আমেরিকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুললেন শেখ হাসিনা

116

ঢাকাঃ শেখ হাসিনা বলেন, আমেরিকা আমাদের গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশে গণতন্ত্র চর্চার অবস্থা কী? আটলান্টিক পার হলেই কি তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে যায়?

গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুকে কেন্দ্র করে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগপূর্ণ প্রতিবেদন, বক্তব্য ও বিবৃতি প্রত্যাখ্যান করে প্রতিক্রিয়া জানালেও এবার যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষোভ ঝাড়লেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কথায় কথায় আমাদের গণতন্ত্রের সবক দেয়, মানবাধিকারের কথা বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোথায় তাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার? তাদের দেশে গণতন্ত্র চর্চার অবস্থা কী? আটলান্টিক পার হলেই কি তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পাল্টে যায়?’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তারা আমাদেরকে এখন গণতন্ত্রের জ্ঞান দিচ্ছে। কথায় কথায় ডেমোক্রেসি আর হিউম্যান রাইটসের কথা বলছে। তাদের দেশের অবস্থাটা কী? কয়েকদিন আগের কথা, আমেরিকার টেনেসিস রাজ্যে তিন জন কংগ্রেস ম্যান – এই তিন জনের অপরাধ হচ্ছে, তাঁরা অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের জন্য আবেদন করেছিলেন। তারা ডেমোনেস্ট্রেশন দিয়েছিলেন যে, এভাবে যার তার হাতে অস্ত্র থাকা, আর এভাবে গুলি করে শিশুহত্যা বন্ধ করতে হবে। এটাই ছিল তাদের অপরাধ। আর এই অপরাধে দুই জনকে কংগ্রেস থেকে এক্সপেলড করা হয়। জাস্টিস জন ও জাস্টিস পিয়ারসন। একজন সাদা চামড়া ছিল বলে বেঁচে যান। তাদের অপরাধ হলো তারা কালো চামড়া। সেই কারণে তাদের সিট আনসিট হয়ে যায়। তো এখানে মানবাধিকার কোথায়? এখানে গণতন্ত্র কোথায়? এটা আমরা প্রশ্ন।’

শেখ হাসিনা আরও বলেন, ‘আমেরিকায় প্রায় প্রতিদিনই দেখা যায়, অস্ত্র নিয়ে স্কুলে ঢুকে যায়। বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করছে। শিক্ষকদের হত্যা করছে। শপিং মলে ঢুকে যাচ্ছে। হত্যা করছে। ক্লাবে যাচ্ছে, সেখানে হত্যা করছে। এটা প্রতিনিয়ত, প্রতি দিনেরই ব্যাপার। কোনও না কোনও রাজ্যে অনবরত এই ঘটনা ঘটছে।’

সোমবার (১০ এপ্রিল) বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আনা ১৪৭ বিধির সাধারণ প্রস্তাব ও অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

এ সময় যুক্তরাষ্ট্র সফরে একটি বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমেরিকায় যখন প্রথমবার যাই, সেখানকার আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে আমার মিটিং হয়েছিল। বলেছিলাম, আমি একটি মনুমেন্ট দেখে এসেছি। সেখানে লেখা আছে- গভর্নমেন্ট অব দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল। আমি এমন একটি দেশ থেকে এসেছি, সে দেশটি হচ্ছে গভর্নমেন্ট অব দ্য আর্মি, বাই দ্য আর্মি, ফর দ্য জেনারেল। বলেছিলাম, আমেরিকা গণতন্ত্র চর্চা করে তাদের আটলান্টিকের পাড় পর্যন্ত। এটা যখন পার হয়ে যায়, তখন কি আপনাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটা বদলে যায়?কেন আপনারা একটা মিলিটারি ডিকটেরকে সমর্থন দিচ্ছেন? আমি এই প্রশ্নটি করেছিলাম।’

বিভিন্ন দেশের বিষয়ে বর্তমানে মার্কিন অবস্থানের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকেও আমি বলি, যে দেশটা আমাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের সবক দেয়। আর আমাদের বিরোধী দল থেকে শুরু করে কিছু কিছু লোক তাদের কথায় খুব নাচন-কোদন করছেন, উঠবস করছেন, উৎফুল্ল হচ্ছেন। হ্যাঁ, তারা যেকোনও দেশের ক্ষমতা ওল্টাতে পারেন, পাল্টাতে পারেন। বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলো তো আরও বেশি কঠিন অবস্থার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। আরব স্প্রিং (আরব বসন্ত), ডেমোক্রেসি সব বলে বলে যেসব ঘটনা ঘটাতে ঘটাতে এখন নিজেরা নিজেদের মধ্যে একটা প্যাঁচে পড়ে গেছে। যতদিন ইসলামিক কান্ট্রিগুলোর ওপর চলছিল, ততদিন কিছু হয়নি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরে এখন সারা বিশ্বই আজকে অর্থনতিক মন্দার কবলে পড়ে গেছে। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরকে ‘ভণ্ডদের আখড়া’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্য-প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়।

গত ৮ এপ্রিল ফেইসবুকে নিজের ভেরিফায়েড পেইজে একটি পোস্ট দেন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করা জয়। এতে দুই মার্কিন আইনপ্রণেতার টেনেসির প্রতিনিধি পরিষদ থেকে বহিষ্কার সংক্রান্ত বিবিসি’র এক প্রতিবেদন শেয়ার করে তার ক্যাপশনে জয় লেখেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের আইনসভা একজন শ্বেতাঙ্গকে বাদ দিয়ে দুই সংখ্যালঘু কৃষ্ণাঙ্গ আইনপ্রণেতাকে বহিষ্কার করার পক্ষে ভোট দিয়েছে। এই হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের অবস্থা। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট একগুচ্ছ ভণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়।’

কেবল বাংলাদেশ সরকারের প্রধানই নয় এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। গত ২৯ মার্চ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাকিদকের প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র নিয়ে সমস্যা রয়েছে। দেশটির গণতন্ত্র দুর্বল।’

যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য বাংলাদেশের অন্যের কাছ থেকে সবক নিতে হবে না। কারণ, আমরাই একমাত্র দেশ যারা গণতন্ত্রের জন্য, ন্যায় বিচারের জন্য মানবিকতার জন্যে ৩০ লাখ লোক প্রাণ দিয়েছি। এটা অনেকে ভুলে যান, অন্য কেউ এত প্রাণ দেয় নাই।’

এদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশে সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

গত ২২ মার্চ সচিবালয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিবেদন সেই প্রতিবেদনটি আসলে একপেশে এবং পক্ষপাতদুষ্ট সূত্র থেকে তারা তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছে। তারা সরকারবিরোধী বিভিন্ন এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছে। সুতরাং সেই প্রতিবেদনটা একপেশে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যে কথা সেটি হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন নিয়েওতো অনেক প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করার আগে এবং প্রশ্ন তোলার আগে তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে যে প্রশ্নগুলো আছে বা তাদের নির্বাচন হওয়ার পর ক্যাপিটাল হিলে যে হামলা হয়েছিল সেই বিষয়গুলোর দিকে তাদের তাকানো প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।’

পূর্বের খবরজাপান যেভাবে সেভেন সিস্টার্স ও বাংলাদেশের মধ্যে সেতু গড়ছে
পরবর্তি খবরডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কেবল নাম পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে প্রতারণা