ইসরাইল-ইরান জটিলতা বাড়বে কি?

65

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

ইরান-ইসরাইল সংঘাতকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে রাজনৈতিক এবং সামারিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে বর্তমান পর্যায়ের সংঘাত শুরু হয় গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে। হামাস ও তাদের সহযোগী সংগঠনগুলো একযোগে ইসরাইলে আক্রমণ করে। ইসরাইলের পালটা প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ফিলিস্তিনের ওপর হামলা শুরু করে। ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় এ পর্যন্ত ১৬ হাজার শিশুসহ অন্তত ৩৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে যখন সংঘাত চলছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে ১ এপ্রিল দামাস্কাকে ইরানি দূতাবাসে ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালিয়ে আট ইরানি ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাসহ ১৬ জনকে হত্যা করে। এর আগেও ইসরাইল ছয় জন ইরানি বিজ্ঞানীক হত্যা করে।

ইতিপূর্বে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ইরান কোনো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করায় ইসরাইল হয়তো ভেবেছিল, ইরান তাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। এবারই প্রথম ইরান সরাসরি ইসরাইলের অভ্যন্তরে সুপরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত আক্রমণ পরিচালনা করে। ইরান প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইসরাইলে আক্রমণ করে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি দুর্ঘনাজনিত মৃত্যুপরিস্থিতি জটিলতর করে তুলতে পারে।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য-সংকট শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধকালের কিছু দিন পর থেকে। সুদূর অতীতে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এনে ফিলিস্তিনে জড়ো করা হয়। ব্রিটেন তাদের ভূতত্ত্ববিজ্ঞানীদের পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে জানতে পেরেছিল, ফিলিস্তিন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকসমূহে মাটির নিচে প্রচুর পরিমাণে জ্বালানি তেলের মজুত রয়েছে। ব্রিটেন ভেবেছিল, ইহুদিদের সহায়তা ছাড়া এই জ্বালানি তেলের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হবে না।

পরবর্তীকালে ইসরাইলকে শক্তিশালীকরণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি ইত্যাদি দেশ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করতে থাকে। বিশ্বের এসব পরাশক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ও ইন্ধনে ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্যে অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে পরিণত হয়। ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ডের সিনিয়র মন্ত্রী বেলফোর চুক্তি স্বাক্ষর করেন। গোপন চুক্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ইহুদিরা ব্রিটেনকে যুদ্ধে আর্থিক ও সামরিকভাবে সহায়তা করবে। এর বিনিময়ে ব্রিটেন ইহুদিদের জন্য প্যালেস্টাইনে একটি পৃথক রাষ্ট্র স্থাপন করে দেবে। ১৯১৫ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইহুদিদের মধ্যে আরো একটি চুক্তি হয়েছিল। যে চুক্তির মাধ্যমে এই তিন পক্ষ তুরস্কের ভূখণ্ড নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হয়।

ইসরাইল ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে নেয়। এরপর ১৯৭৩ সালে সংঘটিত যুদ্ধে আরবদের বিরুদ্ধে ইসরাইল জয়লাভ করে। যুদ্ধে জয়লাভের মাধ্যমের ইসরাইল ফিলিস্তিনের অধিকাংশ এলাকা জবরদখল করে নেয়। প্রতিটি যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলো অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে ইসরাইলকে সহযোগিতা করে। বর্তমানে প্যালেস্টাইন রাষ্ট্রের যে আয়তন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তা তাদের মূল ভূখণ্ডের সামান্য অংশ মাত্র।

ইরানের সঙ্গে একসময় ইসরাইলের সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। বিশেষ করে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সাধিত হওয়ার আগ পর্যন্ত রেজা শাহ পেহলভি ক্ষমতায় থাকাকালে ইরান ইসরাইলের প্রতি অনেকটাই সহানুভূতিসম্পন্ন ছিল। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে ইমাম খোমেনি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ করলে দেশটির সঙ্গে ইসরাইলের সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে। তবে আগে ইরান সামরিক শক্তিতে তুলনামূলক দুর্বল হওয়ার কারণে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়ার চেষ্টা করেনি। ইরান গত ২০ বছর ধরে গোপনে সামরিক শক্তি অর্জন করতে থাকে। ইরানের এই সামরিক শক্তি খর্ব করার জন্য ইসরাইল বিভিন্ন সময় নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। ১ এপ্রিল দামাস্কাকে ইরানি দূতাবাসে ইসরাইলি বাহিনী হামলা ইরানকে যারপর নাই ক্ষুব্ধ করেছে। এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান সরাসরি ইসরাইলে আক্রমণ পরিচালনা করে।

ইরান ও ইসরাইল কেউই চাইবে না প্রথাগত যুদ্ধ শুরু হোক। ইসরাইলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোও চাইবে না ইরান এবং ইসরাইল সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক। কারণ এতে বিশ্বঅর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখন দেখতে হবে সংঘাত কতটা বিস্তৃত হয়। যুদ্ধের ভয়াবহতা যদি বৃদ্ধি পায় এবং বেসামরিক স্থাপনা বা জনগণকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা হয়, তাহলে বিশ্বঅর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। খাদ্যপণ্যের মূল্যও বেড়ে যাবে। প্রথাগত যুদ্ধ শুরু হলে সমুদ্রপথে পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ হয়ে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়তে পারে। আর সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়লে বিশ্বব্যাপী খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাবে। যেমনটি হয়েছিল ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে প্রথাগত যুদ্ধ শুরু হলে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিতে পারে। সেই অবস্থায় বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের সরবরাহ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশ্লেষকগণ মনে করছেন, এই সংঘাতের জের অনেক দিন ধরেই বহন করতে হবে। করোনা উত্তর এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ চলমান থাকা অবস্থায় বিশ্ব-অর্থনীতি আরো একটি ভয়াবহ যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। বিশ্ব-অর্থনীতিতে ইরান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। তারা গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রপথ হরমুজ প্রণালি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। হরমুজ প্রণালি দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২ কোটি ব্যারেলের বেশি জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়। পুরো পৃথিবীর যে জ্বালানি তেল পরিবহন করা হয়, এটা তার এক-পঞ্চমাংশ। কাজেই এখানে কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টি হলে পুরো পৃথিবীর অর্থনীতিকে প্রভাবিত করবে, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে। জ্বালানি তেলের প্রবাহ কোনো কারণে বিঘ্নিত হলে তা পুরো বিশ্ব-অর্থনীতিকে ‘উলট-পালট’ করে দিতে পারে।

ইরান মূলত ইসরাইলকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই দেশটিতে আক্রমণ চালিয়েছে। তারা এখনো ইসরাইলের সঙ্গে প্রথাগত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার মতো অবস্থানে নেই। ইরান যদি সার্বিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো ইরানের ওপর ব্যাপকমাত্রায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। সেই সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ধকল সহ্য করা ইরানের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে। তাই ইরান ইসরাইলের সঙ্গে ১০ বছর ধরে প্রক্সি-যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। সামরিক ক্ষেত্রে ইরানের উত্থানের পেছনে ইরানি জেনারেল সুলাইমানির বিশেষ অবদান ছিল, যাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ অভিযানে হত্যা করেছে!

হিজবুল্লাহ, হামাস, হুতি এদের মাধ্যমেই ইরান ইসরাইলের বিরুদ্ধে সামরিক তত্পরতা চালিয়ে যাবে। ইরান যদি এই মুহূর্তে ইসরাইলের সঙ্গে সরাসরি প্রথাগত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে রাশিয়া প্রকাশ্যেই ইরানের পক্ষাবলম্বন করবে। উত্তর কোরিয়াও ইরানের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন দেবে। কিন্তু চীন ইরানের পক্ষে প্রকাশ্যে বাস্তবসম্মত সমর্থন দেবে। চীন ইরানকে সমর্থন দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় পড়া ঝুঁকি নেবে না। চীন বর্তমানে বিশ্ব-অর্থনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে। জাপানের ৪৪ বছরের আধিপত্য খর্ব করে চীন বিশ্ব-অর্থনীতিতে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। অর্থনীতিবিদগণ মনে করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে চীন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও অতিক্রম করে যেতে পারে। অন্যদিকে ইরানের সঙ্গেও চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। ইরানের কাছে থেকে চীন ২০ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় স্বল্পমূল্যে জ্বালানি তেল ক্রয় করছে।

ইরান সামরিক শক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যে শক্তিশালী অবস্থানে চলে যাচ্ছে। দেশটি পারমাণবিক শক্তি অর্জনের পথে রয়েছে। এই অবস্থায় তারা ইসরাইলের সঙ্গে প্রথাগত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে এটাও ঠিক যে, ইসরাইল যদি তাদের ওপর অধিকতর আক্রমণ পরিচালনা করে, তাহলে ইরান বিনা প্রতিবাদে ছেড়ে দেবে না। এবারের মধ্যপ্রাচ্য সংকট নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দিশগুলোতে যেভাবে প্রতিবাদ উত্থাপিত হয়েছে, অতীতে আর কখনোই এমনটি দেখা যায়নি। এমনকি ইসরাইলের ভেতরেও প্রতিবাদ হয়েছে। বিশেষ করে ইসরাইলের সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর হয়েছে। ছাত্রদের এই প্রতিবাদ কোনোভাবেই দেশগুলোর সরকার উপেক্ষা করতে পারবে না।

আমি আমার সামরিক জ্ঞান থেকে প্রায় নিশ্চিত করেই বলতে পারি, ইরান ও ইসরাইল কেউই সর্বাত্মক প্রথাগত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না। ইসরাইলের মুরুব্বিগণও চাইবে না, ইসরাইল এমন একটি যুদ্ধে যুক্ত হয়ে বিশ্বশান্তি ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করুক।

পূর্বের খবরটি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের কাছে প্রত্যাশা
পরবর্তি খবরশিল্পোৎপাদনে প্রবৃদ্ধি কমেছে