার মতে, “বিবিএস যে হিসাব দিচ্ছে, বাস্তবে মূল্যস্ফীতি তার চেয়ে বেশি। আর নিম্নবিত্ত মানুষ চালসহ যেসব পণ্য বেশি কেনেন, সেখানে মূল্যস্ফীতি আরো বেশি।”