লোকে লোকারণ্য ইজতেমার ময়দান। একটি ছোট এলাকায় লাখ লাখ মানুষ চলছে জিকির ফিকিরে। সবার মুখে একই কথা, ‘ডানে চলি, জিকিরে ফিকিরে চলি। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার।’ এই মুহূর্তে জিকিরে ফিকিরে প্রকম্পিত টঙ্গীর তুরাগ তীর।
লাখো মুসল্লির জিকিরে প্রকম্পিত তুরাগ তীর
রোড ডিভাইডারের উপর তাবু টাঙানো ঢাকার ধামরাইয়ের শাহজাহান বলেন, ‘জায়গা নেই। রাস্তার মাঝে তাবু করলাম। মোনাজাতের পর চলে যাব।’ একই এলাকার মতিয়ার রহমানও একই কথা বলেছেন। সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুরের বাসিন্দা আবু বকর বলেছেন, ‘জায়গার ব্যবস্থা করা দরকার। এই ভাবে হয় না।’
এদিকে আজ বিকেলে গাজীপুর মহানগর পুলিশ বিশ্ব ইজতেমার চারপাশে আজ রাত ১২ টা থেকে গণপরিবহন বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছে। পুলিশ কমিশনার মাহবুব আলম বলেছেন, আজ শনিবার রাত ১২টা থেকে টঙ্গী-কামারপাড়া রোড, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী থেকে গাজীপুরের ভোগরা বাইপাস পর্যন্ত এবং আবদুল্লাহপুর থেকে আশুলিয়ার বাইপাইল পর্যন্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া ময়মনসিংহ ও গাজীপুরগামী যানবাহনগুলোকে গাবতলী দিয়ে কোনাবাড়ি হয়ে এবং ময়মনসিংহ থেকে ঢাকাগামী যানবাহনগুলোকে ভোগরা বাইপাস দিয়ে ৩শ’ ফিট রাস্তা ব্যবহার করে চলাচল করতে বলা হয়েছে। এসময় এসব সড়ক হয়ে কোনো পণ্যবাহী গাড়ি যান চলতে দেওয়া হবে না। তবে ইজতেমা সংশ্লিষ্ট সব ধরনের যান চলাচল স্বাভাবিক থাকবে।
তিনি আরো বলেন, ইজতেমার মুরুব্বীদের সাথে কথা হয়েছে। তারা বলেছেন, কাল রবিবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সকাল ৯টা থেকে সাড়ে নয়টা মধ্যে আখেরি মোনাজাত করবেন। এর আগে সারা দিন ঈমান ও আমলবিষয়ক বয়ানের পর লাখো মুসল্লির অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে বিশ্ব ইজতেমা ময়দানে গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত হলো প্রথম পর্বের বৃহত্তম জুমার নামাজ।
দিনভর বয়ান
গতকাল ফজরের নামাজের পর আম (সার্বিক) বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাবলিগ জামাতের ৫৭তম বিশ্ব ইজতেমা। শুরুতে ঈমান, আমল, আখলাক, দাওয়াত ও তাবলিগ সম্পর্কে বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা আহমদ বাটলা। তাঁর উর্দু ভাষার বয়ান বাংলায় তরজমা করে শোনান বাংলাদেশের মাওলানা নুরুর রহমান।
স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উদ্দেশে বয়ান করেন ভারতের আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. সানাউল্লাহ। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বয়ান করেন পাকিস্তানের রাইবেন্ডের ডা. মো. নওশাদ এবং খাস বা বিশেষ ব্যক্তিদের জন্য বয়ান করেন ভারতের দিল্লির মাওলানা আকবর শরীফ।
আয়োজকরা জানান, ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলিগ মারকাজের শুরা সদস্যরা ও মুরব্বিরা বয়ান পেশ করছেন। উর্দুতে বয়ান হলেও বাংলা, ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসি ভাষায় তাত্ক্ষণিক অনুবাদ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ভাষাভাষীর মুসল্লিরা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন মুরব্বি মূল বয়ানকে তাত্ক্ষণিক অনুবাদ করে শোনান।
নানা অব্যবস্থাপনা
পুলিশ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সড়ক-মহাসড়কগুলো যানজট ও হকারমুক্ত রাখার ঘোষণা দেওয়া হলেও দেখা গেছে উল্টো চিত্র। গতকাল সকাল থেকেই ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের গাজীপুরা থেকে আবদুল্লাহপুর, আবদুল্লাহপুর থেকে কামারপাড়া, টঙ্গীর স্টেশন রোড থেকে নিমতলী পর্যন্ত ছিল তীব্র যানজট। মুসল্লিদের যত্রতত্র পারাপার, যানবাহনের ইচ্ছামাফিক পার্কিং, সড়কে জনস্রোত প্রভৃতি কারণে যানজট লেগে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। ফুটপাতগুলোতে ছিল হকারদের দৌরাত্ম্য। অস্থায়ী হোটেলগুলোতে খাবারের মান খারাপ ছিল, দাম ছিল কয়েক গুণ বেশি। এসব বিষয়ে প্রশাসনের কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি বলে জানান রংপুর থেকে আসা মুসল্লি বিল্লাল হোসেন (৭০)।
মুসল্লিদের স্বাস্থ্যসেবা
টঙ্গী শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে শুক্রবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত শতাধিক মুসল্লি চিকিত্সা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে বেশির ভাগই ঠাণ্ডা, সর্দিকাশি, শ্বাসকষ্ট, পেটের পীড়ার চিকিত্সা নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই হাসপাতালের আবাসিক চিকিত্সক ডা. তারিক হাসান। এ ছাড়া ইজতেমাস্থলের পার্শ্ববর্তী ফ্রি-মেডিক্যাল ক্যাম্পগুলোতে কয়েক হাজার মুসল্লি বিনা মূল্যে ওষুধ সংগ্রহ ও প্রাথমিক চিকিত্সা নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে টঙ্গী ওষুধ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতি ৩০০, হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ প্রায় দুই হাজার, ইবনে সিনার উদ্যোগে প্রায় ৬০০ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
বাসচাপায় পুলিশ সদস্য নিহত
বিশ্ব ইজতেমায় দায়িত্ব পালন করতে আসার পথে বাসের ধাক্কায় পুলিশের এক এএসআই নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন এক এসআই। শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের থানার মিলগেট এলাকায় ওই দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত হাসানুজ্জামান মানিকগঞ্জ জেলা আদালতে কর্মরত ছিলেন। আহত পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) আমির হামজা মানিকগঞ্জ জেলার পুলিশ কন্ট্রোলরুমে কর্মরত।
পুলিশ জানায়, ইজতেমা মাঠের কাছে মিলগেট এলাকায় বলাকা পরিবহনের একটি বাস দুই পুলিশ সদস্যকে বহনকারী মোটরসাইকেলকে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়েন তাঁরা। টঙ্গী থানা পুলিশ প্রথমে তাঁদের উদ্ধার করে টঙ্গী হাসপাতালে পরে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিত্সাধীন অবস্থায় এএসআই হাসান মারা যান।
আগামীকাল রবিবার আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে প্রথম পর্বের সমাপ্তি হবে। আগামী ৯ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা শুরু হয়ে আখেরি মোনাজাত হবে ১১ ফেব্রুয়ারি।