আওয়ামী লীগের অনেক এমপির বিরুদ্ধে কেন দলের মধ্যেই ক্ষোভ

193
ঢাকাঃ বাংলাদেশের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সারাদেশে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপিদের অনেকে এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন দলের ভেতর থেকেই। এমনকি অনেক জায়গায় এমপিদের কর্মকাণ্ডের প্রকাশ্যেই সমালোচনা করছেন দলের স্থানীয় নেতাদের অনেকে, যাদের মধ্যে মনোনয়ন প্রত্যাশীরাও আছেন।

দলীয় নেতাদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে যেসব এলাকায় এমপি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেয়র – তিনজনই আগামী নির্বাচনের জন্য দলের মনোনয়ন চান তেমন অনেক এলাকাতেই এমপিদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে যাচ্ছেন বাকীরা।

অন্যদিকে কিছু এলাকায় এমপিরা বিরোধে জড়িয়ে পড়েছেন দলের জেলা ও নিজ উপজেলার নেতাদের সাথে এবং এসব ক্ষেত্রেই এমপিদের সমালোচনা করে বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছেন স্থানীয়রা।

এমপিদের ঘিরে এই ক্ষোভ-বিক্ষোভ ও অসন্তোষের তথ্য উঠে এসেছে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কাছেও।

সম্প্রতি দলের যে বর্ধিত সভা হয়েছে সেখানেও মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে মনোনয়নের ক্ষেত্রে তাদেরকেও বিবেচনায় নেয়ার অনুরোধ করেছেন দলীয় প্রধানের কাছে।

তবে কিছু কিছু এলাকায় এমপিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বিক্ষোভ এমন মাত্রায় গেছে যে তা নিয়ে রীতিমত উদ্বিগ্ন হলের শীর্ষ নেতারা। শনিবার দলের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় শেখ হাসিনা নিজেই এ বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

তিনি দলের সভাগুলোতে ‘কখনো শক্ত ভাষায় আবার কখনো নরম কণ্ঠে’ ‘মনোনয়ন যুদ্ধে অবতীর্ণ’ নেতাদের সংযত হবার বার্তা দিচ্ছেন। আর দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে এমপিদের নিয়ে বিষোদগার না করার জন্য স্পষ্ট করেই নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি।

অবশ্য তিনি দলের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের আশ্বস্তও করেছেন এই বলে যে দুঃসময়ে যারা কাজ করবেন এবং যাদের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতার তথ্য জরিপে উঠে আসবে – তারাই দলের মনোনয়ন পাবেন।

দলের অভ্যন্তরে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধের আহবান জানিয়ে তিনি বলেছেন দলের নেতাদের কেউ একে অপরের বিরুদ্ধে কুৎসা রটালে দলের মনোনয়ন ও পদ সবই হারাতে হবে।

ঢাকায় সংঘর্ষের দৃশ্য
নির্বাচন নিয়ে প্রধান দলগুলোর মধ্যে বিরোধ এখনো কাটেনি।

দলের নেতারা অবশ্য বলছেন নির্বাচন আসলে মনোনয়নের জন্য চেষ্টা অনেকে করবে এটাকে স্বাভাবিক বলেই মনে করেন তারা।

যেহেতু বেশিরভাগ এলাকাতে আওয়ামী লীগেরই এমপি – তাই তাদের পক্ষে-বিপক্ষেই আলোচনা-সমালোচনা হবে, এটাকে স্বাভাবিক বলেই বলছেন তারা। কিন্তু দলের মধ্যে এ নিয়ে উদ্বেগ তৈরির কারণ হলো এমপিদের ঘিরে বিরোধের ইস্যুটি এখন দলের বাইরে চলে আসছে।

তবে এ বিষয়ে দল বা সভানেত্রীর অবস্থান কি সেটি এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে বলে মনে করেন দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম।

“নেত্রী সবাইকে সহনশীল হবার জন্য বলেছেন। যাতে করে কোথাও কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা যেন না হয়। মনোনয়ন নিয়ে নীতি কি হবে সেটিও তিনি পরিষ্কার করেছেন। বলে দিয়েছেন যে জরিপে যাকে যেখানে জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য মনে হবে তিনিই মনোনয়ন পাবেন,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

দলের একাধিক নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ‘জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি’দের মনোনয়নের যে কথা বলেছেন – তার মাধ্যমে মূলত তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে যেসব এমপি এলাকায় জনপ্রিয়তা হারিয়েছে তাদের এবার মনোনয়ন পাওয়ার সুযোগ নেই।

সম্প্রতি কুষ্টিয়ার একজন এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতার মধ্যকার প্রকাশ্য পাল্টাপাল্টি বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়েছে।

ঢাকার একজন এমপি ও তার এলাকার আরেকজন মনোনয়ন প্রত্যাশীর সমর্থকদের মধ্যে বিরোধে আওয়ামী লীগের সমাবেশে এসে ফেরার পথে খুন হয়েছেন এক ব্যক্তি।

গণভবনে বর্ধিত সভায় একজন এমপির বিরুদ্ধে জেলা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ার অভিযোগ করেছেন উত্তরাঞ্চলীয় একটি জেলার একজন শীর্ষ নেতা।

ওই সভাতেই কুমিল্লার এক নেতা তার জেলার পাঁচজন এমপির কর্মকাণ্ড ও অবস্থানের খোঁজ নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করেছেন।

নোয়াখালী ও হবিগঞ্জের দুজন নেতা মনোনয়নের ক্ষেত্রে এখনকার এমপিদের বদলে তাদের বিবেচনার জন্য দলীয় প্রধানের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।

আবার বগুড়ার একজন নেতা দলের অরাজনৈতিক এমপিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রমে মদদ দেয়ার অভিযোগ করেছেন।

দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলার আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বিবিসি বাংলাকে বলেনে, “আমাদের জেলায় চার এমপির সবাই চরম বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন। এজন্যই ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট দরকার”।

শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের
শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদের

এমন পরিস্থিতি সামাল দিতেই মূলত এমপিদের বিষোদগার না করার জন্য দলীয় নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি “এ ধরণের কর্মকাণ্ডে যারা জড়িত হবে তারা মনোনয়নও পাবে না, দলীয় পদও পাবে না” বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তিনি।

জানা গেছে গত ছয় অগাস্ট ঢাকায় গণভবনে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সময় সারাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের যে ৩৯জন নেতা বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পেয়েছেন তাদের বক্তৃতাদেরও প্রাধান্য পেয়েছে নির্বাচন ও মনোনয়ন।

এসব বক্তৃতা থেকেও মাঠ পর্যায়ে বর্তমান এমপিদের সাথে অন্য মনোনয়ন প্রত্যাশীদের বিরোধ পরিষ্কারভাবেই প্রকাশ পেয়েছে।

বাহাউদ্দিন নাছিম অবশ্য বলছেন তৃণমূল নেতারা অনুরোধ করেছেন যাতে ‘জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্য ধরে রাখতে যারা ব্যর্থ হয়েছে’ তাদের যেন বিবেচনা না করা হয় এবং দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাও তার বক্তব্যে সেটিই উল্লেখ করেছেন।

“তৃণমূল নেতাদের বক্তব্যই প্রকাশ পেয়েছে সভানেত্রীর বক্তব্যে। তিনি তার বার্তা দিয়ে দিয়েছেন এবং আশা করি নির্বাচন আসতে আসতে এসব নিয়ে কোথাও টুকটাক ঝামেলা থাকলেও কেটে যাবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

এর বাইরেও বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় এমপি ও স্থানীয় নেতাদের বিরোধের খবর প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমে আসছে। ফলে এমপিদের তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য আসছে প্রকাশ্যেই।

আওয়ামী লীগের মিছিল।
নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়েছে আওয়ামী লীগে।

দলের মধ্যেকার বিরোধ নিরসন করে দলকে চাঙ্গা করতে নানা উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।

আগামী দু মাসে দেশজুড়ে বিভাগগুলোতে সমাবেশে অংশ নেবেন শেখ হাসিনা নিজেই। পাশাপাশি প্রতিটি এলাকাতেই শুরু হয়েছে প্রচার প্রচারণা।

তবে আবার অনেক জায়গায় দলীয় এই প্রচার প্রচারণাতেও ছাপ ফেলেছে মনোনয়ন প্রত্যাশী নেতাদের বিরোধ।

এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনকালীন পরিস্থিতি কেমন হয় তা নিয়ে দলের ভেতরে উদ্বেগ আছে। বিশেষ করে নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত বিএনপি এলে কারা প্রার্থী হবে কিংবা না এলে কারা প্রার্থী হবে- এমন নানা ধরণের আলোচনা বেশ গতি পেয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে।

দলটির বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলছেন, দলের মধ্যে এমপি হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা নেতিবাচক কিছু নয়।

“পার্টির মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে । কিন্তু কোথাও কোথাও সেটা সংঘর্ষে রূপ নেয় কি-না সেটাই আশঙ্কার জায়গা। সে কারণেই দলের নেতারা বিষয়টি আলোচনায় এনেছেন এবং সভানেত্রীও কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। তবে দেখবেন নির্বাচন এসে গেলে এ সমস্যা থাকবে না। তখন সবাই দলের প্রার্থীকে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়বে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।

ওদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে ঢাকা মহানগরীসহ যেসব জায়গায় দলের হালনাগাদ কমিটি নেই সেসব জায়গায় দ্রুত কমিটি করার নির্দেশনা দিয়েছেন শেখ হাসিনা।

দলের নেতারা অবশ্য বলছেন এসব কমিটি করতে গিয়ে দলের জন্য কখনো পরিস্থিতি চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ালে সেই পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো দক্ষতা সম্পন্ন নেতাদের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

মূলত কোনো কারণে বিএনপির নেতৃত্বাধীন বিরোধী দল নির্বাচনে না আসলেও যাতে করে রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করা যায় – সেই চিন্তা থেকেই এটি করা হচ্ছে বলে ধারণা দিয়েছেন তারা।

বিএনপি আগেই বলেছে যে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন তারা হতে দেবে না।

পূর্বের খবরভোগের প্রচ্ছদে ৯০ দশকের চার সুপারমডেল
পরবর্তি খবরফেসবুকে হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশি ব্যবসায়িক গ্রুপ?