আইনন্ত্রীর কথায় আমাদের লজ্জা আর ঘৃণা আসে: রোমান
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি তাদের ঢাকার পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হয়। ওই ঘটনার সময় তাদের সঙ্গে শিশু পুত্র মেঘও ওই বাসায় ছিল । মামলায় এ পর্যন্ত তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন হয়েছে তিনবার। আদালতের নির্দেশে এখন মামলাটি তদন্ত করছে র্যাব। তারা ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল তদন্তের দায়িত্ব পায়।গত এক যুগে র্যাব এই মামলার তদন্তের কোনো অগ্রগতির খবর দিতে পারেনি। এ পর্যন্ত তারা ১০৭ বার সময় নিয়েছে। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি অ্যাডভোকেট আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “তারা শুধু সময়ই নিচ্ছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত আদালতে তদন্তের কোনো অগ্রগতির প্রতিবেদন দেয়নি।”
আর আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, “সাগর-রুনির হত্যার ঘটনায় সঠিকভাবে দোষী নির্ণয়ে তদন্তের জন্য প্রয়োজনে ৫০ বছর সময় দিতে হবে।” তবে এক দিন পর বুধবার তিনি বলেছেন তার কথা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি চান সুষ্ঠু তদন্ত হোক, যাতে নির্দোষ কেউ শান্তি না পায়। এ কারণে দীর্ঘ সময় লাগলেও সেটা মেনে নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, “প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একটা খুনের ঘটনা, যেটার তদন্ত দ্রুত শেষ করার বিষয়ে অন্য কোনো উপায় আছে কিনা বা তদন্তের দায়িত্ব অন্য কোনো পক্ষকে দেয়া যায় কিনা, যাতে প্রক্রিয়াটা দ্রুত হয়। এই বিষয়ে কারো মতামত নেয়া।”
‘সরকার এই মামলার তদন্ত চায় না‘
আইনমন্ত্রীর কথার প্রতিক্রিয়ায় রুনির ভাই নওশের রোমান বলেন,”আইনন্ত্রীর কথায় আমাদের লজ্জা আর ঘৃণা আসে। এখন আর হতাশা বোধ করি না। আমরা আগেও বলেছি আর এখন আইনমন্ত্রীর কথায় এটা স্পষ্ট যে, সরকার এই মামলার তদন্ত চায় না। হয় সরকারের কেউ অথবা অন্য এমন কেউ এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, যাদের সরকার আড়াল করতে চায়।”
আর সাগরের মা সালেহা মুনির বলেন, “ওরা তো নিজেরাই এখন জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাদের গ্রাম দেশে কথা আাছে- মাচার তলে কেরে? আমি কলা খাই না। এটা কোন ধরনের কথা? ৫০ বছর পর তো আমরা, হত্যাকারীরা কেউই বেঁচে থাকবো না। তখন এই বিচার কার হবে? কার জন্য হবে? কে দেখবে?”
তার কথা , “এক যুগ তদন্ত করেও তারা কিছু বের করতে পারছে না। আমাদের কিছু জানাচ্ছে না। আর আইনমন্ত্রী হাস্যকর কথা বলছেন।”
তদন্তের ফলাফল শূন্য?
এই মামলা এখন তদন্ত করছেন র্যাবের অ্যাডিশানল এসপি মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি দেড় মাস আগে নতুন তদন্ত কর্মকর্তার দায়িত্ব নিয়েছেন। চেষ্টা করেও তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ পর্যন্ত আট বার নতুন তদন্ত কর্মকর্তা পাওয়া গেছে নিয়ম রক্ষার জন্য। তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে এই মামলার পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, “আমি আর কী বলবো! র্যাব শতাধিকবার সময় নিয়েছে। কিন্তু তদন্তের কোনো ফলাফল জানায়নি। তারা না পেলে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়ে দিক। এভাবে তো মামলা ঝুলিয়ে রাখা ঠিক না।” তার কথা, “র্যাব কয়েকজনকে ধরেছে, তবে তারা প্রকৃত আসামি নয়। তারা অপরাধীদেরই শনাক্ত করতে পারেনি। ডিএনএ টেস্টও করেছে, কিন্তু কোনো ফল নেই।”
হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটা পারসেপশন আছে: মোরশেদ
র্যাব মামলার তদন্তে নেমে আটক আটজন, নিহত সাগর-রুনি এবং স্বজনসহ ২৫ জনের ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায়। যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষাগার থেকে পরীক্ষার রিপোর্টগুলো হাতে পাওয়ার পর অপরাধক্ষেত্রের প্রতিবেদন (ক্রাইম সিন রিপোর্ট) পর্যালোচনা করে দুইজনের ডিএনএর পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল পেয়েছে। তবে তা দিয়ে সন্দেহভাজন খুনি চিহ্নিত করা যায়নি।
এই মামলায় আটক আট জনের মধ্যে পাঁচজন- রফিকুল, বকুল, সাইদ, মিন্টু ও কামরুল হাসান ওরফে অরুন, মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র রায় হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সাগর-রুনির পারিবারিক বন্ধু তানভীর এবং বাসার নিরাপত্তাকর্মী পলাশ রুদ্র পাল ও হুমায়ূন কবীরকে। তাদের সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন।
সাগরের মা সালেহা মুনির বলেন, “এখন র্যাব আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করে না। তারা যেন আমাদের এড়িয়ে চলতেই পছন্দ করে।” আর রুনির ভাই নওশের রোমান বলেন, “তদন্ত বলতে এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি। আর এখন আর আসলে কোনো তদন্ত হচ্ছে না।”
‘নতুন কোনো সংস্থাকে তদন্তের ভার দেয়ায় আইনে কোনো বাধা নেই’
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ ও ডিবি দুইমাস মামলাটির তদন্ত করে। দুই মাস পর র্যাবকে আদালত এই মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেয়। সেটা দেয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আ্যডাভোকেট মনজিল মোরসেদের আবেদনে। এই তদন্তে র্যাবের অদক্ষতা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তদন্তের জন্য দক্ষতা এবং আধুনিক সব সুবিধা র্যাবের আছে। কিন্তু প্রশ্নটি অন্য জায়গায়। তাদের সীমাদ্ধতা থাকতে পারে। এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে একটা পারসেপশন আছে। কারা জড়িত, সেটাও নানাভাবে শোনা গেছে। নানা কথা হয়েছে। সেই কারণেই হয়তবা তদন্ত আলোর মুখ দেখছেনা।” তার কথা, “র্যাব বলছে একজন খুনির ডিএনএ প্রোফাইল তারা পেয়েছে। তারা যেভাবে বলছে, তাতে এখন তাকে বের করতে ১৭ কোটি মানুষের ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। এই পরিস্থিতি দেখে আমরা আদালতে আবেদন করেছিলাম যে, গুগলের কাছ থেকে ঘটনাস্থলের স্যাটেলাইট ইমেজ নিয়ে ওই দিন বাড়ির আশপাশে যারা ছিল তাদের চিহ্নিত করা হোক। তাতে ৫০ জনের বেশি হবে না। তাদের ডিএনএ টেস্ট করলে হয়ত হত্যাকারী খুঁজে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু র্যাব সেদিকে যাচ্ছে না৷”
র্যাব তো মামলাটি ছাড়ছে না: আবু
র্যাবকে বাদ দিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনেভেস্টিগেশন (পিবিআই) বা অন্য সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “পিবিআই তদন্তে ভালো করছে। তারা বেশ কিছু পুরোনো ও জটিল মামলার তদন্তে সফল হয়েছে। তাদের তদন্তের দায়িত্ব দিতে আইনগত কোনো বাধা নেই। এটা আদালত চাইলে বা সাগর-রুনির পরিবার আবেদন করলে অন্য সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার এই মামলার তদন্ত প্রকৃতই চায় কিনা। সেটা সুরাহা না হলে অন্য কাউকে নতুন করে তদন্তের দায়িত্ব দিয়ে লাভ নেই। একই অবস্থা হবে।”
পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, ” র্যাব তো মামলাটি ছাড়ছে না। তারা সময়ের পর সময় নিচ্ছে আর বলছে চেষ্টা করছে। তারা না পারলে মামলাটা ছেড়ে দিলেই অন্য সংস্থাকে তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হবে। তারা পরছেও না, পথও ছাড়ছে না। আর আদালত চাইলে তদন্তকারী সংস্থা পরিবর্তন করতে পারে। এখানে আইন কোনো বাধা হবে না।”
তারা না পারলে বলুক, তদন্ত ছেড়ে দিক: সালেহা
সাগর-রুনির পরিবার কী চায়?
গত বছর এই ফেব্রুয়ারি মাসে সাগরের মা সালেহা মুনির ডয়চে ভেলেকে বলেছিলেন, “পিবিআই যদি ৩০-৩৫ বছর পর সগিরা মোর্শেদ হত্যাকাণ্ডের অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পারে, তাহলে র্যাব কেন পারে না? তারা না পারলে বলুক, তদন্ত ছেড়ে দিক। যারা পারে, তারা তদন্ত করুক। আমার প্রশ্ন- তারা কি উদ্দেশ্যমূলকভাবে তদন্তে দেরি করছে, না ভয় পাচ্ছে প্রকাশ করতে?”
এক বছর পর শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪) তিনি বলেন, “তদন্ত সংস্থা পরিবর্তন করে কোনো লাভ হবে না। কারণ, সরকার চায় না এর তদন্ত হোক। চাইলে এতদিনে খুনিরা ধরা পড়তো, বিচারের মুখোমুখি হতো। আমি এখন আল্লাহর কাছে বিচার চাই। এখানে বিচার কার কাছে চাইবো? এই সরকার বিচার করবে না।”
রুনির ভাই নওশের রোমানও একই কথা বলেন। তার কথা, “র্যাব তার ব্যর্থতা স্বীকার করে বলুক তারা মামলার তদন্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে, খুনিদের চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তখন অন্য সংস্থার তদন্ত চাইতে পারি। র্যাব তো তাদের ব্যর্থতা স্বীকার করে না। আসলে এই মামলাটি তদন্তের নামে ধামাচাপা দেয়া হচ্ছে। এখানে তদন্তকারীদের কিছু করার নেই। সব কিছু উপরের নির্দেশে হচ্ছে। তাই তদন্ত সংস্থা বদল করে কী হবে? কোনো ফল হবে না।”