নিজস্ব প্রতিনিধিঃ চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা নিয়ে বিগত ৬ বছরে ১৮টি সমন্বয় সভা হয়েছে। ঘুরেফিরে আসা সাতটি সিদ্ধান্তের কোনোটিরই বাস্তবায়ন হয়নি।
চট্টগ্রাম নগরে জলাবদ্ধতা নিরসনে বড় বাধা হিসেবে দেখা হয় সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতাকে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ স্থানীয় পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রতিনিধিদের নিয়ে ছয় বছরে ১৮টি সভা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০টি সভার কার্যবিবরণীতে সাতটি সিদ্ধান্তের কথা বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু একটিও ঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে প্রতিবছর চট্টগ্রাম নগর ১০ থেকে ১৪ বার করে ডুবছে।
এসব সিদ্ধান্তের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকল্পের অধীনে নগরের ৪০টি খালের মুখে জোয়ার প্রতিরোধক ফটক (স্লুইসগেট) স্থাপনের কাজ দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ করা।
কারণ, বর্ষার অতি বর্ষণের সঙ্গে অস্বাভাবিক জোয়ার যুক্ত হলে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ হয়। এবারও তা–ই হয়েছে। অথচ গত ছয় বছরে ৪০টির মধ্যে মাত্র ৫টি জোয়ার প্রতিরোধক চালু হয়েছে। বাকি ৩৫টির কাজ এখনো শেষ হয়নি।
জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে সভা হলেও সংস্থাগুলো সরকারি ‘প্রটোকল’–এর জন্য অংশ নেয়। নিজেদের মধ্যে দূরত্বের কারণে একের পর এক সমন্বয় সভায় অনেক সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন করার তাগিদ মনে করছে না সংস্থাগুলো।
মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান
জোয়ার প্রতিরোধক ফটকের কাজ শেষ না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ হলেও মরিচা রোধক ফটকগুলো আনতে হচ্ছে নেদারল্যান্ডস থেকে। এ জন্য চালু করতে দেরি হচ্ছে।
এ ছাড়া বাকি সিদ্ধান্তগুলোও কোনোটি ঠিকভাবে হয়নি। এগুলো হলো খাল–নালা–নর্দমা নিয়মিত পরিষ্কার রাখা, নতুন খাল খনন দ্রুত শেষ করা, নগরের ২১টি খাল পুরোনো রূপে ফিরিয়ে আনা, জলাধার তৈরি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নত করে খালে আবর্জনা ফেলা বন্ধ করা এবং চলমান বড় প্রকল্পের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) সংশোধন ও অনুমোদন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এতগুলো সভার পরেও চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা কমেনি; বরং ভয়াবহ পরিস্থিতি রূপ নিয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে অংশীদারি সংস্থাগুলো দায় সারতে এসব সভায় অংশ নেয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গুরুত্ব দেয় না। এ কারণে চট্টগ্রামের মানুষের পানিতে তলিয়ে যাওয়ার কষ্ট কমছে না।
মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী নিজেই দাবি করছেন, জলাবদ্ধতা নিরসন কাজে সিডিএ সমন্বয় করছে না। প্রকল্পের আওতায় ঠিকভাবে খাল খনন হয়নি। যদিও সিডিএ তা অস্বীকার করছে।
চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০১৭ সালের আগস্টে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ৫ হাজার ৬১৬ কোটি টাকার বড় প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। এই প্রকল্প নিয়ে শুরু থেকে সিটি করপোরেশন ও সিডিএর দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল। এরপর সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের বিষয়টি সামনে আসতে থাকে।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরে জুলাই পর্যন্ত হওয়া ১৮টি সভার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নেতৃত্বে একটি, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্ব একটি, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পাঁচটি, সিটি করপোরেশনের নেতৃত্বে তিনটি ও বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের নেতৃত্বে আটটি সভা হয়। বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের উদ্যোগে সর্বশেষ সভা হয়েছে গত ২৩ জুলাই চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। এর আগেই ছয়বার ডোবে নগর। সেই সভায়ও জোয়ার প্রতিরোধক ফটক চালুর ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল।
চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সাত দিনে ভারী বৃষ্টির সঙ্গে পূর্ণিমার জোয়ার যুক্ত হয়ে গত ছয় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ জলাবদ্ধতা হয়েছে। নগর পানিবন্দী থাকে পাঁচ দিন। এর আগে চলতি বছর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত নগরে অন্তত ছয়বার জলাবদ্ধতা হয়েছে। এবারের জলাবদ্ধতার শুরু ১ এপ্রিল। বৃষ্টিতে নগরের বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। এরপর ৩০ এপ্রিল, ২৪ ও ৩১ মে, ১০ ও ১৭ জুনও জলাবদ্ধতা হয়। আর আগস্টের প্রথম সাত দিনে পাঁচবার ডুবেছে নগর। এর মধ্যে ৪ থেকে ৭ আগস্ট টানা চার দিন বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে নগরের অন্তত ৪০ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে ছিল। এতে কষ্টে পড়ে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এর আগে গত বছর ১২ বার ও ২০২১ সালে ১৪ বার ডোবে নগর।
অথচ জলাবদ্ধতা নিরসনে সিটি করপোরেশনের একটি, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) দুটি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি প্রকল্পের আওতায় ১১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার কাজ চলছে। গত ছয় বছরে ৫ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা ব্যয়ের পরও সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী।
সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নজর নেই
চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে উদ্যোগে সভা হয় ২০২১ সালের ১৬ জুন। ওই সভায় আলোচনার পর তিনটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একটি ছিল জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পগুলোর সমন্বয় ও তদারকির জন্য বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে প্রতি মাসে সভা হবে। কিন্তু গত ২৪ মাসে সভা হয়েছে আটটি। বিশেষজ্ঞদের মতে, এগুলো নিয়ম রক্ষার সভা, ফলপ্রসূ কিছু হয়নি।
একই সভায় চট্টগ্রাম নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সিটি করপোরেশনকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলা হয়। এ ছাড়া খালে ময়লা-আবর্জনা ও পলিথিন ফেলা বন্ধে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে এ বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। মাঝেমধ্যে পলিথিন ফেলা বন্ধ করতে লোকদেখানো কর্মসূচি পালন করা হয়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সভাগুলোতেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
গত বছরের ১৩ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে আরেকটি সভায় সাতটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে ছিল নগরের বারইপাড়া থেকে বলিরহাট পর্যন্ত তিন কিলোমিটার দীর্ঘ নতুন খাল প্রকল্প দ্রুত শেষ করা এবং প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন করা। বাস্তবে কোনো সিদ্ধান্তই কার্যকর হয়নি।
সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে ২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ সালের ১৪ জুন এবং গত বছরের ২২ জুন সভা হয়েছিল। এর মধ্যে শেষ সভায় জলাবদ্ধতার কারণ খুঁজে বের করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি জলাবদ্ধতার কারণ চিহ্নিত করে তা নিরসনে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ১৫টি সুপারিশ করেছিল। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ২১টি খাল নিয়ে দ্রুত প্রকল্প নেওয়া। এক বছর পার হলেও এগুলো কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি।
সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম দাবি করেছেন, সিডিএর প্রকল্পের বাইরে থাকা ২১টি খালের জন্য প্রকল্প নেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ রাশিদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন নিয়ে সভা হলেও সংস্থাগুলো সরকারি ‘প্রটোকল’–এর জন্য অংশ নেয়। নিজেদের মধ্যে দূরত্বের কারণে একের পর এক সমন্বয় সভায় অনেক সিদ্ধান্ত হলেও তা বাস্তবায়ন করার তাগিদ মনে করছে না সংস্থাগুলো। এই পরিস্থিতি নিরসনের জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে।