ঢাকাঃ দেশের আগামী নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা দূর অতীতে কদাচিৎ প্রত্যাশিত মানের হলেও নিকট অতীত কার্যত হতাশা জাগানিয়া। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আসন্ন নির্বাচনে পরিবর্তন আনতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি। তবে বিরুদ্ধমতও রয়েছে।
তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, সরকারি বিজ্ঞাপন পায় এরকম জাতীয় এবং আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা এখন ৫৭৬টি। সারা দেশে এমন সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক এবং ত্রৈমাসিক পত্রিকা আছে ১২৯টি। টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারে আছে ৩৯টি। আর তথ্য মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত অনলাইন নিউজ পোর্টাল মোট ১৮২টি।
১৭ কোটি মানুষের এই দেশে বাজার বিবেচনায় গণমাধ্যমের এই আকারকে অনেকেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মনে করেন। তারপরও নির্বাচনের আগে আরও কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হতে পারে বলে জানা গেছে। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের আবেদনও প্রক্রিয়াধীন আছে। নির্বাচনের আগে তারা অনুমোদন পাবে কিনা তা অবশ্য নিশ্চিত নয়। এছাড়া অনেক অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায়।
কিন্তু গণমাধ্যম অনেক বিস্তার লাভ করলেও তারা গণতন্ত্র, ভোটাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন, বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতায় কতটা ভূমিকা রাখছে? মোটা দাগে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়। তখন অবশ্য গণমাধ্যম এত বিস্তৃত ছিল না। অনলাইন তখনো আসেনি। আর টেলিভিশন বলতে একমাত্র বাংলাদেশ টেলিভিশন(বিটিভি)। সরকারের পক্ষে একপেশে প্রচারের কারণে তখন অবশ্য বিটিভিকে সাহেব-বিবি-গোলামের বাক্স বলা হতো। এখনো তার ‘চরিত্রে’ বিশেষ কোনো পরিবর্তন আসেনি। ওয়ান ইলেভেনের সময় সংবাদমাধ্যম যেমন বিরাজনীতিকরণের ভূমিকায় সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হয়ে কাজ করেছে, আবার গণতন্ত্র ও নির্বাচনের জন্য ভূমিকা রাখা গণমাধ্যমও ছিল অনেক। এরপর থেকে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বড় ধরনের বাঁক পরিবর্তনের কথা বলেন বিশ্লেষকরা।
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, ‘এরশাদের পতনের আগে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো চারদিন বন্ধ ছিল। এটা এরশাদের পতনকে ত্বরান্বিত করে। জিয়াউর রহমানের সময় সাংবাদিক সম্পাদকরা গ্রেপ্তার হলেও তারা সত্য প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখন গণমাধ্যমের প্যাটার্ন পরিবর্তন হয়ে গেছে।’
তার কথা, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে আগামী নির্বাচনে সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় গণমাধ্যমের ভূমিকা সুষ্ঠু ও অংশহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে দৃশ্যত তেমন কার্যকর ছিল না। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো অনেকটা বিটিভির মতো সরকারের প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। স্বাধীন সাংবাদিকতা সার্বিকভাবে চাপের মুখে আছে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি শওকত মাহমুদ মনে করেন, ‘গত এক যুগ ধরে গণমাধ্যম চাপে আছে। সরকারে দিক থেকে বাধা আছে, আবার মালিক পক্ষের দিক থেকেও বাধা আছে। মালিকরা তো পার্টিজান হয়ে গেছে। এখন সামনের ফ্রি-ফেয়ার নির্বাচনের জন্য মিডিয়ার যে ভূমিকা রাখা দরকার, তারা তা পারবে কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। ড. ইউনূসের বিপক্ষে যখন ৫০ জন সম্পাদক বিবৃতি দেয়, তখন বুঝতে হবে পরিস্থিতি কেমন।’
তার কথা, ‘মুক্ত সাংবাদিকতায় বাধা এরশাদের বা তার আগেও ছিল। কিন্তু তখন গণমাধ্যমের মুক্ত সাংবাদিকতার চেষ্টা ছিল। এখন চেষ্টাও নেই। এর সঙ্গে নানা আইন তো আছেই। সম্পাদকরা এখন রাজনীতিবিদ হয়ে গেছেন।’
তবে মার্কিন ভিসা নীতির কারণে কিছুটা ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে তিনি মনে করেন।
বাংলাদেশে গণমাধ্যম সংখ্যায় এবং আকারে বড় হলেও তাদের প্রো-পিপল ভূমিকা কমে গেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক খান। বেসরকারি টেলিভিশনগুলো সরকারি প্রচারযন্ত্রে পরিণত হয়েছে। আর দুই-একটি ব্যতিক্রম বাদে পত্রিকাগুলোও একই ভূমিকা রাখছে বলে তিনি মনে করেন। তার কথা, ‘সাংবাদিকরাও এখন আর ভালো প্রতিবেদন না করে কেউ কেউ যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থ আয়কেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। বেতনের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের বিলাসী জীবন দেখলেই বোঝা যায় সাংবাদিকতা কোন দিকে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘জিয়া থেকে এরশাদের সময় সাংবাদিকরা চেষ্টা করেছেন বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরতে। কিন্তু এখন আর সেরকম হয় না। গত দুইটি নির্বাচন নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবল নয়। সামনের নির্বাচনেও এর পরিবর্তন হবে বলে আমার মনে হয় না।’
‘মার্কিন ভিসা নীতিও গণমাধ্যমকে বদলাতে পারবে না। কারণ, যারা গণমাধ্যমকে এই অবস্থায় নিয়ে এসেছেন, তারা অ্যামেরিকায় যাবেন না। তাদের সেই প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না,’ বলেন এই অধ্যাপক।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে মাগুরার উপ-নির্বাচন, এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগের আন্দোলন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং ২০০৬ রাষ্ট্রপতি সালে ইয়াজ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এই বিষয়গুলো নিয়ে বেসরকারি গণমাধ্যম সঠিক ভূমিকাই রেখেছিল। কিন্তু ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন নিয়ে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা সেরকম নয়।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক খান মনে করেন, ‘কর্পোরেট মিডিয়ার এখন নানা স্বার্থ। আর সেটা সরকারের সঙ্গে যুক্ত। ফলে গণমাধ্যম এখন আর আগের ভূমিকায় নেই। সামনেও এর পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না।’
বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এখন রাজনৈতিকভাবেও বিভক্ত। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থক, নেতা। শ্যামল দত্ত বলেন, ‘রাজনৈতিক আদর্শ গণমাধ্যমের থাকতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও আছে। সেখানেও গণমাধ্যম এখন কর্পোরেটদের দখলে। কিন্তু তারপরও সংবাদ পরিবেশনে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হয়।’
শওকত মাহমুদ বলেন, ‘রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকা এক জিনিস আর বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ খবর পরিবেশন আরেক জিনিস। এটা আমরা আগে ফলো করেছি। রাজনীতির জায়গায় রাজনীতি এবং সাংবাদিকতার জায়গায় সাংবাদিকতা রেখেছি। কিন্তু এখন একাকার হয়ে গেছে।’
বাংলাদেশে একসময় দলীয় সংবাদপত্র ছিল। বাংলার বাণী ও দিনকাল তার বড় উদাহরণ। কিন্তু এখন সেই অর্থে সরাসরি দলীয় মালিকানায় সংবাদমাধ্যম নেই। তারপরও কেন এই অবস্থা? আর্টিক্যাল নাইনটিনের দক্ষিণ এশিয়ার সাবেক প্রধান ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘এখন ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। নিজেদের লোকদের সংবাদমাধ্যম, পত্রিকা, টেলিভিশনের লাইসেন্স দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনার জন্য আলাদা ব্যবসাও দেয়া হয়। দলের মালিকানায় সংবাদমাধ্যম থাকার চেয়ে সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণে এই পদ্ধতি কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে এই সময়ে। এর বাইরেও আছে সরকারি বিজ্ঞাপনের ভাগ বাটোয়ারার বিষয়। আছে নানা কৌশলে চাপ।’
ফারুক ফয়সাল বলেন, ‘এরসঙ্গে এখন সম্পাদকরা সুবিধা নেওয়ার চিন্তায় থাকেন। জিয়া এরশাদের আমলে এরকম সুবিধাদি অনেক কম ছিল। ফলে সাংবাদিকদের মধ্যে চেষ্টা ছিল স্বাধীন সাংবাকিতার। এখন সেটাও নেই।’
‘আমি সামনে ভালো কিছু দেখছি না। নির্বাচন নিয়ে আমার সংশয় আছে। মার্কিন ভিসা নীতিতে সাংবাদিকদের কেউ কেউ ভয় পেতে পারেন। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গণমাধ্যম তেমন কাজ করবে বলে মনে হয় না।’