নিউজ২১ডেস্কঃ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আজ রবিবার (১০ ডিসেম্বর)। ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র গ্রহণ করে। এ ঘোষণার মাধ্যমে স্বীকৃত হয় মানবাধিকার সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। জন্মস্থান, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, অর্থনৈতিক অবস্থা কিংবা শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্বিশেষে মানবাধিকার সর্বজনীন ও সবার জন্য সমান। প্রতিটি মানুষ জন্মগতভাবেই এসব অধিকার লাভ করে। ঘোষণাপত্রের ৩০ অনুচ্ছেদে প্রতিটি ব্যক্তির অধিকার ও রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের বিষয়টি সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ঘোষণাপত্র গ্রহণের দিনটি প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এবছর এ দিবসটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘সবার জন্য মর্যাদা, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার’। দিবসটিতে দেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মানববন্ধন ও আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি পালন করবে।
মরমি কবি লালন সাঁইয়ের অন্তর্দৃষ্টি, ‘অনন্ত রূপ সৃষ্টি করিলেন সাঁই, শুনি মানব রূপের উত্তম কিছু নাই’। তাহা হইলে এই উত্তম রূপ মানবই আরেক মানবকে অধিকারবঞ্চিত করিতে পারে কী প্রকারে? গৃহকোণ হইতে রাষ্ট্রীয় আওতা পর্যন্ত পদে পদে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় কী করিয়া? ‘জীবনের একমাত্র অর্থ মানবতার সেবা করা’—লিও তলস্তয়ের এই আহ্বানের সদুত্তরেই-বা আমরা কী বলিতে পারি? সত্যি বলিতে, বর্তমান বিশ্বে আইনের শাসনের ব্যত্যয়ই অধিক লক্ষণীয়, যাহা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের জন্য অধিক দায়ী। বিশ্বব্যবস্থার এক ক্রান্তিলগ্নে ও বিশৃঙ্খল মুহূর্তে সমগ্র পৃথিবী কেমন যেন অমানবিক হইয়া গিয়াছে! ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধের মধ্যেও ফিলিস্তিনের গাজায় মানবতার কবর রচিত হইতে দেখিতেছি আমরা। সংঘাত-সংকট চলিতেছে বিশ্বের আরো অনেক প্রান্তে। যুগ যুগ ধরিয়া চলিয়া আসা এই সকল সংকটের যেন কোনো সুরাহা নাই! এই ব্যর্থতার দায় কাহার? যুদ্ধবিগ্রহের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ও বাস্তুচ্যুত হইবার ঘটনার মধ্য দিয়া বারংবার মানবতার পরাজয় ঘটিতেছে—ইহারই-বা শেষ কোথায়?
অর্থাত্, যত কথাই বলা হউক, প্রকৃত অর্থে এখনো প্রতিষ্ঠিত হয় নাই মানবাধিকার। বিশেষত উন্নয়নশীল দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি খুব একটা সুখকর নহে। এই সকল দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি সকল সময়ই উদ্বেগজনক। এই সকল জনপদে রাজনৈতিক সন্ত্রাস অব্যাহত রহিয়াছে অদ্যাবধি, যাহা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। উপরন্তু, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানমূলক পরিবেশ বিদ্যমান থাকে না।
দালাই লামার ভাষায়, ‘বিশ্ব এই নেতার, সেই নেতার কিংবা সেই রাজা বা রাজপুত্র বা কোনো ধর্মীয় নেতার নয়; বরং পৃথিবী হইল একমাত্র মানবতার।’ ইহাই আসল কথা। মানুষ জন্মগ্রহণই করে মানবাধিকারের পতাকা হাতে লইয়া। সেইখানে একজন আরেকজনকে অধিকারবঞ্চিত করিবার সুযোগ পাইবে কেন? এই ক্ষেত্রে দোষ তো আমাদেরই। কারণ, ধরণিবক্ষে সীমানা তুলিয়া বিভেদের দেওয়াল গড়িয়াছি আমরাই। অঞ্চলের গণ্ডিতে ভূপ্রকৃতিকে আটকাইয়া হানাহানি, সংঘর্ষ শুরু করিয়াছি আমরাই। ইহার ফলে যে মানুষের জন্মগত অধিকার মাটির সহিত মিশিয়া যাইতেছে; অন্যায়, পাপ হইতেছে, তাহার প্রতি যেন ভ্রুক্ষেপই নাই।
মানবাধিকারের কথা বলিতে গেলে ১২১৫ সালে সম্পাদিত ম্যাগনাকার্টা, সপ্তদশ শতকে স্বাক্ষরিত পিটিশন অব রাইটস, বিল অব রাইটস, খিষ্ট্রপূর্বাব্দকালের প্রথম মানবাধিকার সনদ সাইরাস সিলিন্ডার প্রভৃতি প্রসঙ্গ সামনে আসিবে। মানবাধিকারের প্রকৃত ভিত্তি হিসাবে ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মহানবি (স.) কর্তৃক মদিনা সনদ ঘোষণাও অগ্রগণ্য, যাহাকে আখ্যায়িত করা হয় পৃথিবীর প্রথম পূর্ণাঙ্গ লিখিত সংবিধান হিসাবে। উপরন্তু, মহানবি (স.) বিদায় হজের ভাষণে মানবাধিকারের কথা সংক্ষিপ্ত অথচ স্পষ্ট করিয়া বলিয়া গিয়াছেন। সর্বোপরি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও ভাষানির্বিশেষে সকল মানুষের স্বাধীনতাকে সমুন্নত করিবার কথা বলিয়াছেন স্বয়ং মহান আল্লাহ তাআলা—‘তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসাবে বাছাই করা হইয়াছে, মানবের কল্যাণের জন্য’ (সুরা আল-ইমরান : ১১০)। সুতরাং, মানুষের মৌলিক মানবাধিকার ও অধিকারগুলি বাস্তবায়ন করিবার ক্ষেত্রে সকলকে বদ্ধপরিকর থাকিতে হইবে।